scorecardresearch

জগৎ মুখার্জি পার্কের পাহারাদারের হাতে গড়া ‘বইবাগান’

জগৎ মুখার্জি পার্কে প্রায় এক দশকের বেশী সময় ধরে চলছে সত্যরঞ্জনের লাইব্রেরিটি

book garden, garden book at kolkata, jagat mukherjee park, jagat mukherjee park book garden, kolkata news, news on kolkata
জগৎ মুখার্জি পার্কের একজন সিকিউরিটি গার্ড গড়েছেন বইবাগান

বাগবাজারের থেকে সোজা শোভাবাজার দিকে যেতে ডান হাতে পড়বে জগৎ মুখার্জি পার্ক। কলকাতা শহরের আর পাঁচটা পার্ক থেকে এটি সম্পূর্ণ অন্যরকম। সকাল থেকে রাত ভেসে আসে গানের সুর। এখানে গাছেদের পাশে জায়গা করে নিয়েছে সারি সারি বই। মেইন গেট দিয়ে ঢুঁকেই প্রথমে চোখে পড়বে ছাউনি দেওয়া ‘পাথর ঘর’। বসে থাকা লোকজন উল্টে দেখেছে সেসব বইয়ের পাতা। ‘লাইব্রেরী’ বললে খুব একটা ভুল হবে না। যদিও গ্রন্থাগার বললে সচরাচর চোখের সামনে যে ছবি ভেসে ওঠে সেসব থেকে এটি ঢের আলাদা। চারপাশ খোলামেলা। দুদিকেই আসা যাওয়া করা যায়।

book garden, garden book at kolkata, jagat mukherjee park, jagat mukherjee park book garden, kolkata news, news on kolkata
পার্কে বসে আড্ডা দেওয়ার পাশাপাশি রয়েছে বাগান গ্রন্থাগার- এক্সপ্রেস ফটো – শশী ঘোষ

একদিকের সেলফে রাখা পাঠ্য বই। অন্যদিকে বিভিন্ন রকম গল্পের বইয়ের পাশাপাশি নানা রকম ম্যাগাজিন খবরের কাগজ। পার্কে বসে আড্ডা দেওয়ার পাশাপাশি চাইলে এখানে বইও পড়া যায়। তার কারণ এর নাম ‘বাগান গ্রন্থাগার’। শুনতে অবাক লাগলেও বাস্তবে এমনটাই জগৎ মুখার্জী পার্ক। এই বাগান লাইব্রেরি তৈরির নেপথ্যে যে কারিগর তার নাম সত্যরঞ্জন দোলুই। জগৎ মুখার্জি পার্কের একজন সিকিউরিটি গার্ড।

book garden, garden book at kolkata, jagat mukherjee park, jagat mukherjee park book garden, kolkata news, news on kolkata
কলকাতা পুরসভার আট নম্বর ওয়ার্ডের অভিনব প্রয়াস- এক্সপ্রেস ফটো – শশী ঘোষ

কলকাতা পুরসভার আট নম্বর ওয়ার্ডের এই পার্কটিতে শরীরচর্চার সঙ্গে চলে জ্ঞান চর্চাও। সুন্দরবনের পাথর প্রতিমার এক ছোট্ট গ্রামে বাড়ি ছিল সত্যরঞ্জনের। ছোট থেকেই তাঁর পড়াশুনার প্রতি ঝোঁক। অর্থের অভাবে পুঁথিগত বিদ্যা বেশী এগোতে পারেনি। ক্লাস টেন পাশের পড়েই পড়াশুনার পাঠ চুকিয়ে চলে আসে কলকাতায়। ভর্তি হয়ে যায় কম্পিউটার ক্লাসে। এখানেই ২০০০টাকা বেতনে জুটে যায় ডাটা এন্ট্রির চাকরি। এই অল্প টাকাই কী আর সংসার চলে! ২০১০ সালে ডাটা এন্ট্রির চাকরি ছেড়ে ২৮০০টাকা বেতনে যোগ দিলেন জগৎ মুখার্জি পার্কের নিরাপত্তারক্ষীর কাজে। ২০১১ সাল থেকে শুরু করলেন পার্কে ম্যাগাজিন রাখা। তারপর ধীরে ধীরে রাখতে শুরু করলেন বই। একের পর এক বই জমিয়ে তৈরি করে ফেললেন ছোটখাটো একটি লাইব্রেরি।

book garden, garden book at kolkata, jagat mukherjee park, jagat mukherjee park book garden, kolkata news, news on kolkata
ফেলুদার বই থেকে আবার ইংরেজি গ্রামার, চাইলেই সবই পেয়ে যাবেন এখানে।- এক্সপ্রেস ফটো – শশী ঘোষ

 জগৎ মুখার্জি পার্কে প্রায় এক দশকের বেশী সময় ধরে চলছে সত্যরঞ্জনের লাইব্রেরিটি। পার্কের ভেতর থরে থরে সাজানো খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন, বই। রবীন্দ্র রচনাবলী থেকে শরৎ সমগ্র। ফেলুদার বই থেকে আবার ইংরেজি গ্রামার। চাইলেই সবই পেয়ে যাবেন এখানে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মানুষজন আসছে যাচ্ছে। কেউ বই পড়ছেন, কেউ উল্টে দেখছেন খবরের কাগজ। সকাল সন্ধ্যে বেজে চলেছে গান। কিশোরকুমার থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত। না আছে কোনও নিয়মকানুন। না আছে কোন নাম লেখালেখি, না প্রয়োজন লাইব্রেরি কার্ডের। এমনকি নেই লাইব্রেরির কোনও দরজা-জানলাও।

book garden, garden book at kolkata, jagat mukherjee park, jagat mukherjee park book garden, kolkata news, news on kolkata
পাড়ার বাসিন্দারা তো বটেই অভিভাবকেরাও এসে জড়ো হন পার্কে – এক্সপ্রেস ফটো – শশী ঘোষ

সত্যেরঞ্জনের জীবনচক্র আবর্তিত হয় তিনটি জিনিস নিয়ে, গাছ, ফুল আর বই। এসব জিনিস সঙ্গী করে যে দিব্যি ভালো থাকা যায় ওনাকে না দেখলে হয়তো কেউ বিশ্বাস করবে না। এই লাইব্রেরি তৈরি করা নিয়ে সত্যে বলছিলেন, “সকাল সন্ধ্যা শরীর সুস্থ রাখতে পার্কে অনেকেই হাঁটতে আসেন। আশেপাশে রয়েছে অনেক স্কুল। পাড়ার বাসিন্দারা তো বটেই অভিভাবকেরাও এসে জড়ো হন পার্কে। গল্পগুজব এ সময় নষ্ট হয়। এসব দেখেই গ্রন্থাগার তৈরির ভাবনা মাথায় আসে। তারপর থেকে শুরু করি বই জমানো। স্থানীয়রা অনেকেই আমার ভাবনা চিন্তা দেখে সাহায্যের জন্যে এগিয়ে আসে। কেউ বই, কেউ ম্যাগাজিন দিয়েছেন আমার লাইব্রেরিতে। বই পড়ার পাশাপাশি গান শুনতে ভালো লাগে তার জন্যে এখানে সারাদিন গান চালিয়ে রাখার ব্যবস্থা করি। বই না পড়লেও অনেকে এখানে গান শোনার জন্যেও বসে থাকেন”।

book garden, garden book at kolkata, jagat mukherjee park, jagat mukherjee park book garden, kolkata news, news on kolkata
সত্যরঞ্জনের পাঠাগারে বিনামূল্যে বই মেলে। -এক্সপ্রেস ফটো – শশী ঘোষ

বর্তমানে দলুইয়ের মাসিক বেতন ৮২০০টাকা। এর মধ্যেই টাকা বাঁচিয়ে কিনেছেন আলমারি,বইয়ের তাক, ফ্যান। পরিপাটি করে গোছানো বইয়ের সংসার। সকাল থেকে রাত এই নিয়েই আছেন। সত্যরঞ্জনের পাঠাগারে বিনামূল্যে বই মেলে। চাইলে বাড়িও নিয়ে যাওয়া যায় পড়ার পাঠ্য বই। পুরোটাই বিশ্বাসের উপর। যদিও বিশ্বাস করে বই পড়তে দেওয়ার পর অনেকবারই বই চুরি হয়েছে। বই পাহাড়া দেওয়ার জন্যে সত্যের সঙ্গে রয়েছে টাইগার এবং স্কুবি নামে দুটো কুকুরও। রাতের বেলার এরাই বই পাহার দেয়। এখন বহু মানুষ নিয়মিত নানা সময়ে এসে বই পড়েন।

book garden, garden book at kolkata, jagat mukherjee park, jagat mukherjee park book garden, kolkata news, news on kolkata
ফুল, গাছ, বই এই নিয়ে দিব্যি ভালো আছেন জগৎ মুখার্জি পার্কের এই পাহারাদার – এক্সপ্রেস ফটো – শশী ঘোষ

একসময় বাগবাজার এলাকায় অনেক প্রাচীন গ্রন্থাগার ছিল। তার মধ্যে অনেকগুলোই বন্ধ হয়ে যাওয়ার মুখে। স্মার্টফোনের যুগে এখন কেউ আর বই সেভাবে পড়তে চাইনা। একটা পার্কের সিকিউরিটি গার্ডের তৈরি লাইব্রেরিতে বাচ্চা থেকে বুড়ো সকলে একবার হলেও উল্টে দেখেন বইয়ের পাতা। কেউ বসলেই সত্যেরঞ্জন এগিয়ে দেয় বই। বই আনতে সাইকেল চালিয়েই চলে যান উত্তর কলকাতা থেকে দক্ষিণ কলকাতায়। বিভিন্ন জনের দেওয়া বই হাতে নিয়ে ফিরে আসেন লাইব্রেরিতে। কোথাও পুরনো বই বিক্রি হচ্ছে শুনলে পৌঁছে যান সেই জায়গায়। নিজের স্বল্প উপার্জন থেকে জমানো টাকা দিয়ে কিনে ফেলেন সেসব বই। বাইরে বারান্দা জুড়ে ফুল এবং পাতাবাহারি গাছ। একটা গাছের ঢাল থেকে তৈরি করে নেন আরেকটি গাছ। পার্কে ঘুরতে আসা অনেকের হাতেই তুলে দেন সেসব চারা গাছ। পার্কের ছাউনি দেওয়া ঘরে দিনে দিনে বাড়ছে বই বাগান। আর বাইরে ফুল বাগান। ফুল, গাছ, বই এই নিয়ে দিব্যি ভালো আছেন জগৎ মুখার্জি পার্কের এই পাহারাদার।  

Stay updated with the latest news headlines and all the latest Westbengal news download Indian Express Bengali App.

Web Title: Security guard made book garden at jagat mukherjee park area