Advertisment

বাবা শয্যাশায়ী, হতদরিদ্র্য পরিবারের আলোর দিশারী সপ্তম শ্রেণির রাত্রি

বিষয়টি নজরে আসতেই ছাত্রীটির বিষয়ে খোঁজ নেওয়া শুরু প্রশাসনিক কর্তাদের।

author-image
Chinmoy Bhattacharjee
New Update
student of class 7 drives toto

টোটো চালাচ্ছে স্কুলছাত্রী। ছবি: প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়।

বাড়িতে পাঠ্যপুস্তক, খাতা, পেন স্কুলের ব্যাগ সবই আছে। নেই শুধু বেঁচে থাকার রসদ ও চিকিৎসা করিয়ে বাবাকে সুস্থ করে তোলার মত অর্থ। তাই আপাতত লেখাপড়া শেখার ইচ্ছাকে শিকেয় তুলে রেখে টোটোরিক্সা চালানোকেই জীবনের একমাত্র অবলম্বন হিসেবে বেছে নিয়েছে সপ্তম শ্রেণির রাত্রি মালিক। অসহায় পরিবারের মুখ চেয়ে চোদ্দ বছরের মেয়েটির জীবনসংগ্রাম অনেক কাহিনিকেও হার মানাবে।

Advertisment

রাত্রির বাড়ি পূর্ব বর্ধমানের কালনা ১ নম্বর ব্লকের নিভুজি বাজার এলাকায়। স্থানীয় কৃষ্ণদেবপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। আর পাঁচটা পরিবারের ছেলে-মেয়ের মত রাত্রিও লেখাপড়া শিখে জীবনে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখত। কিন্তু, সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায় বাবা মদন মালিক দু’বছর আগে সেরিব্রাল স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার পর।

বাড়ির একমাত্র উপার্জনশীল বাবা শারীরিক অসুস্থতার কারণে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলায় রাত্রিদের গোটা পরিবার যেন অথৈ জলে পড়ে যায়। বাড়িতে রয়েছে ছাত্রীর দেড় বছর বয়সী ভাই। মা গৌরী মালিক অপরের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ শুরু করেছেন। কিন্তু পরিচারিকার কাজের সামান্য পারিশ্রমিকে অসুস্থ স্বামীর চিকিৎসার খরচ জোগানো ও সংসার চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। অভাব কুরে কুরে খাচ্ছিল পরিবারকে। কোনওদিন একবেলা, আবার কোনওদিন আধপেটা খেয়ে মালিক পরিবারের সদস্যদের দিন কাটছিল।

এই পরিস্থিতিতে পরিবারের সবার অন্নসংস্থানের জন্য রাত্রি লেখাপড়ার পাঠ শিকেয় তুলে রেখে নিজেই টোটো চালিয়ে অর্থ উপার্জনের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়। নাবালিকার চালানো অটোতে সওয়ার হয়েই কালনার অনেক বিদ্বজ্জন গন্তব্যে পৌঁছন। তাঁদের মধ্যে কেউ আবার ছাত্রীর অসহায়তার কথা শুনে পাশে থাকার আশ্বাস দেন । আবার কেউ সহানুভূতি দেখানোর পরিবর্তে মুখ ঘুরিয়ে চলে যান। যদিও এইসব নিয়ে রাত্রি মাথা ঘামাতে চায় না।

আরও পড়ুন- রূপের ডালি সাজিয়ে তৈরি প্রকৃতি! পাহাড়ি গাঁয়ের চোখ জুড়নো শোভা মনে ঝড় তুলবে!

তাঁর এখন একমাত্র লক্ষ্য, নিজের উপার্জনের অর্থে অসুস্থ বাবার চিকিৎসা করানো ও ভাইকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করা। তবে ছোট্ট বয়সে তাঁর এই পরিশ্রম এদেশে শিশু শ্রম আইন লঙ্ঘন করছে বলেই মত ওয়াকিবহাল মহলের। রাত্রির মতো বয়সে কায়িক পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করার বিষয়টিতে আমাদের দেশের আইন সায় দেয় না। কিন্তু তবুও শুধুমাত্র পরিবারের মুখে হাসি ফোঁটাতে ছোট্ট কাঁধে বিরাট দায়িত্ব তুলে নিয়েছে একরত্তি ওই মেয়েটি।

ছাত্রীর বাবা মদন মালিক বৃহস্পতিবার বিছানায় হেলান দিয়ে বসে চোখের জল মুছতে মুছতে বলেন, 'আমার ভাগ্য সত্যি খারাপ। তাই আমার নাবালিকা মেয়েই এখন আমার ও পরিবারের ভরসা। সেরিব্রাল স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার পর আমি শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছি। আমার ছোট্ট মেয়েটা অপরের টোটো দৈনিক ভাড়ায় চালিয়ে উপার্জন করে আমার চিকিৎসা করাচ্ছে। পরিবারের সবার মুখে অন্ন জোগাচ্ছে।'

মা গৌরীদেবী বলেন, 'কোনও বাবা-মা চায় না, লেখাপড়া শিকেয় তুলে তাঁদের নাবালিকা মেয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে টোটোরিক্সা চালিয়ে উপার্জনে নেমে পড়ুক। কিন্তু, আমাদের পরিবারের চরম অর্থ সংকট আমার নাবালিকা মেয়েকে বাধ্য করেছে টোটো চালিয়ে অর্থ উপার্জনের পথ বেছে নিতে। কারণ, স্বামী অসুস্থ হওয়ার পর কোনওদিন আমাদের খাবার জুটেছে। আবার কোনওদিন উপবাসেই কাটাতে হয়েছে।' গৌরীদেবী এ-ও বলেন, 'লেখাপড়া শিখে বড় হওয়ার স্বপ্ন আমার মেয়েরও ছিল। কিন্তু, ভাগ্যর পরিহাসে মেয়ের সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে। এই অবস্থায় পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতার হাত বাড়ানোর জন্য গৌরীদেবী বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ সব হৃদয়বান মানুষের উদ্দেশ্যে আবেদন রেখেছেন।

আরও পড়ুন- অভিষেকের মঞ্চ থেকেই ফিরহাদে বিরাট আস্থা মমতার, বললেন- ‘আমার মৃত্যুর পরে…’

রাজ্যের নারী, শিশু ও সমাজকল্যাণ দফতরের মন্ত্রী শশী পাঁজা সব শুনে বলেন, 'ওই ছাত্রীর বাবা-মা তাঁদের সমস্যার কথা সবিস্তারে জেলাশাসককে জানাক। অবশ্যই সরকার ও প্রশাসন তাঁদের পাশে দাঁড়াবে।' কালনা ১ নম্বর ব্লকের বিডিও শুভঙ্কর বালা সব শুনে বলেন, 'বিষয়টি জেনেছি। এসডিও স্যারের সঙ্গে এনিয়ে আলোচনাও হয়েছে। দেখা যাক, কী করা যায়।'

Education student E toto
Advertisment