সান্তা বুড়োর জন্যে হা-পিত্যেশ অপেক্ষা শুরু হয় বড়দিন এলেই। সান্তা মানেই তো ঝোলা থেকে বেরোবে হরেক রঙের কেক, পেস্ট্রি কিংবা হরেক রকমের লজেন্স। কিন্তু সে সব পেতে গেলে তো সান্তা দরকার, এক নয় একাধিক। আর মধ্য কলকাতার ঝলমলে রাস্তায় বড়দিনের মরসুমে সেই সান্তা পাঠান সেলিম ভাই। তিন নম্বর বেডফোর্ড লেনের এক চিলতে ঘরে সেলিমের সংসারে ভাত বাড়ন্ত। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে সান্তা পাঠানোয় বিরাম নেই বছর বাহান্নর এই মুসলিম প্রৌঢ়ের। ২৫ ডিসেম্বরে পৃথিবীর বুকে আলো ফেলেছিলেন যিশু খ্রিস্ট। সেই আনন্দে লাল রঙের জোব্বা, লাল পাজামা, মাথায় চোঙ্গা টুপি, কাঁধে ঝোলা নিয়ে হাজির হয় সান্তাবুড়ো। উত্তর মেরুর তাঁর নিজস্ব বাসা থেকে বল্গা হরিণে টানা স্লেজে রওনা দেন বুড়ো সান্তা। কে এই সান্তা বুড়ো? আসল সান্তা বুড়ো কে এই উত্তর জানা নেই! তবে কলকাতার সান্তা যে সেলিম আহমেদ তা হলফ করে বলা যায়। ওনাকেই কলকাতার সান্তাদের আদিপুরুষ বলা যেতে পারে।
রিপন স্ট্রিট থেকে ডানদিকে যে রাস্তা চলে যাচ্ছে, তা থেকে একটু এগোলেই গলির মধ্যে তস্যগলি পেরিয়ে ৩ নং বেডফোর্ড লেন। এখানেই থাকেন সেলিম আহমেদ ওরফে সেলিম জোকারওয়ালা। এখানে যে কেউকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেবে সেলিম ভাইয়ের আস্তানা। লোকমুখে পদবিটির কিঞ্চিৎ বদল ঘটেছে। জোকারওয়ালা। সেলিম জোকারওয়ালা। পাঁচ-তারা হোটেল থেকে শুরু করে অভিজাত ক্লাব, বিত্তবানদের বিয়েশাদি-জন্মদিন, সব জায়গায় সাপ্লাই দেন সান্তা-চ্যাপলিন। শীতের মরসুমে ক্রিসমাসের সময় যে সব সান্তাওয়ালাদের ঝোলা কাঁধে কলকাতায় দেখা যায় তারা বেশিরভাগই সেলিমের দলের। এঁদো গলিঘুঁজিতে ইটের গা বের করা বাড়ি। লাল রঙের ভাঙা গেট দিয়ে ঢুকে সিঁড়ির নীচ দিয়ে ডানদিকে ঘুরে দুটো দরজা পেরলেই দশ ফুট বাই দশ ফুট ঘরটাই সান্তা ক্লজদের ডেরা। রঙ উঠে যাওয়া সবুজ দেওয়ালের পাশে ডাঁই করে রাখা চিরপরিচিত লাল পোশাক-টুপি। সেলিম আহমেদ এখানে বসেই তৈরি করছেন সান্তাক্লজদের। ডিসেম্বর মাস মানেই ওনার ব্যস্ততা তুঙ্গে। বড়দিনের আগে একের পর এক সান্তা ক্লজদের তৈরি করতে হবে। নামাজের শেষে শেখাতে হবে চালচলনের খুঁটিনাটি।
কে এই সেলিম? যার ঘরেই সান্তাক্লজদের আস্তানা। সেলিম আসলে এক অদ্ভুত, আজগুবি, মজাদার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। যে ব্যবসা হাসতে হাসতে কাঁদায়। যে ব্যবসা হাসি-কান্নার মধ্যেও বিবেকে খোঁচা মারে। হাসি আর কান্না কোথাও যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। সেলিমের এই মজা ব্যবসাটা শুরু হয়েছিল ১৯৯২ সালে। কাজের ফাঁকেই বলছিলেন পুরনো কথা, "এখনও আমার মনে আছে সময়টা ৯২ সালের ১লা অগস্ট। ক্রিসমাসের আগে লিন্ডসে স্ট্রিটে একটা দোকান সাজানোর কাজ করছিলাম। বহুত খাটাখাটনির পরে দোকানদার এসে বললেন, 'ইয়ে সব ঠিক হ্যায়, লেকিন কুছ মজাদার হোনা চাহিয়ে।' আমার এই কথা শুনে মাথা গরম হয়ে যায়। আমি তখন ইয়ার্কি মেরে বলি, মজা চাহিয়ে তো জোকার লেকে আয়ে? তৎক্ষণাৎ ভদ্রলোক বললেন, 'লে কে আইয়ে না জোকার।' তখনই আমার মনে হয়েছিল জোকার সাজার ব্যবসায় নামলে কেমন হয়? তখনই ছুটতে ছুটতে বাড়ি ভাইদের সঙ্গে কথা বললাম। এরপরে গেলাম দর্জির কাছে। বললাম, ভাই আমাকে জোকারের পোশাক বানিয়ে দেবে? এক জন মেক-আপ আর্টিস্টকে আমি আগে থেকেই চিনতাম। টালিগঞ্জে স্টারদের মেক-আপ করতেন। তাকে গিয়ে বললাম, ভাই জোকারের ড্রেস বানিয়ে দাও। পরদিন জোকার সেজে নিউ মার্কেটের সেই দোকানেই আবার গেলাম। আমাকে দেখে মানুষজন খুব মজা পেল। রাতারাতি হিট হয়ে গেল জোকার। দোকানদারতো বহুত খুশ! তারা বলতে লাগল, 'আরে সার্কাস কা জোকার দুকান মে!' জোকার সেজে মানুষকে আনন্দ দেওয়াই হয়ে উঠল আমার পেশা আমার পুঁজি। সেই থেকে নাম হয়ে গেল সেলিম জোকারওয়ালা।"
সেলিমের সংসারে অভাব-অনটন যতই থাক, সেসব আড়াল করে উত্সবের মরশুমে মানুষজনকে নিখাদ মজা উপভোগ করানোই ছিল সেলিমের জোকারওয়ালার প্রধান কাজ। ক্রিসমাসের সময় উপহারের ঝোলা কাঁধে সান্তাদের তৈরি করে দেওয়াটা সেলিমের প্রথম ভালো লাগা। একসময় নিজেও সাজতেন, অন্যকেও সাজাতেন। এখন বয়স হয়েছে। ছেলেরাও বড় হয়েছে, তারাই সাজে, সাজিয়ে দেন তিনি। ছেলেরাও খুশি। সেলিমের জোকারওয়ালার প্রধান অনুপ্রেরনা 'মেরা নাম জোকার'। সেলিম হাসতে হাসতে নিজেই বলছিলেন এই কথা, "রাজ কাপুরের মেরা নাম জোকার ৫০০ বার দেখেছি। একবার একটা অনুষ্ঠানে শাম্মি কাপুরের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, শাম্মি কাপুর নিজে বলেছিলেন রাজ কাপুরের পরে, আসলি জিন্দেগি মে সেলিম জোকারওয়ালাই আসলি জোকার"। কথা গুলো বলার সময় সেলিমের চোখ যেন জ্বল জ্বল করছিল। শুধু নিজের পরিবারের লোকেদেরই নয়। জুটিয়ে নিয়েছেন পাড়ার ছেলেদেরও। সকলকেই ট্রেনিং দিয়েছেন জোকারের ভূমিকায়। পরিবারের তো বটেই, অন্যদেরও রুটি-রুজির ব্যবস্থা করেছেন সেলিম। এলাকার অধিকাংশ ছেলেই লাল জামা, লাল টুপি পড়ে দাড়ি-গোঁফ লাগিয়ে গলায় গিফটের ব্যাগ ঝুলিয়ে বেড়িয়ে পরেন। তিন-চার ঘণ্টার জন্য পারিশ্রমিক ১০০০ টাকা। সবাই যে টাকার প্রয়োজনে সান্টা সাজেন তা নয়। কেউ কেউ শখেও সাজেন সান্টা। প্রত্যেকের নিজস্ব পেশা আছে। ঝোলা কাঁধে নিয়ে তার মধ্যে থেকে গিফট বের করে মানুষকে আনন্দ দিতে পারার মজা উপলব্ধি জন্যেই সান্তা সাজতে চলে আসেন সেলিম জোকারওয়ালার কাছে। শীতকাল এলেই সান্তাদের চাহিদা বিপুল। কথা বলার সময় থাকে না। সেলিমও তাই মজা করে বলছিলেন, এই জোকারওয়ালা না থাকলে সান্তাক্লজরা কলকাতায় রাস্তা খুঁজে পেত না।
আরও পড়ুন- কলকাতার বড়দিনের ঐতিহ্য, ৯৩ বছর ধরে তিলোত্তমায় কেকের কাব্য লিখছে সালদানা