সংগ্রহের নেশা বড় নেশা, যাকে একবার পেয়ে বসে ছাড়া বড় মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়! ছোট থেকেই সকলে টুকটাক কমবেশি কিছু না কিছু সংগ্রহ করে। দেশলাইয়ের বাক্স, ডাকটিকিট, কয়েন, খেলনা, পুতুল। বয়স বাড়ার সঙ্গে এসব জিনিসগুলো হারিয়ে যায়। স্মৃতির পাতায় ধুলো জমে। খুব কম মানুষই আছেন যারা এসব সংগ্রহগুলো আঁকড়ে ধরেন। ইতিহাসকে জানা, ইতিহাস নিয়ে চর্চা করা এক অভ্যাসে পরিণত হয়। ভবিষ্যতের জন্যে তৈরি করে এক অমূল্য ভাণ্ডার। রবিও এদের মধ্যেই একজন। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। পুরো নাম রবি শঙ্কর শর্মা। এই মুহূর্তে কলকাতার অন্যতম জনপ্রিয় মুদ্রা সংগ্রাহক।
রবির সংগ্রহের শুরুটাও আর পাঁচ জনের মতনই ছিল। টুকটাক যা পেতেন তাহাই সংগ্রহ করতেন। সময়টা ১৯৯৪-৯৫ সাল। এরপর গ্রামের বাড়ি বিহারে ঘুরতে গিয়ে দাদুর কাছে কয়েকটি পুরনো কয়েন পায়। সেই থেকে কয়েন সংগ্রহ শুরু। রবির কথায়, 'দাদুর কাছে পুরনো কয়েন পাওয়ার পর আমার মনে প্রশ্ন আসতে শুরু করে এই কয়েন গুলো কেন এমন দেখতে! বাজার ঘুরে ঘুরে এই ধরণের আরও অনেক কয়েন আমি কিনে ফেলি। সেগুলো একটা সিকুয়্যাল অনুযায়ী সাজিয়ে রাখি। এটা ৯৯সালের ঘটনা। সেই থেকে কয়েন সংগ্রহের নেশা শুরু।' এই মুহূর্তে রবির কাছে কতগুলো কয়েন আছে তা গুণে শেষ করা যাবে না। কোনটা নৌকার মতো, বুলেটের মতো, ডলফিনের মতো, কোনওটি আবার ধুলোয় মিশে থাকা দানার মতো— এ সবই হল আসলে কয়েনের এক একটি আকার! বিভিন্ন বিষয়ের উপর এসব কয়েনের একটা সিরিজ তৈরি করে তিনি ফাইল বন্দী করে রেখেছেন।
আরও পড়ুন- ‘তারার ছায়া’য় স্মৃতির সমাহার, অপূর্ব-কীর্তিতে চাগিয়ে উঠছে ইতিহাস-প্রেম
ভারতবর্ষে মুদ্রা ব্যবহারের শুরুটা অনেক আগে থেকেই হয়েছিল। একেক জায়গায় একেক রকম মুদ্রা ব্যবহৃত হত। কালের নিয়মে সেসব পরিবর্তিত হয়েছে। ইতিহাস বলছে রাজ্যপাট চালানোর ক্ষেত্রে নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে ভালবাসতেন মহম্মদ বিন তুঘলক। তাঁর রাজত্বে রুপোর মুদ্রার সঙ্গে চালু হয়েছিল তামার মুদ্রাও। রবির মুদ্রা সংগ্রহের প্রধান আকর্ষণই এসবই। সংগ্রহের পাতা ওলটাতে ওলটাতে বেরিয়ে আসে মুদ্রার রূপ চেহারা।
আরও পড়ুন- আদি থেকে আধুনিক, কলকাতার ‘ক্যামেরাম্যান’-এর জিম্মায় এক স্বর্ণালী ‘ইতিহাস’
খ্রিস্টের জন্মের ৬০০ বছরেরও আগের বিভিন্ন ভারতীয় মুদ্রা দেখতে কেমন ছিল তাঁর ইতিহাস গড় গড় করে বলতে থাকেন। রবি বলেন, "ইতিহাস থেকে জানতে পারি, খ্রিস্টের জন্মের ৬০০ বছর আগে ভারতে ছিল ১৬টি জনপদ। প্রতিটিরই আলাদা আলাদা মুদ্রা ছিল। ১৬টি জনপদেরই মুদ্রা রয়েছে আমার সংগ্রহে। এর মধ্যে সব থেকে পুরনো গান্ধার জনপদের মুদ্রা। এই মুহূর্তে আমার প্রধান সংগ্রহের বিষয় উত্তর পূর্ব ভারতের কয়েন। ত্রিপুরা, আসাম, মিজোরাম।"
মুদ্রার যে পরিবর্তন। তার আঁকার আকৃতি, ওজন, এসব ইতিহাস চর্চা না করলে কোনটায় জানা সম্ভব নয়। যেমন গুপ্ত যুগের বেশির ভাগ মুদ্রাই ছিল সোনার। প্রতিটি মুদ্রা থেকে উঠে আসে সেই জায়গার রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাস। মুদ্রার ওপর লেখা এবং প্রতীক থেকে উদ্ধার হয় নানান তথ্য। সম্রাট আকবরের সাহিত্যের প্রতি আগ্রহটা বোঝা যায় চার কোণার কয়েন কাপলিটের ওপর কবিতা দেখে। গান্ধার যুগের বাঁকানো নৌকা আকৃতির 'ব্যান্ডবার কয়েন', প্রাচীন ভারতের বিজাপুর রাজ্যের চুলের ক্লিপ আকৃতির 'লারিন কয়েন'।
আরও পড়ুন- কলকাতার এই প্রবীণ সংগ্রহ করেন উনিশ শতকের অমূল্য সব ‘সুচ-সুতোর’ ভালোবাসা
এ সব তথ্যই নখদর্পণে রবি শঙ্করের। রবিবাবুর কাছে মুদ্রাগুলোর আর্থিক দামের থেকে ঐতিহাসিক মূল্যটায় অনেক বেশি। রিপ্লালিক ইন্ডিয়ার কয়েন দিয়েই প্রথম শুরুটা করেছিলেন। এরপর ব্রিটিশ ইন্ডিয়া, মুঘল যুগ, ভারতের প্রাচীন মুদ্রা সংগ্রহ করে এভাবে ধীরে ধীরে এগোতে থাকেন। রবি শঙ্কর শর্মা বর্তমানে কলকাতা মুদ্রা পর্ষদের সেক্রেটারি। প্রতি বছর কলকাতায় মুদ্রা পর্ষদের উদ্যোগে মুদ্রা প্রদর্শনীও হয়। সেখানে অংশগ্রহণ দেশের বিভিন্ন জায়গার মুদ্রা সংগ্রহকরা।
আরও পড়ুন- পুতুল নাচের ইতিকথা, সংগৃহীত পুতুলেরা যেন নিজেদের গল্প বলছে
অনেকের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে রবি শঙ্কর শর্মার মতন সংগ্রাহকরা কীভাবে এসব মুদ্রা সংগ্রহ করেন? রবি বলেন, "দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মুদ্রার কোনও প্রদর্শনী হলে সেখানে পৌঁছে যাই। কয়েন, নোট কিনে নিজের সংগ্রহ বাড়াই। এছাড়াও অনেকে নিজে থেকে এসে দিয়ে যান। যখনই কোন নতুন কয়েন পায়, তার তথ্য জোগাড় করে ফেলি। এভাবে একটা সিরিজ তৈরি হয়ে যায়।" যুগ পরিবর্তন হচ্ছে, পরিবর্তন হচ্ছে কয়েনের ধারনাও। প্রত্যেক যুগের সাক্ষ্য বহন করে সে সময়ের কয়েন। ডিজিটালের যুগে মুদ্রা পরিবর্তিত হয়ে বিট কয়েনে এসে দাঁড়িয়েছে। হাতে ধরা যায় না, দেখা যায় না তবুও এই মুদ্রার সোনার চেয়েও দামী। যত দিন যাচ্ছে সব কয়েনে আসছে পরিবর্তন। আমাদের পকেটে রাখা ছোট্ট কয়েনগুলোতেই হয়তো এই প্রজন্মের ইতিহাস লেখা থাকবে। রবি শঙ্কর শর্মার মতন মানুষই নিজেদের সংগ্রহে বাঁচিয়ে রাখবেন সেসব ইতিহাস।
আরও পড়ুন- গুরুত্বপূর্ণ নথি-নিদর্শন, সবই আছে এই বাঙালির সংগ্রহে…