কলকাতা শহরের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে নানা সময়যন্ত্র। এই যন্ত্রগুলোয় যুগের পর যুগ ধরে এই শহরের রূপ বদলের সাক্ষী। কাল যে ছিল নতুন আজ সেসময় পুরনো। টিক টক করে বেজে চলা সিম্ফনিরা যেন লিখে চলে ইতিহাস। সাহেব সুবোধ, মুঠে কেরানি, বেকার, পড়ুয়া ঘড়ির সময়ের সঙ্গে সকলের জড়িয়ে রয়েছে অতীত এবং নতুনের এক যোগসূত্র। উনিশ শতকের কলকাতায় অফিস, কাছারি, স্কুল থেকে বিকেলের বেড়াতে যাওয়া সব কিছুই যেন হঠাৎ করে এক যন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে এসে যায়। হাতে হাত ঘড়ি, দেওয়ালে দেওয়াল ঘড়ি। ইউরোপে যে পরিবর্তন আসতে প্রায় পাঁচশো বছর লেগেছিল, সেটাই আমাদের দেশে ঘটেছিল এক শতাব্দীর মধ্যে। প্রহর-দণ্ড-পলের হিসেব থেকে ঘড়ির কাঁটা ধরে ঘণ্টা-মিনিট-সেকেন্ডের অনুশাসনে সাধারণ মানুষের জীবনের সুতো বাঁধা হয়ে গিয়েছিল। অ্যাংলো সুইস- ক্যাভালরি, ফেবার লুবা, টি শট, ওমেগা, ওয়েস্ট এন্ড ওয়াচ, হেনরি স্যান্ডোজ। তারপর এল রিকো, সিকো। উচ্চবিত্ত থেকে মধ্যেভিত্ত সকলের হাতেই বাঁধা পড়ল সময়যন্ত্র।
Advertisment
সময়যন্ত্রদের রক্ষা করতে কলকাতার শহরের আনাচে কানাচে তৈরি হল ঘড়ির দোকান। বিগত কয়েক দশক ধরে এখানেই প্রাচীন সব ঘড়ির সময় বাঁচিয়ে রাখা হয়। এরকমই শতাব্দী প্রাচীন ঘড়ির দোকান মাসুদ আলমের। বয়স ষাটের কাছাকাছি। মহাত্মা গান্ধী রোড এবং সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ক্রসিংয়ের ধারে যে ফুটপাথ! তার পাশেই মাসুদ আলমের ঘড়ি মেরামতের ছোট্ট দোকান। দেওয়ালে ঝুলছে পুরনো সব দেওয়াল ঘড়ি। সারি সারি হাত ঘড়ি ছড়িয়ে আছে সামনে রাখা বড় কাঁচের বাক্সে।
এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।
এখানেই মনোযোগ দিয়ে কাজ করে চলেছেন কলকাতার 'ঘড়ি ম্যান' মহম্মদ মাসুদ আলম। আজ মঙ্গলবার 'বিশ্ব ঐতিহ্যদিবস' (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ডে)। কলকাতায় এমন অনেক হেরিটেজ দোকান কিংবা বাড়ি আছে যাদের বয়স একশ বছর পার হয়ে গেলেও জোটেনি হেরিটেজ তকমা। তারমধ্যেই অন্যতম মহম্মদ মাসুদ আলমের এই দোকানটি। ফুটপাথের ধার দিয়ে রোজ কত মানুষ হেঁটে যায়। তাঁদের ধারণাতেই এই দোকানের বয়স একশ বছরেরও বেশি পার করে ফেলেছে। রং ওঠা দেওয়ালের বুকে ঝুলে থাকা ঘড়িগুলোর বড় পেন্ডুলামগুলো হেলতে দুলতে জানিয়ে দিচ্ছে নিজেদের বয়স।
প্রাচীন সব দলিল ঘেঁটে যতটুকু জানা যায় পুরনো কলকাতার ঘড়ি মেরামতের বেশিরভাগ দোকান তৈরি হয়েছিল বড়বাজার এলাকায়। আদি ঘড়ির দোকান ছিল মিস্টার গুঠেরির। রাধাবাজার এলাকায় প্রথম ঘড়ির সারাইয়ের দোকান। ১৭৮০ সালের হিকির বেঙ্গল গেজেট পত্রিকায় বিজ্ঞাপন থেকে অন্তত এমন তথ্যই উঠে আসে। মিস্টার গুঠেরি নিজের ওয়ার্কশপে কিছু শিক্ষানবিশও নিয়োগ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যেই মিস্টার স্টাইলাস নামে একজন ১৭৮১ সালে বিজ্ঞাপন দিয়ে জানাচ্ছেন যে, মিস্টার গুঠেরির কাছে কাজ শিখে এবার নিজের ব্যবসা খুলছেন লালবাজারে। ১৭৮৭ সালের আশপাশে কাগজের বিজ্ঞাপন থেকে আরও বেশ কয়েকজন ঘড়ি প্রস্তুতকারকের নাম পাওয়া যায়। যেমন— জন শেলভারটন, জন ব্রুস, উইলিয়াম মিলস, আলেকজান্ডার উইলসন প্রমুখ।
এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।
এই একই সময় খবরের কাগজের পাতায় উঠে আসতে শুরু করে ঘড়ি তৈরির যন্ত্রপাতির বিজ্ঞাপন। ঘড়ি সারাইয়ের কাজে রোজগারও ছিল বেশ ভালোই। কলকাতার অনেক যুবক এই পেশায় আসতে শুরু করেন। নতুন নতুন ওয়ার্কশপ খুলছে আর কাজ শিখতে আসে নতুন ছেলেরা। এভাবেই ঘড়ি সারাইয়ের কাজে আসে মহম্মদ মাসুদ আলমের ঠাকুরদাদা। উনিশ শতকের কলকাতায় ঘড়ির বাজার তখন বেশ রমরমা। বিক্রির পাশাপাশি দোকানে রাখা হত ঘড়ি সারাইয়ের মেকানিক।
"আমাদের দোকানটি প্রথমে অনেক বড় ছিল। ভাড়ায় নেওয়া। তখন বাংলাদেশ অনেকের কাছে পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত। কিছু আর্থিক সমস্যায় পড়ে ভাড়া দিতে না পেরে দোকানটি নিয়ে নেওয়া হয়। পরে একটা ছোট অংশ বাড়িওয়ালা আমাদের দেয়। পরবর্তীতে আমার বাবা আড়াই টাকার বিনিময়ে ওই ছোট দোকানটি কিনে নেয়। আমি দশ বছর বয়স থেকে বাবার কাছে কাজ শিখে দোকানে বসতে শুরু করি। ছোট থেকেই দেখতাম বিদেশের সব নামীদামী ঘড়ি বাবা-ঠাকুরদা সহজে সারাই করে ফেলছেন। ঘড়ি সারাইয়ের জন্যে দোকানে মানুষের ভিড় লেগে থাকতো। এখন ঘড়ির কাস্টমারই নেই। তাই তেমন রোজগারও নেই। কলকাতা শহরে পুরনো সব ঘড়ি মেরামতের দোকান ব্যবসা চালাতে না পেরে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। নতুন প্রজন্মের ঘড়ি মেরামতের প্রতি আগ্রহ নেই। আমার এই দোকানের সঙ্গে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। তাই এখনও টিকিয়ে রেখেছি। এরপরে কি হবে আল্লাহ জানে।" পুরনো ওমেগা ঘড়ির স্প্রিং সারাই করতে করতে এ কথাগুলো বলছিলেন মাসুদ আলম। পুরনো কলকাতা নিয়ে যারা চর্চা করেন তাদেই কিছু খোঁজ রাখেন এরকম শতাব্দী প্রাচীন হেরিটেজ দোকানগুলোর।
ফরাসি, জাপানি, জার্মান, আমেরিকান এবং ভারতীয় সব মিলিয়ে একশর বেশী পুরনো 'অ্যান্টিক' ঘড়ি রয়েছে মাসুদ আলমের কাছে। যাদের দাম সাত হাজার থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা। কিছু ঘড়ি নিজের দোকানে রাখা আর কিছু ঘরে। নিজের দোকানকে তিনি এতটায় ভালোবাসেন লকডাউনের সময়েও গার্ডেনরিচের বাড়ি থেকে ঘণ্টা তিনেক হেঁটে দোকানে এসে ঘুরে যেতেন ষাট বছরের এই বৃদ্ধ। মাসুদ আলমের কথায়, "আমার দোকানে কোন সাইন বোর্ড লাগানো নেই। লোকে আমার কাজকে ভালোবাসে। তাতে নামের প্রয়োজন হয় না। বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেক মানুষ তাদের সব পুরনো ঘড়িগুলো নিয়ে আসে আমার কাছে। যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করবো পুরনো এসব ঘড়িগুলোকে।"
একটা পুরনো শহর। তার মধ্যেই অসংখ্য প্রাচীন কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এরকমই মাসুদ আলম এবং তার ছোট ঘড়ির দোকান। এই সময়যন্ত্রের রক্ষক কলকাতার অনেক পুরনো সময়ের সাক্ষী। ফুটপাথের ধারের একশ বছরের পুরনো ছোট দোকানে বসে অ্যাংলো সুইস ক্যাভালরির মতন ঘড়ির বুকে সহজে যে প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়া যায় এ জিনিস না দেখলে বিশ্বাস করা যায়না।