ইচ্ছা থাকলেও পরিবারের আর্থিক অনটনের কারণে অনেক ছেলেমেয়েই শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়। প্রয়োজনেও শুধুমাত্র আর্থিক দুর্দশার জেরে অনেক পরিবারের বাচ্চারাই টিউশন নিতে পারে না। এমনই সব ছাত্রছাত্রীদের জন্য আশার প্রদীপ জ্বালিয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত এক স্কুল শিক্ষক। আজ শিক্ষক দিবসে বাংলার এই মাস্টারমশাইয়ের অভূতপূর্ব কীর্তির কথা তুলে ধরা হল এই প্রতিবেদনে।
পূর্ব বর্ধমানের কালনার সমীরণপ্রসাদ চক্রবর্তী। দুঃস্থ পরিবারের পড়ুয়াদের পাশে দাঁড়ানোর সংকল্পটা মনে মনে দানা বেঁধেছিল স্কুলে চাকরি করার সময় থেকেই। সেই মতো শিক্ষকতার জীবন থেকে অবসর নেওয়ার পরেই সমীরণপ্রসাদবাবু নিজের বাড়িতেই খুলে বসেছেন "ষোলো আনার পাঠশালা", অর্থাৎ ১ টাকা গুরুদক্ষিণার বিনিময়ে লেখাপড়া। অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষকের এই পাঠশালা এখন রীতিমতো চর্চায়। দুঃস্থ পরিবারের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ক্ষেত্রে সমীরণবাবুর এই পাঠশালার জুড়ি নেই।
সমীরণপ্রসাদ চক্রবর্তীর বাড়ি কালনা ১ ব্লকের কৃষ্ণদেবপুরের হালদার পাড়ায়। তিনি বাদলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ২০২১ সালের ৩০ নভেম্বর তিনি অবসর নিয়েছেন। সমীরণপ্রসাদ বাবুর একমাত্র ছেলে সৌম্যদীপ ইতিমধ্যেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি সম্পূর্ণ করেছেন। বাড়িতে ৯৬ বছরের বৃদ্ধা মা সবিতারাণী দেবী ও স্ত্রী সোমা চক্রবর্তীকে নিয়ে থাকেন ৬২ বছরের সমীরণপ্রসাদ চক্রবর্তী।
আরও পড়ুন- সংঘাত চরমে, রাজ্যপাল কথা না শুনলে ‘আর্থিক অবরোধ’ গভর্নর হাউসের সামনে ধর্না! চরম হুঁশিয়ারি মমতার
শিক্ষকতার জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করলেও সমীরণপ্রসাদবাবু শিক্ষাদানের ব্রত থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেননি। তার উপর দুঃস্থ পরিবারের পড়ুয়াদের জন্য কিছু একটা করার সংকল্পটা আগেই ছিল। সেই সংকল্প পূরণের জন্যই নিজের বাড়িতে তিনি পাঠশালা খুলে বসেছেন। বর্তমানে সমীরণপ্রসাদ বাবুর "ষোলো আনার পাঠশালা"য় পড়ুয়ার সংখ্যা ৫০ ছাড়িয়েছে। পড়ুয়ারা সবাই গরিব ঘর থেকে এসেছেন। তাঁদের মধ্যে তপশিলি জাতি ও উপজাতি পরিবারের ছেলেমেয়েরাও রয়েছেন।
এই পাঠশালাই এখন সমীরণপ্রসাদ বাবুর ধ্যানজ্ঞান। ষোলো আনা বা ১ টাকা গুরুদক্ষিণার বিনিময়ে কয়েক দফায় তিনি তাঁর পাঠশালায় প্রথম শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ুয়াদের পড়ান। পাঠশালায় থাকা ভাঁড়েই গুরুদক্ষিণা জমা দেয় পড়ুয়ারা। অনেক ছেলেমেয়েদের আবার নিজের গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে কিংবা গুরুদক্ষিণা বাবদ মেলা পয়সা থেকে বই-খাতা, পেন-পেন্সিল কিনে দেন তিনি। এহেন এক মাস্টারমশাইকে নিয়ে এলাকাবাসীর গর্বের শেষ নেই।
তাঁর এই "ষোলো আনার পাঠশালা" প্রসঙ্গে সমীরণপ্রসাদ চক্রবর্তী বলেন, "আমার পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যই শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাবা, কাকা, কাকিমা, বড়দি সকলেই শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষা মানুষকে শুধু শিক্ষিতই করে তোলে না, চেতনাবোধও তৈরি করে। শিক্ষার প্রসার ঘটালে সমাজও উন্নত হয়। পরিবারিক আর্থিক অনটনের জেরে প্রয়োজন থাকলেও অনেক গরিব ঘরের ছেলেমেয়েরা টিউশন নিতে পারে না। তাই তাঁদের পাশে দাঁড়াতে ষোলো আনার পাঠশালা চালু করেছি। যতদিন শরীর সায় দেবে ততদিন এই পাঠশালা চালিয়ে যাব।"
আরও পড়ুন- ‘নির্দোষ’ দাবি, তবুও কেন নুসরত জাহানের বক্তব্যে একাধিক প্রশ্ন?
অন্যদিকে, "ষোলো আনার পাঠশালা"র পড়ুয়া শুভ সাহা, প্রীতম ঘরামিরা জানালেন, তাঁদের পরিবারে আর্থিক অনটন রয়েছে। লেখাপড়া শেখার জন্য সমীরণ স্যারই তাঁদের ভরসা। ষোলো আনা বা এক টাকা গুরুদক্ষিণা নিয়েই স্যার তাঁদের লেখাপড়া শেখান।