Advertisment

শিয়ালদহ স্টেশনই মঞ্চ, গান গেয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন রফিকণ্ঠী এস রাজ

শিয়ালদহ স্টেশনে ট্রেন ধরার তাড়াহুড়ো ভুলে তাঁকে ঘিরে সর্বক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন জনা দশেক লোক।

author-image
Shashi Ghosh
New Update
satya raj alias bhulu pradhan sing rafis song every day at sealdah station

সুরেলা কণ্ঠে ফি দিন এভাবেই শিয়ালদহ স্টেশন চত্বর মাতিয়ে রাখেন এস রাজ। এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।

ঘড়িতে তখন বিকেল সাড়ে চারটে। খানিকক্ষণ আগেই বৃষ্টি থেমেছে। শিয়ালদহ স্টেশন চত্বর তখন কাদা- জলে লুটোপুটি অবস্থা। এর মাঝে সাইকেল নিয়ে সেই কাদা জল টপকে স্টেশনের দিকে এসে দাঁড়ালেন মাঝবয়সী এক ব্যক্তি। সাইকেলের পিছনে রাখা সাউন্ডবক্স। ট্রেন ধরার তাড়ায় উৎসাহিত কয়েকজন বার দুয়েক আড় চোখে তাঁকে দেখে নিলেন। ভদ্রলোকের যদিও এসবে ভ্রুক্ষেপ নেই। নিজের মতোই গুণ গুণ করে সাউন্ড বক্সের সঙ্গে মাইক এবং ফোনের কানেকশন দেখেই শুরু করে দিলেন গান। এই গানই যে তাঁর প্রাণ! সরকারি খাতায় কলমে ভুলু প্রধান নাম হলেও নিজেকে এস রাজ অর্থাৎ সত্য রাজ নামে পরিচয় দিতেই পছন্দ করেন। ৫২ বছর বয়সী সত্যবাবু, মহম্মদ রফির একজন অন্ধ ভক্ত। ছোট থেকে রফিকেই নিজের গানের গুরু বলে মনে করেন।

Advertisment

আকাশে মেঘেরা লুকোচুরি খেলছে। উপরে খোলা আসমান। চারদিকে লোকে লোকারণ্য। অনবরত বেজে চলা গাড়ির হর্ন। রাস্তায় মাঝেই এস রাজের গানের মঞ্চ। সাইকেলের সঙ্গে ঝোলানো বোর্ড। সাউন্ডে বক্সে বেজে চলা মহম্মদ রফির গানের সাউন্ড ট্র্যাক। ইউটিউবে মিউজিক ট্র্যাকের সঙ্গে একের পর এক রফির গান গেয়ে চলেছেন সত্য। প্রথম দিকে অনেকে পাশ কাটিয়ে গেলেও খানিক পরে গান শোনার জন্যে গোল হয়ে থমকে দাঁড়ালেন অনেকে। দাঁড়াবেন নাই বা কেন? রফির গান মানেই তো দুঃখ আর সুখ দুইই শ্রুতি মধুর, সুখকর। হাজারেরও ওপর বলিউডি গানে প্লেব্যাক করা রফির গানে বুঁদ আসমুদ্র হিমাচল। আর সত্যের মতন মানুষরাই তো রফির গানের ধারাকেই বাঁচিয়ে রেখেছেন দিনের পর দিন।

publive-image
এমনভাবেই ফি দিন গানের সরঞ্জাম নিয়ে শিয়ালদহ স্টেশনে আসেন সত্য রাজ। এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।

সত্য বলছিলেন, "অনেক ছোট বয়স থেকেই রেডিও এবং ক্যাসেটে রফির গান শুনতে ভালবাসতাম। আমার বড় দাদা রফির অন্ধভক্ত ছিলেন। দাদা নিজেও রফি সাহেবের দারুণ গান গাইতেন। টাকার অভাবে পড়াশুনা করতে পারিনি। গান শেখার ইচ্ছে থাকলেও সেটাও হয়নি। নিজের চেষ্টাতেই গান শিখলাম। ইচ্ছে ছিল শিল্পী হওয়ার। টানাটানির সংসারে খুব কম বয়সেই দিন মজুরির কাজ শুরু করলাম একটি কারখানায়। ৯০'এর দশকে যখন বাজারে মিউজিক সাউন্ড ট্র্যাক এলো। একটি রফি সাহেবের আরেকটি কিশোর কুমারের। আমার এক বন্ধু রফি সাহেবের ট্র্যাকটি এনে দেয়। এরপর সেই থেকে কাজ শেষে সাইকেল এবং মিউজিক বক্স নিয়ে শহরে বিভিন্ন জায়গায় চলে যেতাম গান গাওয়ার জন্যে। এভাবে অনেকের সঙ্গে আলাপ হয়। কয়েকটা জায়গায় গান গাওয়ার সুযোগও পেয়েছিলাম। শিলিগুড়িতে একটি বারে ভালো বেতনে শুধুমাত্র রফির গান গাওয়ার চাকরি পেয়েও ছেড়ে দিতে হয়েছিল। সংসারের কিছু সমস্যার জন্যে যেতে পারেনি। এখনও এটার জন্যে আফসোস হয়।"

publive-image
মাইক্রোফোন হাতে সত্য রাজ। এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।

প্রথাগত গানের তালিম নেই তবু তাঁর গান শুনতে মন্দ লাগে না শ্রোতাদের। তার জন্যেই রাস্তায় অনেক লোক জড়ো হয়ে যায়। করোনার আগেই কারখানার কাজ হারিয়ে ছিলেন। স্ত্রীকে নিয়েই শোভাবাজারের কাছেই একটি বস্তিতে সত্য রাজ থাকেন। স্ত্রী শারীরিকভাবে অসুস্থ। আর্থিক অবস্থাও খুব শোচনীয়। রাস্তায় রাস্তায় রফির গানই তাঁকে জীবন যুদ্ধে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। মাস দুয়েক হল পুরনো কারখানায় আবারও কাজের সুযোগ পেয়েছেন। কাজ শেষ করে প্রায় রোজই বিকেল পাঁচটা থেকে ছ'টা নাগাদ সাইকেল চালিয়ে চলে আসেন শিয়ালদহ স্টেশনে। ঘণ্টা চারেক ফোনে সাউন্ড ট্র্যাক চালিয়ে একটানা গান গেয়ে যান। টাকার জন্যে কারও কাছে হাত পাতেন না। খুশি হয়ে যে যতটুকু দেয় ততটুকুই গ্রহণ করেন। অনেকে টিটকিরি কাটেন অনেকে আবার ভালোও বাসেন।

publive-image
সদাব্যস্ত শিয়ালদহ স্টেশনে প্রতিদিন এমনই মুডেই ধরা দেন বছর বাহান্নর এই ব্যক্তি। এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।

"রাস্তায় গান গাইছি অনেকে অনেক কথা বলবেন। এটাই তো স্বাভাবিক। শিল্পীদের এত কিছু কান দিতে নেই। আমার গান গাইতে ভালো লাগে। আমি গেয়ে যাবো। মাঝে মাঝে অনেক টোন টিটকিরি খারাপ লাগলেও সহ্য করতে হয়। আমি যেখানে থাকি সেখানেই তো গান প্র্যাকটিস করতে গেলে অনেকে অভিযোগ করেন। গলা খুলে গান গাইতে পারি না। বাইরে রাস্তায় এসে গান গাইলে আমার গানের প্রশিক্ষণও হয়ে যায়। কয়েকজন শ্রোতাও পেয়ে যায়। রফি সাহেবের কিছু গান রয়েছে যেগুলো অন্তর থেকে নাড়া দেয়। গানগুলো গাওয়ার সময় চোখে জল চলে আসে নিজের দুঃখ কষ্ট সব যেন ভুলে যায়।" নিজের গান প্রসঙ্গে এমনই বললেন এস রাজ।

publive-image
সুরেলা কণ্ঠে মহম্মদ রফির গান গাইছেন এস রাজ। এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।

শিয়ালদহ স্টেশনে ট্রেন ধরার তাড়াহুড়ো ভুলে সত্যবাবুকে ঘিরে সর্বক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন জনা দশেক লোক। গান শুনে কেউ কেউ পকেট থেকে বের করে হাতে তুলে দেন কুড়ি, তিরিশ টাকা। এস রাজ গেয়ে চলেন নিজের মতো। লোকেদের মাঝেই এস রাজের গানের মঞ্চ। এই মঞ্চেই রফির গান গাওয়ার জন্য তিনি রোজই দাঁড়িয়ে পড়েন। সত্য রাজ গেয়ে শোনান, "লিখে যো খত তুঝে, ও তেরি ইয়াদ মে", "ইক না ইক দিন ইয়ে কাহানি বানেগি তুমেরি স্বপ্ন কি রানি বানেগি।"

kolkata news Sealdah Mohammed Rafi Satya Raj
Advertisment