Advertisment

ওড়িশা-অন্ধ্র-কর্নাটক-তামিলনাড়ু-কেরলের ত্রাস রবিনহুড 'টাইগার' এখন কেমন আছেন?

গরিবের দুঃখ সইতে পারে না টাইগার। তাই দলবল নিয়ে বড়লোকের ধন ছিনিয়ে এনে গরিবদের মধ্যে তা দু'হাতে বিলিয়ে দিয়েছেন এই ডাকাত সর্দার।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Fatenur Mollah, ফতেনুর মোল্লা

রবিনহুড টাইগার ফতেনুর মোল্লা। ছবি: শশী ঘোষ।

একসময় বিহার, ঝাড়খন্ড, ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু ও কেরালা একাধিক রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসনের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল 'টাইগার'। তবে এই 'টাইগার'ই আবার ছিলেন বাঁকুড়ার 'রবিনহুড'। এ যেন পুরোদস্তুর সিনেমার প্লট। গরিবের মেয়ের বিয়ে থেকে বাড়ির চালা তৈরি, মানুষের চিকিৎসা দান-খয়রাতি- সবেতেই অসহায়ের সহায় 'রবিনহুড' টাইগার। গরিবের দুঃখ সইতে পারে না টাইগার। তাই দলবল নিয়ে বড়লোকের ধন ছিনিয়ে এনে গরিবদের মধ্যে তা দু'হাতে বিলিয়ে দিয়েছেন এই ডাকাত সর্দার। তবে এখন চুরি-ডাকাতিকে চিরতরে বিদায় দিয়ে একচালা ঘরে দিন গুজরান করেন ফতেনুর মোল্লা ওরফে টাইগার। ৬ স্ত্রী, ৩৩জন সন্তান-সহ তাঁর পরিবারের মোট সদস্য সংখ্যা এখন প্রায় আড়াইশো। 'স্বাভাবিকভাবেই' নাতি নাতনিদের সকলের নামও মনে রাখতে পারেন না ৭৫ বছরের বৃদ্ধ 'টাইগার'।
পুনিশোল নাম শুনলেই একসময় আঁতকে উঠতেন অনেকেই। ডাকাতের গ্রাম। নাম শুনলেই ভয় পেতেন আশপাশের মানুষজন। কেন ডাকাতিয়া গ্রাম বলা হত? ফতেনুরের স্পষ্ট বক্তব্য, "মূলত আমি ও আমার দলবলের জন্যই এই বদনাম ছড়িয়েছিল পুনিশোলের। গ্রামের লোকজন ডাকাতি করতো এমন ভাবার কোনও কারণ নেই"। এভাবেই অনর্গল বলে চলেছেন একসময়ের ত্রাস ফতেনুর ওরফে টাইগার।

Advertisment

Fatenur Mollah, ফতেনুর মোল্লা বাঁকুড়ার পুনিশোলের বাড়িতে ফতেনুর। ছবি: শশী ঘোষ।

কী বলছেন ডাকাত সর্দার? কিভাবে 'টাইগারে'র জন্ম? পুনিশোল সংলগ্ন নতুন গ্রামে নিজের বাড়ির দাওয়ায় বসে জীবনের নানা গল্প শোনাচ্ছেন সত্তরোর্দ্ধ ফতেনুর...

বয়স পঁচাত্তর হলেও এখনও একেবারে টানটান চেহারা। তীক্ষ্ণ নজর। হাঁটাচলায় শিহরণ জাগানো ব্যাপার রয়েছে। এখনও শরীরী ভাষা জানান দিচ্ছে তাঁকে 'টাইগার' কেন বলা হত! একেবারে দৃপ্ত চলনবলন। এখন বোল্ডার, মোরামের ব্যবসা নিয়েই সময় কেটে যায় তাঁর। তবে অতীতের কার্যকলাপ নিয়ে তাঁর কোনও আপশোস নেই। গড়গড়িয়ে তিনি বলে চলেছেন জীবনর গল্প। ১৬-১৭ বছর বয়স থেকেই ফতেনুরের 'টাইগারে' বিবর্তন শুরু।

Advertisment

আরও পড়ুন: এশিয়ার বৃহত্তম সংখ্যালঘু গ্রামে উন্নয়ন নিয়ে ক্ষোভ তৃণমূলেই

ফতেনুরের কথায়, "আমার তখন বয়স ১৫-১৬ বছর। চুরি, জুয়া খেলার বদনাম দিয়েছিল এক চৌকিদার। সে আমাকে ধমক দিয়ে পুলিশের কাছে যেতে বলেছিল। একথা শুনে ওই বয়সে মাথা ঠিক রাখতে পারিনি। চৌকিদারকে বেদম মেরে কাদায় ফেলে দিয়েছিলাম। সেদিন রাতে আমাদের ঘরে পুলিশ এসেছিল আমার খোঁজ করতে। মা-ও আমাকে খুব বকাবকি করেছিল"। মা বলেছিলেন "কি এমন করলি যে পুলিশ তোকে খুঁজছে"? পরিষ্কার মনে আছে মা আমাকে খুব বকেছিল। ফতেনুরের বক্তব্য, "তখন আমার মুরগীর ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেল। এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছি, একপ্রকার পালিয়ে বেড়াচ্ছি। সেই সময় কতগুলো লোক চুরি করতে আসে। আমি ওদের বললাম, তোমাদের সঙ্গে যাব। ওদের সঙ্গে ভিড়ে গেলাম। কমবয়সী ছটফটে হওয়ায় ওরা আমাকে দলে টেনেও নিল। চোরেদের কাছে যাওয়া-আসা করতে করতে আমি চোর থেকে বড় ডাকাত হয়ে গেলাম। একেবারে বিরাট নামকরা ডাকু বনে গেলাম। এরপর পুলিশকে মেরে রিভলভার, বন্দুক চুরি সবই করলাম। এখনও মনে আছে দু'জন পুলিশ জীতেন বন্দ্যোপাধ্যায় ও যতীন প্রধানকে খুব পিটিয়ে ছিলাম"।

ফেলে আসা জীবনের অলি গলিতে ফতেনুর হেঁটে চলেছেন। আর বলছেন, "আমার কাছে বড়জোড়া থেকে নিয়ে আসা একটা বন্দুক ছিল। সেটাও পুলিশ জেনে গিয়েছিল। গ্রামে পুলিশ এসেছিল। আমার সঙ্গে বোঝাপড়া করে পুলিশ বন্দুক, রিভলভার নিয়ে যায়। তবে পরের দিন খবর হয়েছিল, পুনিশোলে পুলিশ রেইড করেছে। জনা কয়েক চোর-ডাকাত সেখানে জড় হয়েছিল। আমাকে থানায় ডেকে এক পুলিশ আধিকারিক ১৩ হাজার টাকা দিতে চেয়েছিল। আমি তা নিইনি"।

এতকিছুর পরও কিন্তু তরুণ ফতেনুরের স্বভাবে কোনও পরিবর্তন আসেনি। মায়ের বকুনি বা পুলিশের চমকানি সবই বৃথা যায়। এরপর এ রাজ্য ছেড়ে তিনি ছুটলেন ভিন রাজ্যে। প্রথমেই তিনি মাদ্রাজ তথা বর্তমান চেন্নাইয়ে তাঁর বোনের বাড়ি চলে যান। সেটাই তাঁর অস্থায়ী ঠিকানা হয়ে ওঠে। এবার টাইগার হয়ে ওঠার কাহিনী নয়া মাত্রা পায়। তিনি বলেন, "বাংলা ছেড়ে চলে যাই। ভিন রাজ্যে পাড়ি দিই চুরি-ডাকাতি করতে। কটক, ভুবনেশ্বর, মহীশূর, বিজয়নগর, বিজয়ওয়াড়া, নীলগিরি, কেরল, তৎকালীন মাদ্রাজ তথা বর্তমান চেন্নাই-সহ নানা জায়গায় অপারেশন চালাই। গ্রামের কয়েকজনকে সঙ্গী হিসাবে নিয়েছিলাম। হিন্দি ছাড়াও অল্পবিস্তর দক্ষিণের অন্যান্য ভাষাও আয়ত্তে চলে আসে। তাছাড়া মাদ্রাজে আমার বোনের বাড়ি ছিল। তাই সুবিধা একটু বেশিই ছিল। কেউ জিজ্ঞাসা করলেই কাপড়ের ব্যবসাদার বলে ধোঁকা দিতাম"। এভাবেই পরিচয় লুকিয়ে জীবনের ২৮-৩০টা বছর কাটিয়ে দিয়েছেন ফতেনুর।আরও পড়ুন: একমাত্র এমএ পাশের চাকরি জোটেনি, মাঝপথে পড়া ছাড়ছেন টোটোরা

Fatenur Mollah, ফতেনুর মোল্লা এখনও শরীরী ভাষা জানান দিচ্ছে তাঁকে 'টাইগার' কেন বলা হত! ছবি: শশী ঘোষ।

তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডাকাতিতে ইতি টানেন ফতেনুর। দলও ভেঙে যায়। কিন্তু, এ পথে একবার চলে এলে তো আর ফেরা যায় না, ডাকাতি ছাড়লেন কীভাবে? তিনি বলেন "দীর্ঘ ২৮-৩০ বছরের ডাকাতিতে একবার ওড়িশার কটকে ধরা পড়ে গেলাম। সেদিন ওড়িয়া ভাষা একেবারে বুঝতে পারিনি। ওড়িশা পুলিশ ওদের ভাষায় আমার নাম ঠিকানা জিজ্ঞেস করেছিল। আমি হিন্দিতে বলতে বলেছিলাম। তাতেই আমি ফেঁসে যাই। শাড়ির ঝুলিতে চাকু, ভোজালি  পায় পুলিশ। ওই ঘটনায় আমার সাত বছরের সাজা হয়েছিল। কিন্তু আবেদন করার পর তা অনেকটা কমে যায়। এরপর গ্রামে ফিরলে ছেলেরা আমার ওপর চাপ সৃষ্টি করে। আমারও মনে হল, অনেক হয়েছে আর না। তাছাড়া বয়সও বাড়ছে"। এ কথা বলতে বলতেই একজনের নাম মনে পড়ে যাচ্ছে ফতেনুরের। "এএসআই বিমল রায়। উনিই আমাকে মানুষ করে দিয়েছেন। পুরোপুরি ডাকাতি ছেড়ে দিলাম। ফিরলাম স্বাভাবিক জীবনে", অকপট জানালেন বৃদ্ধ টাইগার।

ডাকাতি করলেও কখনও আয়নার সামনে দাঁড়াতে অসুবিধা হয়নি ফতেনুরের, নেই বিন্দুমাত্র আপশোসও। কারণ, টাকা-গয়নার অভাবে গ্রামের কোনও মেয়ের বিয়ে আটকে গেলে হাজির হয়ে যেতেন বাঁকুড়ার রবীনহুড। যা সোনা ডাকাতি করে নিয়ে এসেছেন, সবটা দিয়ে দিয়েছেন গরিব পরিবারের মেয়েকে। কারও হয়ত ত্রিপল নেই। বর্ষায় ঘরে জল পড়ছে। ফতেনুরের বাড়িতে এসেছেন ত্রিপল চাইতে। তাঁকে নিজের বাড়ির চালার ওপর লাগানো ত্রিপলটা খুলে নিয়ে যেতে বলেছেন ডাকু সর্দার। অথচ হুঁশ নেই যে ওই ত্রিপল খুললে নিজের ঘরেই জল ঢুকে যাবে। চিকিৎসা করাতে হয়ত কারও অর্থের প্রয়োজন, তাঁকে টাকা দিতে কোনও দ্বিধা করেননি। তাঁর কথায়, "নিজের জন্য কিছুই রাখিনি। কারও অভাব দেখতে পারি না। একদিকে ডাকাতি করেছি, অন্যদিকে যখন যেভাবে পেরেছি মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি"।

Fatenur Mollah, ফতেনুর মোল্লা গরিবের দুঃখ সইতে পারে না টাইগার। ছবি: শশী ঘোষ।

আরও পড়ুন: ‘২০২১-এর ভোটে ১০০ টা আসনে লড়বই, সারা বাংলা জানবে আমার নাম’

তবে টাইগারের জীবনকাহিনী কিন্তু একমাত্রিক ডাকাতির গল্পেই সীমাবদ্ধ নয়। বলতে গেলে, একেবারে রঙীন জীবন। তাঁর পরিবারের চিত্রটা একবার দেখলেই তা বোঝাও যায়। ফতেনুরের স্ত্রীর সংখ্যা ৬। তাঁর মেয়ে ১২ জন, ছেলে ২১ জন। পরিবারের সদস্য প্রায় আড়াইশো জন। পরিবারে ভোটারের সংখ্যা ৮৬। সব নাতি-নাতনিদের নামও জানেন না দাদু। তবে নিজের ছেলে-মেয়েদের নাম তাঁর স্মরণে আছে। ফতেনুর বলেন, "আমি বাইরে গিয়ে দু'নম্বরী করে বিয়ে করিনি। আমি বাঁকুড়ার মেয়েদেরই বিয়ে করেছি! তবে ডাকাতি করতাম বলে স্ত্রীরা সঙ্গে থাকতে চাইতো না"।

ডাকাতি এবং একাধিক স্ত্রী সঙ্গই নয়, ফতেনুরের জীবনে নির্বাচনী সাফল্যও রয়েছে। ২০০৮-এর গ্রাম পঞ্চায়েতে ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চার সদস্য হিসাবে জয় পান ফতেনুর। "সেবার আমি বিপুল ভোটে গ্রাম সংসদ নির্বাচনে জয় পেয়েছিলাম", জানান বৃদ্ধ টাইগার। এক সময়ের পঞ্চায়ত সদস্যর হাঁটাচলা এখনও সোজা। কথাবার্তাও সোজা-সাপ্টা। নতুন গ্রামে টিনের চালা, দশ বাই দশ ঘরে এখন কোনওরকমে দিনাতিপাত করেন তিনি। কী ভাবছেন রাজনীতি নিয়ে? "এসব নিয়ে ভাবার কিছু নেই। এখন আমি সংসার নিয়েই ব্যস্ত। তাছাড়া আমার ঘরেই ভোট রয়েছে ৮৬টা। এখন রাজনীতিতে শুধু দলাদলিই দেখছি"।

kolkata news
Advertisment