জয় বাবা ফেলুনাথে ক্যাপ্টেন স্পার্কের র্যাক্সিটকে মনে পড়ছে? আরাম কেদারায় শুয়ে বেনারসের বাঙালি বাড়ির সেই প্রবীণ! কিংবা সোনার কেল্লার নকল মুকুলের দাদু! চিনতে পারছেন? ফেলুদা সিনেমা দুটি দেখে থাকলে তবে নিশ্চয় মনে থাকবে এই প্রবীণকে। সত্যজিতের অনেক ছবিতেই বারবার ওঁকে দেখা গিয়েছে। বাঙালি এই ভদ্রলোকটি ছিলেন সত্যজিতবাবুর অত্যন্ত পছন্দের মানুষ। যে কোনও কিছুর প্রয়োজনে তিনি ছুটে যেতেন এই প্রবীণের কাছেই। এই শহরে খুঁজলে সব কিছুই পাওয়া যায়। কোনও এক সময় এভাবেই হয়তো খুঁজতে খুঁজতে সত্যজিৎ রায় পেয়ে গিয়েছিলেন এই অমূল্য মানুষটিকে। ভবানীপুরের বাসিন্দা। শিল্পী এবং সংগ্রাহক বিমল চট্টোপাধ্যায়। সম্ভ্রান্ত, রুচিশীল, এক বাঙালি যার আদর্শ প্রতীক ছিলেন বিমলবাবু। তাঁর বাড়িটাই ছিল একটা আশ্চর্য এক সংগ্রহশালা।
বিখ্যাত সব সংগ্রাহকদের নামের তালিকা তৈরি করা হলে বিমল চট্টোপাধ্যায়ের নাম হয়তো সবার প্রথমে থাকবে। দুষ্প্রাপ্য বই, মুদ্রা, পোর্সিলিন, পুতুল, পেতলের বাসন, ফার্নিচার, মূর্তি, ডাকটিকিট, বিখ্যাত মানুষের চিঠি, চাবির রিং, বুকমার্ক, পেনসিল, দেশলাই— এমন সব দুষ্প্রাপ্য জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ঘর-দোর জুড়ে। যতদিন বেঁচে ছিলেন বিমলবাবু এসব নিয়েই ছিলেন। সত্যজিৎ রায় ছিলেন ওঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বিমলবাবুর মৃত্যুর পরে এসব সংগ্রহ সংরক্ষণের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন বিমলবাবুর উত্তরসূরি চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। চন্দ্রনাথবাবু নিজেও একজন লেখক এবং সংগ্রাহক। যদিও এই 'সংগ্রাহক' কথাটিতে আপত্তি রয়েছে চন্দ্রনাথবাবুর।
ওঁর কথায়, "বাবা যা কিছু রেখে গিয়েছেন, তা সযত্নে আগলে রাখছি। আমার নিজের টুকটাক কিছু সংগ্রহ করার নেশা আছে বটে। তবে সেগুলোর জন্যে নিজেকে সংগ্রাহক বলা চলে না।" বিমল চট্টোপাধ্যায়ের কনিষ্ঠ সন্তান চন্দ্রনাথ। এই চন্দ্রনাথ বাবুর উদ্যোগেই কলকাতার সংগ্রাহকরা সকলেই এক ছাতার তলায় জড়ো হতে পেরেছেন। বলা যেতে পারে, তিনি সংগ্রাহকদেরই সংগ্রহ করেছেন। তাঁর দলের নাম 'কলকাতা কথকতা'।
চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের ঘরে যেন অবলীলায় সময় দাঁড়িয়ে। টেবিলে, দেওয়ালে, তাকগুলোতে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে রয়েছে আঠারো ও উনিশ শতকের জীবন্ত ইতিহাস। সত্যজিৎ রায়ের ছবির পোস্টার। ফ্রেমে বাঁধানো বিমল চট্টোপাধ্যায়ের বিভিন্ন মুহূর্তের ছবি। দেওয়ালে ঝুলছে সত্যজিৎ সোনার কেল্লার পোস্টার। বিভিন্ন চিঠিপত্র দেখাতে গিয়ে চন্দ্রনাথ বলছিলেন, "আট থেকে আশি সকলেই বাবার বন্ধু ছিলেন। বাবা খুব আড্ডা দিতে ভালোবাসতেন। এরকমই এক আড্ডায় জয়পুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত প্যারাসাইকোলজিস্ট ডক্টর হেমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়েছিল। প্যারাসাইকোলজি নিয়ে চর্চা শুরু করেন। বিশেষ বন্ধু, প্রধান বিচারপতি প্রশান্তবিহারী মুখোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে ষাটের দশকের শেষভাগে কলকাতায় গড়ে তুললেন ‘পশ্চিমবঙ্গ প্যারাসাইকোলজিক্যাল সোসাইটি।’ সেই সমিতিরই আজীবন সদস্য হয়েছিলেন পরিচালক সত্যজিৎ রায়। থাকতেন উত্তম কুমারও।" প্যারাসাইকলজিকে কেন্দ্র করে ফেলুদার সোনার কেল্লার গল্প এভাবেই ফাঁদা হয়েছিল। সত্যজিৎ-এর এই কৌতূহলের পিছনে ছিলেন বিমলবাবু। তাঁর বাড়িতেই তিনি এই চর্চা করতেন সে সময়। সত্যজিৎ বাবু নিয়মিত সে চর্চার খোঁজ রাখতেন।
আরও পড়ুন- ‘তারার ছায়া’য় স্মৃতির সমাহার, অপূর্ব-কীর্তিতে চাগিয়ে উঠছে ইতিহাস-প্রেম
পুরনো ফার্নিচারগুলো এখনো অতীতের পুরনো দিনগুলোর সাক্ষী হয়ে রয়েছে। বলছিলেন, চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। "যে টেবিলটায় আমি লেখালেখি করি, এমন টেবিল এখন কারো কাছেই নেই। এসব এখন রক্ষণাবেক্ষণ করা খুব সহজ নয়। এমন অনেক জিনিস ঘরে রয়েছে যেগুলো বর্তমান সময়ে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আমার বাবা এসব খুব যত্ন করে আগলে রেখেছিলেন। আমি কতদিন পারব তা জানি না!" হেন কোনও বাদ্যযন্ত্র ছিল না যা বিমল চট্টোপাধ্যায় বাজাতে জানতেন না।
আরও পড়ুন- আদি থেকে আধুনিক, কলকাতার ‘ক্যামেরাম্যান’-এর জিম্মায় এক স্বর্ণালী ‘ইতিহাস’
সঙ্গীতজ্ঞ তারাপদ চক্রবর্তী, রাধিকামোহন মৈত্র, পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, ব্যারিস্টার বি.কে ঘোষ, অভিনেতা বিকাশ রায় ছিলেন বিমল চট্টোপাধ্যায়ের বন্ধু। শিল্প থেকে রাজনীতি, খেলা থেকে চিত্রশিল্পী, চলচ্চিত্র থেকে সংগীত, সমস্ত মানুষের সঙ্গেই ছিল সখ্যতা। বিমলবাবুর সংগ্রহগুলো আগলে রাখতে এসব জিনিসই ছোটবেলা থেকে চন্দ্রনাথকে ভীষণ প্রভাবিত করেছিল। সব মানুষের সঙ্গেই যে ভালো সম্পর্ক ছিল তার প্রমাণ, বিমল বাবুকে লেখা ব্যক্তিগত সংগ্রহে জমানো কয়েকশো চিঠি। এখনও যা যত্ন করে ফাইল বন্দী করে রেখেছেন চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়।
বিমল চট্টোপাধ্যায় মনে করতেন যা আজ নতুন কাল তা পুরনো। কোন জিনিসই ফেলার নয়। সত্যজিৎ রায়ের লেখা একটা চিঠি দেখানোর সময় চন্দ্রনাথবাবু বলছিলেন, "বাবাকে আমি দেখেছি। খাবারের ঠোঙ্গা পর্যন্ত খুঁটিয়ে দেখতেন। সেগুলোতেও তারিখ, সময় উল্লেখ করে লিখে রাখতেন। এতে বোঝা যায় কোন সময়ের জিনিস। তথ্য খুঁজে বের করাও অনেক সহজ হয়ে যায়।" বাসের টিকিট থেকে মুড়ির ঠোঙা, কিছুই ফেলা যেত না। সবই যোগ হত তাঁর সংগ্রহে। এই করে করেই ক্রমে গড়ে ওঠে তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা। সেখানে পুরনো মূর্তি থেকে শুরু করে পুঁথি, চিঠিপত্র কী নেই। সবই অ্যান্টিক হিসেবে সযত্নে রেখেছেন।
আরও পড়ুন- গভীর পরিকল্পনা, স্কুলে তাণ্ডবে বন্দুক পেলেন কোথায়? নিজেই রহস্য ফাঁস বন্দুকবাজের
সত্যজিৎ রায় নিজের শুটিংয়ের সেটে ব্যবহারের এজন্যে এমন অনেক পুরনো জিনিসই চেয়ে পাঠাতেন। এরমধ্যে অন্যতম জয় বাবা ফেলুনাথের ডিম্বাকৃতি তাস! যা বেশ অবাক করে দিয়েছিল সত্যজিৎ রায়কে। এছাড়াও এক বার ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’-র সময়ে পুরনো বইয়ের প্রয়োজন পড়েছিল সত্যজিৎবাবুর। শুধু পুরনো হলে হবে না, হতে হবে ‘প্রিন্টেড বিফোর ১৮৫৭’! তেমন বই ছিল বিমলবাবুর সংগ্রহে। ফলে এই ছবির জন্যে বেশ কিছু বই পাঠানো হয়েছিল শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’-র সেটে।
আরও পড়ুন- কলকাতার এই প্রবীণ সংগ্রহ করেন উনিশ শতকের অমূল্য সব ‘সুচ-সুতোর’ ভালোবাসা
সেলফে লাইন ধরে সাজানো সব বই। পুরনো কাঠের শোকেজে রাখা সব পুরনো অ্যান্টিক জিনিস। এসব দেখতে দেখতে ঘণ্টা তিন চারেক সময়ও অনেক কম মনে হয়। চন্দ্রনাথবাবু বলছিলেন, "সংগ্রহের মাত্র এক অংশ দেখাতে আর গল্পগুলো বলতেই এত সময় চলে গিয়েছে। বাবার সংগ্রহের শুধু বইগুলো দেখাতে গোটা একটা দিন কেটে যাবে। অন্য কোনও একদিন এই বই নিয়ে গল্প হবে। সংগ্রহে এমন কত জিনিস আছে যা দেখিয়ে শেষ করা যাবে না। বাবার সব জিনিস আমি আগলে রেখেছি। এর ভবিষ্যৎ কী হবে জানা নেই! আমার ছেলে মেয়েরা সকলেই এখন কাজ নিয়ে ব্যাস্ত। বর্তমান যুগে, কাজের শেষে এসবের পিছনে সময় দেওয়া খুব কঠিন।"
আরও পড়ুন- সংগ্রহ নয়, ওনার ঘরদোর জুড়ে শুধু ‘কালি এবং কলমে’র প্রেম
দিনে দিনে সংগ্রহের সংজ্ঞা বদলেছে। একেক জন সংগ্রাহকের একেক রকম সংগ্রহের নেশা। সংগ্রাহকেরা নিজেদের কাছে ইতিহাসকে ধরে রাখছেন। পুরনোর সঙ্গে তৈরি করছে নতুনের মেলবন্ধন। অতীতে যা ছিল সহজ, তা আজ দুর্মূল্য! ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব সংগ্রাহকদেরই এক ছাদের তলায় নিয়ে এসেছেন চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন একেক রকম সংগ্রহের সঙ্গে। অনেক সংগ্রাহকেরই খোঁজ রয়েছে চন্দ্রনাথের কাছে। সংগ্রহের বদলে তিনি সংগ্রহ করে রেখেছেন সংগ্রাহকদেরই। এরকম চিন্তা ভাবনা একমাত্র বিমল চট্টোপাধ্যায়ের সুযোগ্য সন্তানই করতে পারেন। চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়কে বর্তমানে কলকাতার সংগ্রাহকদের একমাত্র জলজ্যান্ত এনসাইক্লোপিডিয়া বলা যেতে পারে। যার কাছে ইতিহাসের পাতা ওল্টালেই মিলবে সব কিছু।