রাজ্যে ৩৫৫ ধারা জারি করানোর মত পরিস্থিতি তৈরির চক্রান্তে সিপিএমও কি তলে তলে বিজেপির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে? এই প্রশ্নেই এখন তোলাপাড় পূর্ব বর্ধমানের জামালপুর। এমন প্রশ্ন ওঠার পিছনে যে কারণ উঠে এসেছে, সেটাও যথেষ্ট চমকে দেওয়ার মতই। পঞ্চায়েত ভোটের প্রাক্কালে তৃণমূলকে ফাঁসাতে নিজেদের পার্টি কর্মীকে দিয়েই বাড়িতে বোমা মারিয়েছিলেন সিপিএমের প্রার্থী দম্পতি। এমনটাই অভিযোগ উঠেছে। পুলিশের বক্তব্য, গ্রেফতার হওয়ার পর সিপিএম কর্মী রাম সরকার নিজেই পুলিশের কাছে এই গোটা পরিকল্পনার কথা ফাঁস করে দিয়েছেন। আর তা জানতে পেরেই ঘরবাড়ি ছেড়ে বেপাত্তা হয়ে গিয়েছে সিপিএমের প্রার্থী দম্পতি সুশান্ত মণ্ডল ও দেবিকা দেবনাথ।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে,এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে জামালপুর ১ পঞ্চায়েতের ১৪১ নম্বর বুথে সিপিএমের প্রার্থী ছিলেন সুশান্ত মণ্ডল। আর তাঁর স্ত্রী দেবিকা দেবনাথ একই পঞ্চায়েতের ১৩৯ নম্বর বুথে সিপিএমের প্রার্থী ছিলেন। এই দম্পতির বাড়ি জামালপুরের উত্তর মোহনপুর গ্রামে। একই গ্রামে বসবাস করেন পেশায় ফুচকা বিক্রেতা রাম সরকার। সিপিএম প্রার্থী দম্পতির ভোটের প্রচার, দেওয়াল লিখন-সহ নানা কাজে উত্তর মোহনপুর ও তার সংলগ্ন জামালপুর ২ গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার বেশকিছু সিপিএম কর্মী ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তাঁদেরই মধ্যে রাম সরকার অন্যতম।
তৃণমূল কংগ্রেস আশ্রিত দুষ্কৃতীরা রাতের অন্ধকারে তাঁদের বাড়িতে বোমা মেরেছে, এমন অভিযোগ এনে গত ২৫ জুন সকাল থেকে তোলপাড় ফেলে দেন সিপিএম প্রার্থী দম্পতি। ওইদিনই পার্টির প্যাডে সিপিএম জামালপুর ১ এরিয়া কমিটির সম্পাদক সুকুমার মিত্র জামালপুর থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। সেই অভিযোগে তিনি দাবি করেন, 'রাতের অন্ধকারে তাঁদের দলের প্রার্থী দম্পতির বাড়িতে বোমা ছুড়ে মেরেছে তৃণমূল কংগ্রেস আশ্রিত স্থানীয় দুষ্কৃতীরা।'
পুলিশকে সুকুমার মিত্র এ-ও বলেন, 'তাঁদের প্রার্থী দম্পতি সুশান্ত মণ্ডল ও দেবিকা দেবনাথের বাড়িতে তিনটি বোমা ছোড়া হয়েছিল। তার মধ্যে দুটি বোমা ফাটেনি, একটি ফেটেছে।' এই ঘটনায় সিপিএম নেতা সুকুমার মিত্র জামালপুর ১ পঞ্চায়েতের একটি বুথে প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূল প্রার্থীর স্বামী এবং তার এক সহযোগীকে নিশানা করেন। সিপিএম প্রার্থী দম্পতিও ওই দিন সংবাদমাধ্যমের কাছে একই অভিযোগ দায়ের করেছিলেন।
সিপিএম নেতার কাছ থেকে এমন অভিযোগ পেয়ে নড়েচড়ে বসেছিল জামালপুর থানার পুলিশ। মামলা রুজু করে পুলিশ তদন্তে নেমেছিল। তদন্তে পুলিশ খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, উত্তর মোহনপুর গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে রাম সরকার নামে ২৯ বছর বয়সি এক যুবক ২৪ জুন অনেক গভীর রাতে বাড়ি ফিরেছিল। এরপরই পুলিশ রাম সরকারের ব্যাপারে খোঁজ-খবর নেওয়া শুরু করে বেশ কিছু 'ক্লু' পায়।
পঞ্চায়েত ভোটের গণনা পর্ব মিটলে ১৬ জুলাই রাতে পুলিশ রাম সরকারকে পাকড়াও করে থানায় নিয়ে জেরা শুরু করে। পুলিশের বক্তব্য, জেরার সন্মুখীন হয়েই সিপিএম কর্মী রাম সরকার তাঁর এবং সিপিএম প্রার্থী দম্পতির করা 'গেমপ্ল্যান ফাঁস করে দেয়। পুলিশ জনিয়েছে, ধৃত রাম সরকার জেরায় কবুল করেছে যে পঞ্চায়েত ভোটের নমিনেশন জমা দেওয়ার পর্ব শুরুর আগে একরাতে সুশান্ত ও দেবিকার বাড়িতে ৪-৫ জন এসেছিল। তারা কেউ জামালপুরের বাসিন্দা নয়। অন্য জেলার লোক। ওই ব্যক্তিরা ওই দিন সুশান্ত ও দেবিকাদের বাড়িতে রাত কাটায়। ওইসব ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়েই তৃণমূলকে ফাঁসানোর পরিকল্পনা চুড়ান্ত করে ফেলেছিল দেবিকা ও সুশান্ত। সেই পরিকল্পনা সফল করতে রাম সরকারকেই বেছে নিয়েছিল দেবিকা ও তাঁর স্বামী সুশান্ত।
গত ২৪ জুলাই রাতে পরিকল্পনামাফিক জামালপুরে সিপিএম পার্টি অফিসের অদূরে দোলরডাঙা এলাকায় মাংস-ভাত চড়ুইভাতির আয়োজন করেছিল সিপিএম প্রার্থী দম্পতি। তার কাছে-পিঠেই চলছিল রাত্রিকালীন ক্রিকেট প্রতিযোগিতা। সেইখানে রাতে ফুচকা বিক্রির স্টল বসিয়েছিল রাম। রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ সুশান্ত মণ্ডল প্ল্যাস্টিকের প্যাকেটে মুড়ে তিনটি বোমা রাম সরকারকে দিয়েছিল এবং সেগুলো কী করতে হবে, সেটা জানিয়েছিল।
রাম সরকার বোমাগুলো ফুচকার ট্রলিগাড়িতে গোপন জায়গায় রেখে দিয়েছিল। রাত পৌনে ২টো নাগাদ বোমা-সহ ফুচকার গাড়ি নিয়ে রাম সরকার উত্তর মোহনপুরে তাঁর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল। দেবিকাদের বাড়ির কাছেই বাড়ি রাম সরকারের। ফুচকার গাড়িটি নিজের বাড়ির দরজার কাছে দাঁড় করিয়ে রেখে রাম সরকার পরিকল্পনা-মত ওই রাতেই সিপিএম প্রার্থী দম্পতির বাড়িতে গিয়েছিল। তাদের বাড়ির উঠোনের দু’জায়গায় দুটি বোমা ফেলে রেখেছিল। এরপর সে সিপিএম প্রার্থী দম্পতির বাড়ির বাইরে বেরিয়ে গিয়ে একটি বোমা তাদের বাড়িতে ছুড়ে মারে। বিকট শব্দে বোমাটি ফাটার সঙ্গে সঙ্গেই রাম সরকার ছুটে নিজের বাড়িতে গিয়ে ঢুকে পড়েছিল। আর, পরিকল্পনামাফিক বোমা ফাটার পরেই সিপিএম প্রাথী দম্পতি চিৎকার-চেঁচামেচি করে পাড়া মাতিয়ে তুলেছিল। এমনটাই দাবি পুলিশের।
জেরায় রাম সরকার একথা কবুল করার পরেই পুলিশ এক্সপ্লোসিভ অ্যাক্টে তার বিরুদ্ধে মামলা রুজু করে ওই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে। সোমবার ধৃতকে পেশ করা হয় বর্ধমান আদালতে। ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী ও বোমা সরবরাহকারীদের নাগাল পেতে তদন্তকারী অফিসার ধৃতকে ১০দিন নিজেদের হেপাজতে নিতে চেয়ে আদালতে আবেদন জানিয়েছিল। বিচারক ধৃতের ৭ দিনের পুলিশ হেফাজত মঞ্জুর করেছে।
রাম সরকারকে হেফাজতে নিয়ে পুলিশ এরপর সিপিএম প্রার্থী দম্পতির খোঁজে বেরিয়ে পড়েছে। এই বিষয়ে জামালপুর ব্লক তৃণমূলের সভাপতি মেহেমুদ খান বলেন, 'রাজ্যে ৩৫৫ ধারা জারি করানোর মত পরিস্থিতি তৈরির চক্রান্তে সিপিএমও নিশ্চয়ই তলেতলে বিজেপির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে। তাই সিপিএমের প্রার্থী দম্পতি পরিকল্পনা করে সিপিএমের কর্মীকে দিয়ে নিজেদের বাড়িতে বোমা মারিয়েছে। আর, তৃণমূলের নামে দোষ চাপিয়ে থানায় অভিযোগ দায়ের করেছে। আর এই সিপিএমই ভোট গণনার দিন অজস্র তির-ধনুক,টাঙি,
তরোয়াল নিয়ে হাজির হয়েছিল। আসলে হিংসা আর খুনের রাজনীতি ছাড়া সিপিএমের কোনও নীতি নেই। এসবের জন্যই জামালপুরের মানুষ সিপিএমকে প্রত্যাখ্যান করেছে।'
আরও পড়ুন- ভোজের রাজনীতিতে বিরোধীদের দ্বিতীয় বৈঠক, কড়া নজর রেখে বিজেপিও পালটা বৈঠকের পথে
পালটা সিপিএম নেতা সুকুমার মিত্র এদিন বলেন, 'আদালতের বিচারাধীন বিষয় নিয়ে কোনও মন্তব্য করব না। তবে যা শুনছি, ঘটনা যদি তাই হয়, তবে আমরা আমাদের পার্টির পক্ষ থেকে এবিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেব।' সিপিএম নেতা এমনটা বললেও, ধৃত সিপিএম কর্মী রাম সরকারের স্ত্রী জয়ন্তী সরকার সোমবার অভিযোগ করেন, 'সিপিএম প্রার্থী দম্পতি সুশান্ত মণ্ডল ও দেবিকা দেবনাথ তাঁদের পরিকল্পনা সফল করতে আমার স্বামীকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে।'