Advertisment

সারদার ক্ষতিগ্রস্তরা কেমন আছেন?

হুগলির চাঁপদানির কংগ্রেস বিধায়ক তথা সিনিয়র কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান চিট ফান্ড কেলেঙ্কারি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। তিনি বললেন, "এসব নাটক।"

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Saradha Scam

সারদায় ক্ষতিগ্রস্ত দক্ষিণ ২৪ পরগনার সাপেরা বিবি (ছবি পার্থ পাল)

রবিবারগুলো রাকিব সর্দারের পক্ষে ভয়ানক। অন্য দিনগুলোতে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার সোনারপুর রেল স্টেশনের কাছে ইতিউতি কাজ খুঁজতে দেখা যায় তাকে। ৩৩ বছরের রাকিবের বাড়ি ওই জেলারই উত্তর বাঁশরা গ্রামে। খুব ভোরে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে রাকিব, ফেরে মাঝরাত পার করে। কোনও কোনও রাত সে কাটিয়ে দেয় স্টেশনেই, কিংবা কোনও বন্ধুর বাড়িতে।

Advertisment

২০১৩ সাল থেকে রাকিবের রুটিন এরকমই।

২০০৬ সাল থেকে চলা সারদার পঞ্জি স্কিমের কেলেংকারি এ বছরেই বেরিয়ে পড়ে, নগদ টাকার আমদানি কমে যায়, বেশি পরিমাণ টাকা বেরিয়ে যেতে থাকে কোম্পানি থেকে। ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে বিধাননগর থানায়, বিনিয়োগকারী ও এজেন্টেদের শয়ে শয়ে অভিযোগ জমা পড়ে।

ছোট একটি পানের দোকানের মালিক রাকিব সারদার এজেন্ট ছিলেন, বিনিয়োগও করেছিলেন তিনি। এরকমটাই ছিল সারদার দস্তুর। অন্য চিট ফান্ড কোমম্পানিগুলির সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল তাঁর। রাকিব বলছিলেন, "আমি আত্মীয় বন্ধু প্রতিবেশীদের কাছ থেকে সাড়ে ৯ লাখ টাকা নিয়েছিলাম। আমার বাবার জমানো ৫০ হাজার টাকাও নিয়েছিলাম। সব টাকা সারদায় খাটাই। কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে আমি তাড়া খাওয়া কুকুরের মত হয়ে গেছি।"

আরও পড়ুন, সারদা কেলেঙ্কারি ও তৃণমূল সংযোগ

"লোকজন আমার বাড়িতে ভাঙচুর করেছে, তারা তাদের টাকা ফেরত চায়। এখনও, বিশেষ করে রবিবারগুলোতে এলাকার লোকজন আমার বাড়িতে এসে আমার স্ত্রী, আমার বাবামা-কে গালিগালাজ করে। কিছু টাকা আমি নিজের পকেট থেকে দিয়ে মিটিয়েছি, কিন্তু সে সামান্য়ই। আমি চোরের মত ঘুরে বেড়াই। এক স্টেশন থেকে আরে স্টেশনে পালাই, একের পর এক কাজ বদলাই।"

গত ৩ ফেব্রুয়ারি সারদা কেলেংকারি আবার সংবাদ শিরোনামে আসতে শুরু করে। তবে এবারের কারণ ভিন্ন- কেন্দ্র-রাজ্য দ্বন্দ্ব। গত ৬ বছরের চেয়েও এবার ঘটনাপ্রবাহ ছিল বেশি নাটকীয়- এ মামলা বিষয়ে কলকাতা পুলিশের কমিশনার রাজীব কুমারকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে আসে সিবিআইয়ের একটি দল, তাদের আবার আটকে রাখে কলকাতা পুলিশ, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ধর্নায় বসে পড়েন, কেন্দ্রীয় বাহিনী সিবিআই দফতরের বাইরে পজিশন নিয়ে নেয়, বিরোধীরা মমতার ধর্নার বিরুদ্ধে এক জোট হন, কেন্দ্র সুপ্রিম কোর্টে যায়, এবং এমনকি ছবির মত পাহাড়ি শহর শিলংও ছবিতে ঢুকে পড়ে, যেখানে শনিবার রাজীব কুমারকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।

এখন রাজনীতির কর্মীরা সারদাকে পুনরাবিষ্কার করছেন, বিজেপি সারদায় টাকা হারানোদের লিস্ট বানাচ্ছে, তৃণণূল কংগ্রেস এ মামলায় সিবিআইয়ের নবউদ্যোগকে বলছে গণতন্ত্র ধ্বংস। রাকিব চাইছেন মৃত্যুর কথাও হোক। রাকিবের কাকা, কুরবান আলি মোল্লাও ছিলেন তারদার এজেন্ট তথা বিনিয়োগকারী। সারদা কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পর, ৬৭ বছরের এই কর্মী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।

রাকিবের একমাত্র ছেলে এখন স্কুলছুট। তাঁর ভাইয়েরা আলাদা হয়ে গেছেন। "আমার কাকা সহজ পথ বেছে নিয়েছে। আমার একটা ছেলে আছে, আমি ঝুলে পড়তে পারছি না। অনেক বার চেষ্টা করেছি... সাহস পাইনি।" কাঁদছিলেন রাকিব।

পশ্চিমবঙ্গে মাশরুমের মত চিট ফান্ড কোম্পানি প্রথম গজিয়ে উঠতে শুরু করে ২০০৮ সালে। পরে তারা ছড়িয়ে পড়তে থাকে আসাম, ত্রিপুরা, ঝাড়খণ্ড, বিহার এবং ওড়িশার মত পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলিতেও। সারদা এবং রোজ ভ্যালির মত বড় কোম্পানি ছাড়াও বহু ছোট ছোট কোম্পানিও পাঁচ বছরে দ্বিগুণ টাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাকা তুলতে শুরু করে বাজার থেকে। ২০১৩ সালে বুদবুদ ফেটে গেল। সিবিআই সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ তদন্তভার নিয়ে নিল।

রাজ্যে বিনিয়োগকারীদের ঠিক কত পরিমাণ টাকা চিট ফান্ডের হাতে খোয়া গেছে তার কোনও হিসেব নেই। সিবিআই এবং ইডির অনুমান শুধু সারদা এবং রোজ ভ্যালিতে খোয়া যাওয়া টাকার পরিমাণ ২৪৬০ কোটি এবং ৩০ হাজার কোটি। এর মধ্যে ১৪০ কোটি টাকা বিনিয়োগকারীদের কাছে ফেরানো গেছে। সুপ্রিম কোর্টে ৬টি মামলা চলছে, কলকাতা হাইকোর্টে চলছে ১৪৮টি মামলা। গ্রেফতার হয়েছেন রাজ্যসভার সাংসদ কুণাল ঘোষ, সৃঞ্জয় বসু, এবং পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র। এঁরা সকলেই জামিনও পেয়েছেন।

আরও পড়ুন, সারদাকাণ্ডে কলকাতা পুরসভাকে সিবিআই-এর নোটিস

রাজ্য সরকার বিচারপতি শ্যামল সেন কমিশন নিয়োগ করে বিনিয়োগের টাকা কিছুটা ফেরানোর একটা চেষ্টা করেছিলেন। তার জেরে অনেককেই বিডিও দফতর আর থানায় দিনের পর দিন পড়ে থাকতে হয়েছে।

কিন্তু রাকিবেরর মত বেশিরভাগ মানুষই ছিলেন দুর্ভাগা। তিন জেলা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, পূর্ব বর্ধমান এবং হুগলি জেলায় সফর করে এমনটাই জানতে পরেছে সানডে এক্সপ্রেস। এ তিন জেলায় বাস ছিল সারদার এজেন্ট-বিনিয়োগকারীদের অনেকেরই।

দক্ষিণ ২৪ পরগনার নবপল্লী গ্রামে কুরবান আলির পুত্র ইসমাইল মোল্লা জানালেন তাঁরা এই ঘোটালায় সর্বস্ব হারিয়েছেন, যাঁরা তাঁর মাধ্যমে টাকা রেখেছিলেন, তাঁরা জোর করে তাঁদের পরিবারের দেড় বিঘে জমির দখল নিয়ে নিয়েছেন। এ পরিবার এখন একঘরে। বাড়ির মেয়েরা জরির কাজ করে এবং পুরুষরা দিন মজুর খেটে সংসার চালাচ্ছেন। ইসমাইলরা তিন ভাই, তিন বোন। বোনেদের কারও বিয়ে হয়নি, কারণ বিয়ে দেওয়ার টাকা নেই তাঁদের।

ইসমাইল জানালেন, "আমার বাবা সাত লাখ টাকা তুলেছিল। আমি জানি না বাব নিজে কত টাকা ঢেলেছিল। কোম্পানি লাটে ওঠার পর গাঁয়ের লোক বাবাকে তাড়া করতে থাকে।"

লোকের তাড়া থেকে বাঁচতে কুরবান মুম্বই পালান। ৩৫ বছরের ইসমাইল বললেন, "২০১৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর সেখানেই গলায় দড়ি দেয় বাবা। বাবা আত্মহত্যা করায় আমরা প্রাণে বেঁচে গেছি।"

যে কফিনে করে মুম্বই থেকে কুরবানের দেহ এসেছিল, তাঁর পরিবার সেটা রেখে দিয়েছে, স্মৃতি হিসেবে। মাটির বাড়ির এক কোণে সে কফিন বাক্সে এখন মালপত্র রাখা হয়। বাড়ির প্রায় সবটা জুড়ে জরির কাজ।

Saradha Scam

 ইসমাইলের বাবা কুরবান মুম্বইয়ে আত্মহত্যা করেন। সারদার এজেন্ট ছিলেন তিনি (ছবি পার্থ পাল)

দক্ষিণ ২৪ পরগনার শকুন্তলা গ্রামের ৩৫ বছরের রাইমা বিবি বললেন, তাঁর বিয়ে ভেঙে গিয়েছে এই কেলেঙ্কারির জেরে। "২০০৯ সালে আমি আমার মেয়ের নামে সারদয় টাকা বিনিয়োগ করি। প্রিমিয়াম দেওয়ার জন্য উদয়াস্ত খাটতাম। আমি মাঠে কাজকরতাম, আমার স্বামী রিক্সা চালাত। ২০১৩ সালে আমার ১৪ হাজার টাকা পাওয়ার কথা ছিল।" কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পর স্বামী-স্ত্রীতে নিত্য ঝগড়া হত। "আমরা আলাদা থাকব বলে ঠিক করি।"

একটা ছোট নোটবুক দেখালেন তিনি। সেখানে জমা রাখা টাকার হিসেব রাখা হত। একটা পৃষ্ঠায় হিসেব রাখা, ২০১২ সালের ২০ ডিসেম্বর ১০০ টাকা জমা রাখা হয়েছে। রাইমার মেয়ে নিলুফা এখন ২০ বছরের। রাইমার দুশ্চিন্তা, মেয়েটার আর বিয়ে হবে না।

আরও পড়ুন, আয়কর দফতরের লাল চোখের সামনে প্রাক্তন সাংসদ জয়ন্ত পাণ্ডার বাহামা লেনদেন

তাঁর বাড়ির পাশে থাকেন খাওন আলি সর্দার। কাগজ পত্র আঁকড়ে ধরে বসে আছেন তিনি। বাড়ির সামনে বসে থাকা খাওন আলি জানালেন, ৪০ হাজার টাকা খাটিয়েছিলেন সারদায়। এখন ৬ জনের পরিবার চালাতে ২ বিঘা জমি বন্ধক রেখেছেন। "ওরা বলেছিল, পাঁচ বছরে এক লাখ টাকা পাব। এখন জমিও গেছে, টাকাও গেছে। আমার ভাইয়ের টাকাও গেছে। আমাদের আর কোনও জমা টাকা নেই।"

রাইমা এবং খাওন টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য বিডিও অফিস আর থানায় গিয়েছিলেন। "কেউ কেউ সামান্য টাকা পেয়েছেন। বেশিরভাগই কিছু পায়নি, আমরাও না। আমাদের এখান থেকে ওখানে পাঠানো হয়েছে শুধু।"

দক্ষিণ ২৪ পরগনার ঘটকপুকুর বাজার। ৪৭ বছরের নিরঞ্জন হাজরা ছোট্ট স্টেশনারি দোকানে বসে আছেন। তিনি মিনতি করলেন, তাঁর টাকা ফেরতে সাহায্য করুক সানডে এক্সপ্রেস। সারদায় ৩৬০০ টাকা হারিয়েছেন তিনি। অ্যালকেমিস্ট গ্রুপের কাছ থেকে তিনি পান ৭৮০০ টাকা।

”এ বছরেই অ্যালকেমিস্টের টাকা ম্যাচিওর করেছে। আমি ওদের অফিসে গিয়েছিলাম। টাকা পাওয়ার জন্যে ভিক্ষে করিছি। ওরা বলল,সিবিআই তদন্ত চলছে, আমার টাকা রিনিউ করা হয়েছে। আমি ব্যাঙ্কের সেভিংস অ্যাকউন্ট থেকে টাকা তুলে ওখানে খাটিয়েছিলাম। আমাদের মত লোকের কাছে এ অনেক টাকা। আমার একটা তিন বছরের মেয়ে রয়েছে।”

আমানতকারী ও এজেন্ট সুরক্ষা মঞ্চের আহ্বায়ক সুবীর দে বললেন, "আমাদের হিসেব মত রাজ্যে ২৩৪ টা চিট ফান্ড কাজ করেছে।" এ সংগঠনটি চেষ্টা করছে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার। কলকাতা হাইকোর্ট কমিটি গঠন করে ৫৪ কোম্পানির সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা ফেরত দেওয়ার চেষ্টা চালালেও, ব্যাপারটা তত সহজ নয় বললেন সুবীর। "কোন কোম্পানির সম্পত্তি, কে মালিক, এসব ঠিকমত নির্দিষ্ট করা শক্ত। এসব সম্পত্তি কেউ কিনতেও চায় না। আমরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি লিখেছিলাম যাতে সরকার এ সম্পত্তি কিনে নেয়। বিজেপি নেতাদের সঙ্গেও দেখা করা আমরা। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি।"

পুলিশ এ ব্যাপারে কিছু বলতে অস্বীকার করেছে। তাদের বক্তব্য, "সিবিআই দেখছে।" অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শ্যামল সেন, যাঁকে রাজ্য সরকার ২০১৫ সালের অক্টোবরে টাকা ফেরতের ব্যাপারে দেখভালের দায়িত্ব দিয়েছিল, তিনি বললেন, "আমি মুখ্যমন্ত্রীকে বিস্তারিত রিপোর্ট জমা দিয়েছি। ঠিক কত টাকা ফেরানো হয়েছে আমার মনে নেই।"

Saradha Scam

দক্ষিণ ২৪ পরগনার ঘটকপুকুরের সাবেরা বিবি (ছবি পার্থ পাল)

১৯০৪ সালে বর্ধমানে গিয়েছিলেন লর্ড কার্জন। তাঁর সম্মানার্থে তৈরি হয়েছিল কার্জন গেট।

দুপুরবেলা কার্জন গেটের উল্টোদিকে মিটিং চলছিল। জেলার নেতারা মঞ্চে বসেছিলেন। ছিলেন মন্ত্রী স্বপন দেবনাথও। শ খানেক তৃণমূল কর্মী ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন।

কলকাতার নগরপালকে জেরা করা যাবে, কিন্তু গ্রেফতার করা যাবে না- সুপ্রিম কোর্টে এ নির্দেশকে নৈতিক জয় আখ্যা দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশ ছিল এই ইস্যুতে স্থানীয় ভাবে সভাসমাবেশ করতে হবে। সামনেই মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। লাউডস্পিকার বাজানোয় নিষেধাজ্ঞা শুরুর ঠিক আগে সময় ছিল সামান্যই।

এদিন একের পর এক বক্তারা মমতার স্তুতি এবং প্রধানমন্ত্রীর মুণ্ডপাত করছিলেন। পূর্বস্থলী দক্ষিণের তৃণমূল বিধায়ক বললেন, "মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু বিরোধী নেত্রী নন, লোকসভা ভোটের পর তিনিই হয়ে উঠবেন কিংমেকার।"

তিনি বললেন, "সারদা কবে ঘটেছিল! ২০১৩। আমাদের সরকার লোকজনকে গ্রেফতার করেছিল। এতদিন পর হঠাৎ সিবিআই সক্রিয় হয়ে উঠল কেন! কারণ লোকসভা ভোট।"

মমতা সিবিআই নিয়ে কলকাতায় ধর্নার সময়ে একই কথা বলেছিলেন।

৪ কিলোমিটার দূরে বিজেপির অফিস। তিনতলা বাড়ির পরিকল্পনা থাকলেও এখন অ্যাজবেস্টসের ছাদ।

সামনে গাদা হয়ে পডে় আছে বালি। বিজেপির পতাকা, নেতাদের প্ল্যাকার্ড, ছড়ানো ছেটানো চেয়ার ডিঙিয়ে ভেতরে ঢোকা গেল। জেলার নেতারা বললেন, চিট ফান্ড ইস্যু জেগে উঠেছে।

বিজেপি জেলা যুব মোর্চার সভাপতি শ্যামল রায় বললেন, "আমরা সমস্ত বুথ স্তরের কর্মীদের বলেছি চিট ফান্ড কেলেঙ্কারিতে ক্ষতিগ্রস্তদের সমস্ত তথ্য জোগাড় করতে। আমরা সে নাম জোগাড় করে জেলাশাসকের কাছে যাব। দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলন শুরু করব। আমাদের নেতা অমিত শাহ বলেছেন আমরা ক্ষমতায় এলে যাতে সব ক্ষতিগ্রস্ত টাকা ফেরত পান, তা দেখা হবে।"

পার্টির জেলা সম্পাদক সুনীল গুপ্ত বললেন, "সারদায় অভিযুক্ত পুলিশ অফিসারকে কীভাবে মুখ্যমন্ত্রী বাঁচাতে চাইছেন, তা সবাই দেখছে। ছোট ছোট সভা করা ছাড়াও আমরা সোশাল মিডিয়ার উপর নির্ভর করছি। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ, গ্রুপ মিটিং- এই সব। তিনি আরও বললেন, পুলিশ তাঁদের সভার অনুমতি দিচ্ছে না।" যে অভিযোগ বিজেপি সম্প্রতি বারবার করছে, তারই পুনরাবৃত্তি করলেন তিনি।

১৭ কিলোমিটার দূরে সোগরাই বাজারে সিপিএমের অফিস নিস্তরঙ্গ। ছোট একটা ঘরে বলে জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য উদয় সরকার এবং এরিয়া কমিটির সম্পাদক কৌসর আলি। তাঁরা স্বীকার করে নিলেন চিট ফান্ড ইস্যু থেকে অনেক দূরে সরে গেছে দল।

কৌসর বলছিলেন, "আমরাই ইস্যুটা প্রথম ধরেছিলাম। কিন্তু এও সত্যি যে আমরা ইস্যু ধরে রাখতে পারিনি। এবার আমরা আবার ইস্যুটা ধরব, আমাদের কলকাতার সমাবেশে কয়েকজন ক্ষতিগ্রস্তদের নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করেছিলাম আমরা।"

চিট ফান্ড কেলেঙ্কারি সামনে আসার পরও ২০১৬ সালে কী করে দ্বিতীয়বার সরকারে এল টিএমসি, তার ব্য়াখ্যা দিচ্ছিলেন উদয় সরকার। "২০১১ সালের পর এরকম কোম্পানির এজেন্টরা তৃণমূলের দিকে চলে যায়। তৃণমূল চিটফান্ডগুলোকে সমর্থন করছিল। মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে তৃণমূল নেতারা যখন এর সঙ্গে আছে তখন টাকা মার যাবে না। কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পর মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে যে টিএমসি সরকার তাদের টাকা ফেরত পাইয়ে দেবে। কিন্তু এখন বিনিয়োগকারী এবং এজেন্ট- দুপক্ষই খেপে উঠতে শুরু করেছে।"

হুগলির চাঁপদানির কংগ্রেস বিধায়ক তথা সিনিয়র কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান চিট ফান্ড কেলেঙ্কারি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। তিনি বললেন, "এসব নাটক। নজর ঘোরানোর জন্য মমতা-মোদী পূর্ব পরিকল্পিত খেলা চালাচ্ছে... চিট ফান্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করার জন্য বিজেপি বা তৃণমূল, কারোরই মাথা ব্যথা নেই।"
বর্ধমান জেলার মোট ৯টি লোকসভা আসনের মধ্যে সবকটিই তৃণমূলের দখলে। তার মধ্যে বর্ধমান পূর্বে সিমিএম একসময়ে যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে সেখানে তৃণমূল ভোট পায় ৪৩.৫ শতাংশ। সিপিএম দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও বিজেপি পায় ১২.৯৩ শতাংশ ভোট। ৯টি আসনেই ২০১৪ সালে তৃণমূল পায় ৪০ শতাংশের বেশি ভোট।

বর্ধমান শহরের আজির বাগান এলাকায় কাগজপত্র নিয়ে জমা হয়েছিলেন বিভিন্ন চিট ফান্ডে টাকা খোয়ানো মানুষদের একটি দল। তাঁরা শুনেছেন সংবাদমাধ্যমের লোকজন এসেছে।

তাঁদের মধ্যে ছিলেন বসুমতী পাত্র। সারা জীবনের সঞ্চয় ২ লক্ষ টাকা সারদায় বিনিয়োগ করেছিলেন তিনি। কেলেঙ্কারি বেরিয়ে পড়ার পর তাঁর ছেলেকে স্কুল ছাড়তে হয়, মাঝপথে গ্র্যাজুয়েশন ছেড়ে দিতে হয় মেয়েকে। "আমি খরচ চালাতে পারছিলাম না। আমার স্বামীর চাকরি নেই। আমি বাড়ি বাড়ি ঘুরে শাড়ি বিক্রি করি।" বলছিলেন ৪২ বছরের বসুমতী।

অল্প দূরেই নীলপুর। ৬২ বছরের বন্দনা রায় ছিলেন একাধিক চিট ফান্ডের এজেন্ট। এই জনতার নেত্রী তিনিই। "৬ লাখ টাকায় বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছি, লোকের টাকা ফেরত দিতে। ওরা বলেছিল আমার বাড়ি জ্বালিয়ে দেবে। প্রতিদিন ছেলে বৌমা আমায় গঞ্জনা দেয়, যারা টাকা রেখেছিল তারা ওদেরও ছাড়ে না।"

অন্য সবার মাঝে দাঁড়িয়ে ভেঙে পড়েন বন্দনা। বলেন, "আমি মুখ্যমন্ত্রীকে অনেকবার চিঠি লিখেছি আমাদের বাঁচানোর জন্য।"

বর্ধমান শহরের থেকে ৫৬ কিলোমিটার দূরের পাণ্ডুয়া, হুগলি জেলার অন্তর্গত। এখানে সন্ধের পর টিন্না মোড়ে চায়ের দোকানের জটলার আলোচনায় উঠে আসে কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত এবং আসন্ন লোকসভা ভোট।

এমনই চায়ের দোকানে নারায়ণ মণ্ডল (৬৬) বসেছিলেন। তিনি সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত হাবিলদার। "এখানে যাদের দেখছেন তারা হয় এ কোম্পানি নয় ও কোম্পানিতে টাকা লাগিয়েছিল। আমার রিটায়ারমেন্টের প্রায় সব টাকা, মোট এক লাখ আমি খাটিয়েছিলাম অ্যাসপেন কোম্পানিতে। ২০১১ সালে। ২০১৩ সালে কোম্পানি উঠে গেল। আমার বেকার ছেলে আছে, স্ত্রী আছে।"

চায়ের দোকান চালাচ্ছিলেন ৬৫ বছরের অনুকূল মজুমদার। টাকা খুইয়েছেন তিনিও। ২০১১ সালে একটি চিট ফান্ডে ৭০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন তিনি, ২০১৬ সালে পাওয়ার কথা ছিল ১.৪ লক্ষ টাকা।

Saradha Scam হুগলির পাণ্ডুয়ার আরেক গ্রামবাসীর সঙ্গে অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্মী নারায়ণ মণ্ডল (ছবি- পার্থ পাল)

তিনি বলছিলেন, "আমার স্ত্রীর ক্যানসার। আকণ্ঠ দেনার দায়ে ডুবে আছি। চিকিৎসার জন্য টাকা ধার করেছি। আমি বাড়ি যাই না। দোকানেই ঘুমোই।"

কাজে থাকলে চিন্তা থাকে না। বলছিলেন অনুকূল মজুমদার। "আমার মনে হয় না, আমায় কেউ সাহায্য করতে পারবে। এখন তাড়াতাড়ি মরে গেলেই ভাল।"

দীর্ঘ ৬ বছর

২০১৩

৬ এপ্রিল- সামনে এল কেলেঙ্কারি, বিনিয়োগকারীরা থানায়, সারদা মালিক সুদীপ্ত সেন সিবিআইয়ের কাছে স্বীকারোক্তি দিলেন. বললেন রাজনীতিকদের টাকা দিতে হয়েছে তাঁকে।

৭ এপ্রিল- সারদায় বিনিয়োগকারীরা ভিড়জমালেন কলকাতায় তৃণমূলের সদর দফতরের সামনে, টাকা ফেরতের দাবি নিয়ে।

২২ এপ্রিল- মমতা সরকার সারদা এবং অন্য চিট ফান্ড তদন্তের জন্য বিশেষ তদন্ত দল গঠন করল। বিনিয়োগকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য প্রাক্তন বিচারপতি শ্যামল সেনের কমিটি গঠিত হল।

২৪ এপ্রিল- কাশ্মীর থেকে ধরা পড়লেন সুদীপ্ত সেন

৩০ এপ্রিল- বিধানসভায় পাস হল নতুন বিল, যার জেরে বিনিয়োগকারীদের টাকা ফেরত না দেওয়া জামিনঅযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে

২৩ নভেম্বর- তৃণমূলের রাজ্যসভা সাংসদ কুণাল ঘোষ সিটের হাতে গ্রেফতার

২০১৪

৯ মে- সুপ্রিম কোর্টি সিবিআইকে নির্দেশ দিল সারদা এবং অন্যান্য চিট ফান্ড কোম্পানির তদন্ত করতে।

৯ সেপ্টেম্বর- সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার তৃণমূলের সহ সভাপতি তথা রাজ্যের প্রাক্ত ডিজিপি রজত মজুমদার

২১ নভেম্বর- সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার তৃণমূলের রাজ্যসভা সাংসদ এবং একটি বাংলা দৈনিকের মালিক সৃঞ্জয় বসু

১২ ডিসেম্বর- পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র গ্রেফতার

২০১৯

৩ ফেব্রুয়ারি- কলকাতার নগরপাল রাজীব কুমারের বাড়িতে হাজির সিবিআই দল, ধর্নায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

৫ ফেব্রুয়ারি- সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ- সিবিআইয়ের সামনে হাজির হতে হবে রাজীব কুমারকে, কিন্তু তাঁকে গ্রেফতার করা যাবে না

৯ ফেব্রুয়ারি- শিলংয়ে সিবিআইয়ের জেরা রাজীব কুমারকে।

Saradha Scam Explained
Advertisment