শরীরে বাসা বেঁধেছে মারণব্যাধি ক্যানসার। তবে জীবন-যুদ্ধে হার মানতে নারাজ সামিনা খাতুন। এখন একটাই লক্ষ্য, মারণ-ব্যাধির যন্ত্রণা সহ্য করেও পড়াশুনা চালিয়ে যেতে হবে। সাফল্যের সঙ্গে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতেই হবে। অদম্য এই জেদকে সম্বল করেই কিশোরী সামিনা এগোচ্ছে লক্ষ্য পূরণের পথে।
পূর্ব বর্ধমানের জামালপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম রামনাথপুর। এই গ্রামের শেখ পাড়ার একটি গরিব পরিবারের মেয়ে সামিনা খাতুন। ছোট্ট দু-কুঠুরির ঘরে পরিবারের সবাই একসঙ্গে বাস করেন। সামিনার বাবা শেখ আলম পেশায় খেতমজুর। মা নূরজাহান বেগম গৃহবধূ। সামিনার দিদি আসলিমা বিবাহিতা। ছোট থেকেই লেখাপড়ার প্রতি দারুণ আগ্রহ সামিনার। তাঁর বাবা তাঁকে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করেন গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে সামিনা ভর্তি হয় স্থানীয় বনবিবিতলা উচ্চ বিদ্যালয়ে।
অষ্টম শ্রেণীতে পাঠরত অবস্থায় আচমকা সামিনার শারীরিক অসুস্থতা শুরু হয়। তাঁর বাবা-মা তাঁকে জামালপুর ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করান। ব্লক হাসপাতালের চিকিৎসাতেই সামিনা সুস্থ হয়ে উঠবে বলে মনে করেছিলেন তাঁর অভিভাবকরা। কিন্তু সামিনার অসুস্থতা বাড়তেই থাকে। বিভিন্ন ডাক্তারি পরীক্ষা করানো হয় সামিনার। সেই রিপোর্টে দেখা যায় সামিনার শরীরে বাসা বেঁধেছে মারণব্যাধি ক্যানসার। তারপর থেকে টানা দু’বছর ধরে তাঁর রোগের চিকিৎসা চলছে।
এখন নিয়ম করে সামিনাকে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে কেমোথেরাপি, রেডিয়েশন থেরাপি দিতে হয়। বিশেষ এই চিকিৎসার জন্য মাথার চুল সব উঠে যাওয়ায় একসময় সামিনা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। পরিবারের সদস্যরাই তাঁকে সাহস জুগিয়েছেন। তাই মানসিক দৃঢ়তা ফিরে পেয়েছে সামিনা। আর পিছন পিরে তাকাতে চায় না সে। মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষা সম্পূর্ণ হয়েছে। এবার লক্ষ্য মাধ্যমিকে ভালো ফল করা। সেই লক্ষ্যেই অবিচল থাকতে চায় এই ছাত্রী। শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে সঙ্গে নিয়েই পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে সামিনা।
সমিনা জানিয়েছে, তাঁর দুই কানের নিচে গলার অংশে ক্যানসার বাসা বেঁধেছে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। চিকিৎসা চলছে ঠিকই তবে এখনও খাওয়া-দাওয়া ভালোভাবে করতে পারছে না। গলায় ব্যথা থাকায় ভাত গিলে খেতে পারছে না। শুধু পাতলা সুজি কোনও রকমে খেয়ে দিনের পরদিন তাঁকে পেট ভরাতে হচ্ছে। তবে কষ্ট যাই থাক, লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে সে বিছানায় শুয়ে থেকে দিন কাটাতে চায় না। সামনেই তাঁর মাধ্যমিক পরীক্ষা। সেই পরীক্ষায় সফল ভাবে তাঁকে উত্তীর্ণ হতে হবেই। তাই মারণ ব্যাধির জ্বালা যন্ত্রণা সহ্য করে পড়াশুনাতেই মনোনিবেশ করেছেন সামিনা।
আরও পড়ুন- এক ধাক্কায় নামল পারদ, নতুন বছরের শুরুতেই বঙ্গে জমিয়ে শুরু শীতের ইনিংস
সামিনার বাবা শেখ আলম বলেন , “আমি খেতমজুরের কাজ করে যা রোজগার করি তা দিয়েই পরিবারের সকলের দিন গুজরান হয়। দু’বছর ধরে আমার ছোট মেয়ে সামিনার ক্যানসার রোগের চিকিৎসা চলছে। মেয়ে এতবড় কঠিন রোগে আক্রান্ত হলেও অর্থের অভাবে তাঁকে পুষ্টিকর খাবারদাবার কিছুই দিতে পারছি না। মেয়ের স্কুলের শিক্ষকরা, জামালপুর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি মেহেমুদ খান,
কর্মাধ্যক্ষ ভূতনাথ মালিক-সহ আরও কয়েকজন শুভানুধ্যায়ী আর্থিক সাহায্য করছেন। তাই কেমো থেরাপি ও রেডিয়েশন থেরাপির জন্য মেয়েকে নিয়মিত বর্ধমান হাপাতালে নিয়ে যাওয়া নিয়ে আসা ও ওষুধের খরচ জোগাড় করতে পারছি।' তিনি আরও জানান, মাধ্যমিক পরীক্ষায় সফল হতে করতে পুরোদমে পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছে সামিনা। তাঁরাও সামিনাকে সবরকমভাবে সহয়োগিতা করছেন।
বনবিবিতলা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল রায় জানান, সামিনা খাতুন এ বছরের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী । দু'বছর আগে ওর শরীরে ক্যানসার ধরা পড়ে। তারপর থেকে ধারাবাহিক ভাবে ওর চিকিৎসা চলছে। চিকিৎসার জন্য বিদ্যালয়ের তরফে যতটা সম্ভব সামিনাকে সাহায্য করা হয়েছে। সামিনা মাধ্যমিক পরীক্ষায় যাতে স-সম্মানে উত্তীর্ণ হতে পারে তার জন্য বিদ্যালয়ের তরফে ওকে সব ধরনের সাহায্য করা হচ্ছে।