Advertisment

মুক্তারামের মেসে, শুক্তারাম খেয়ে বন্ধ হল শিবরামের মেস বাড়ির দরজা, ঘুণাক্ষরেও জানল না কেউ!  

ভিতরে যাওয়ার সব রাস্তায় বন্ধ। এক বুক অন্ধকার নিয়ে দাড়িয়ে রয়েছে শিবরামের আদরের মেসবাড়ি।

author-image
Shashi Ghosh
New Update
kolkata mess rent, mess kolkata west bengal, mess in kolkata for male, mess meaning in bengali, shibram chakraborty, byomkesh bakshi

পুরনো এই বাড়ির গায়ে শেষ দু-তিন দশক মেরামতের জন্যে কোন হাত পড়েনি। না পড়েছে বালি, সিমেন্টের কোন আস্তরণ

এঁদো গলির ভিতর স্যাঁতস্যাঁতে রাস্তা। হাড়গোড় বের করা শীর্ণকায় বাড়িটির খসে পড়া কার্নিশ। নাম "ক্ষেত্র কুঠি মেসবাড়ি!"। যদিও কলকাতা শহরে এই নামে কোথাও কোন হোর্ডিং নেই। এই বাড়িটি খুঁজে পেতে হলে আসতে হবে মুক্তারাম বাবু স্ট্রিট। ১৩৪ নম্বর ঠিকানা খুঁজতে খুঁজতে একে তাঁকে জিজ্ঞেস করে যখন জরাজীর্ণ বাড়িটিতে এসে ধাক্কা খাবেন তখনই বুঝে যাবেন এই সেই মেসবাড়ি। যেখানে 'মুক্তারামে থেকে, তক্তারামে শুয়ে, শুক্তারাম খেয়ে' শিবরাম লিখে ফেলতেন একের পর এক রম্য রচনা! যদিও এখন মেসবাড়িটি আছে তবে নেই কোন আবাসিক! আতস কাচ দিয়ে খুঁজলেও কেউ পাবে না শিবরামের কোন চিহ্ন। মাস দুয়েক আগেও দু-চারজন কর্মজীবী মানুষের বাসস্থান ছিল এই মেসবাড়িটি। নববর্ষের এক সপ্তাহ আগে। চলতি মাসের ৮ তারিখ থেকে তালা পড়েছে। ভিতরে যাওয়ার সব রাস্তায় বন্ধ। এক বুক অন্ধকার নিয়ে দাড়িয়ে রয়েছে শিবরামের আদরের মেসবাড়ি।

Advertisment
kolkata mess rent, mess kolkata west bengal, mess in kolkata for male, mess meaning in bengali, shibram chakraborty, byomkesh bakshi
শিবরামের জরাজীর্ণ মেসবাড়ি - এক্সপ্রেস ফটোঃ শশী ঘোষ

তিনতলা বাড়ির পলেস্তারা খসে পড়েছে। বারান্দা উধাও। বেরিয়ে রয়েছে লোহার কাঠামো। বাড়িটির সামনে হাড় পাঁজর বের করা ইটগুলোর গায়ে লাগানো দড়িতে ঝুলে কাপড় জামা। বাড়িটির সামনে এসে দাঁড়ালে স্থানীয়রাই বলে দিচ্ছে, বিপদজনক বাড়ি। যে কোনও সময় ভেঙ্গে পড়তে পারে! এই বাড়িরই দোতলার মাঝের ঘরটি ছিল শিবরাম চক্রবর্তীর। দেওয়ালে প্রচুর আঁকিবুঁকি। বিভিন্ন লোকের নাম ও ঠিকানা। লেখার কালি দেখেই নাকি শিবরাম বুঝে যেতেন কে তাঁর কাছে টাকা পায়। সংসারে টাকা পয়সার টানা হ্যাচড়া ছিল তাঁর বরাবরই। তাও যেন জীবনে রসিকতার অভাব ছিল না। দেনা পাওনার হিসেব যে কেউ এভাবে রাখতে পারে শিবরামের লেখা না পড়লে হয়তো জানা যেত না। এত সব হিসেব নিকেশ মনে রাখতে রাখতে বাড়িটি বয়সের ভারে এখন নুয়ে পড়েছে। মেসবাড়ির সদর দরজায় পড়েছে তালা। যে বাড়ির ইট, কাঠ সিমেন্টের বুকেও লেখকের স্মৃতি জড়িয়ে আছে তাকে বাঁচানোর তাগিদ এখন যেন কারো নেই। পুরনো এই বাড়ির গায়ে শেষ দু-তিন দশক মেরামতের জন্যে কোন হাত পড়েনি। না পড়েছে বালি, সিমেন্টের কোন আস্তরণ। এর মাঝেই চুপিসারে লেখা হয়ে গেল মৃত্যু পরোয়ানা। কেউ ঘুণাক্ষরেও জানলো না।

এই বাড়িরই কাছাকাছি থাকেন মহম্মদ আরমান। তিনি বলছিলেন, "এই বাড়ি ভেঙ্গে কিছুদিন পর তৈরি হবে ফ্ল্যাট। আমার বয়স তখন পাঁচ-ছ বছর হবে। এখানে একজন লেখক থাকতেন। তখন ঘরের সামনে বারান্দা ছিল। বারান্দাটি বেশ অনেক বছর হয়েছে ভেঙ্গে পড়ে গিয়েছে। উনি সেই বারান্দায় এসে আমাদের ডাকতেন। আমরা সবাই এসে জড়ো হলে রুটির মধ্যে চিনি দিয়ে রোল করে আমাদের দিতেন। এই খাবার আমাদের সকলের প্রিয় ছিল। ছোটদের ভীষণ ভালোবাসতেন। ওনার ঘরটা ভেঙ্গে ফেলা হবে শুনে খারাপ লাগছে। ওনার আর কোন স্মৃতি এখানে নেই।" গত ৮ এপ্রিলই বৃদ্ধ জীর্ণ বাড়িটিতে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। বোর্ডাররা যারা ছিলেন তারা যে যাঁর মতন সব ছিটকে গিয়েছেন। বিপদজনক বাড়ি বলে মুখে মুখে ছড়িয়ে গেলেও কোনরকম বোর্ড চোখে পড়ে না। এই বাড়ি ভাঙা হবে তার জন্যেই হয়তো সবার অজান্তে তালা ঝুলছে গেটে। বাড়ির যা অবস্থা তাতে ভাঙা না হলেও অবশ্য এমনিই ভেঙে পড়বে! কলকাতায় এমন কত পুরনো বাড়ি আছে যেগুলো সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হয় না বলে প্রায়ই ভেঙ্গে পড়ে। কিন্তু এক কালে এই বাড়ির দোতলার ঘরে বসেই একের একের পর এক অফুরান হাস্যরসাত্মক গল্প সৃষ্টি করে গিয়েছেন হাস্যরসের অন্যতম এই জাদুকর। ধীরে ধীরে কলকাতার একটি পাড়া আধা-অবাঙালি হয়ে উঠলেও এখনো বয়স হয়ে যাওয়া লোকেরা মনে রেখে দিয়েছে এই বাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা লোকটার নাম।

kolkata mess rent, mess kolkata west bengal, mess in kolkata for male, mess meaning in bengali, shibram chakraborty, byomkesh bakshi
বছরখানেক আগে তোলা এই ছবি। এইঘরেই থাকতেন শিবরাম চক্রবর্তী। - এক্সপ্রেস ফটোঃ শশী ঘোষ

সরু, লম্বা, আধো-অন্ধকার একটা গলি। গলি দিয়ে সোজা ঢুকে গেলেই ইটের পাঁজর বের করা সিঁড়ি। এর পাশেই সারিবদ্ধ ভাবে ছোট্ট রুমগুলো। প্রত্যেক ঘরে চৌকি পাতা। চুনকাম করা দেওয়ালে অজস্র হিজিবিজি। হ্যাঙ্গারে ঝোলে জামা প্যান্ট। দু-তিনতলা বাড়িগুলোর কোথাও পলেস্তারা খসে পড়েছে, আবার কোথাও বারান্দা উধাও। তবে কলকাতার মেসবাড়ির শুরুটা ঠিক এমনই ছিল কি? তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ। শুরু শহরের মেসবাড়ির কালচার। শিক্ষিত বাঙালি কাজের খোঁজে জেলা থেকে আসতে শুরু করেছেন কলকাতায়। অবশ্য এর আগেও কেরানিগিরির সুবাদে গ্রাম থেকে কলকাতা মুখো হয়েছিলেন কিছু নব্যযুবক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর কলকাতায় মেসবাড়ির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় মাথার উপর ছাদের আর চিন্তা রইল না।

এরকমই কোন এক সময়ে তল্পিতল্পা নিয়ে উত্তর কলকাতার 'ক্ষেত্র কুঠি' মেসবাড়িতে হাজির শিব্রাম (নিজের নামের বানান এভাবেই লিখতেন) চক্রবর্তী। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের প্রেরণায় জড়িয়ে পড়লেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে। তখন শিবরাম চক্রবর্তী এই মেসেরই আবাসিক। খবর পেয়ে কলকাতার তৎকালীন কুখ্যাত পুলিশকর্তা চার্লস টেগার্ট একবার হানাও দিয়ে ফেলেছেন এই মেসটিতে। কিন্তু একবারের জন্যও মেস ছাড়ার কথা ভাবেনি। মুক্তারাম স্ট্রিটের এই মেস হয়ে উঠেছিল কলকাতার বুকে শিব্রামের স্থায়ী বাসস্থান। কপালের এক কোণায় জড়ুল, পরনে খদ্দেরের পাঞ্জাবী, সাধা ধুতি সাদাসিধে লোকটা রসের ভাণ্ডারে এতটাই টইটম্বুর ছিলেন ওনার সাথে যারাই মিশেছেন তারাই জানেন। তার জন্যেই হয়তো তিনি মেসবাড়িতে বসেই হাসির রামধনু সহজেই রচনা করতে পারতেন। একটি এরকমই একটা ঘটনার কথা না বললেই নয়, "মুক্তারাম স্ট্রিটের এই মেসবাড়িতেই একদিন চোরের উপদ্রব শুরু হল। অবশ্য উপদ্রব হয়তো ঠিক বলা যায় না, কারণ চোর এসেছিল একদিনই আর সেটাও স্বয়ং শিবরাম চক্রবর্তীর ঘরে। চোর এসে তো হতভম্ব, একি অবস্থা! নেবার মতো যে কিছুই নেই। অন্যদিকে শিবরামবাবু তখন ছিলেন না ঘরে, ফিরে এসে দেখেন বালিশের উপর দশ টাকার একটি নোট আর একটি চিরকুট। সেই চিরকুটে লেখা - ঘরে তো নেবার মতো কিছুই নেই, এই দশটা টাকা রেখে গেলুম, এই দিয়ে ধুপকাঠি কিনে তা ফেরি করুন।" নিজের সংসারে অভাব ছিল। মাঝে-মাঝেই ধার করতে হতো। সেটা নিয়েও রসিকতা করে কাটিয়ে দিয়েছেন শিবরাম। দোতলার যে ঘরে লেখক শেষ পর্যন্ত ছিলেন, সেখানেই ঘরের বোর্ডাররা ঠিক করেছিলেন একটা ট্রাস্ট করবেন। নামও ঠিক করা হয়েছিল 'শিবরাম চক্রবর্তী ট্রাস্ট'। যদিও ট্রাস্ট আর হয়ে ওঠেনি। স্মৃতি হিসেবে পড়েছিল শুধু ঘরটায়।

kolkata mess rent, mess kolkata west bengal, mess in kolkata for male, mess meaning in bengali, shibram chakraborty, byomkesh bakshi
মেসবাড়ির নীচে একসময় দোকান ছিল, তাও এখন বন্ধ। - এক্সপ্রেস ফটোঃ শশী ঘোষ

খুব মন খারাপে শিবরামের লেখা পড়ে হো হো করে হাসেনি এমন বাঙালি হয়তো হাতেগোনা। মানুষ হাসতে ভুলে যাচ্ছে। লাফিং ক্লাবের গায়ের জোরে কৃত্রিম হাসিটি অবশ্য আছে। বাংলা সিনেমাতেও খুনোখুনি, দীর্ঘশ্বাস, প্রেম, যৌনতা রয়েছে, শুধু শিবরামীয় নির্মল হাসিটি আর নেই। সবই হারানোর খাতায় একে একে নাম লিখিয়ে ফেলেছে। যেমন শিবরামের শেষ জীবন পর্যন্ত জড়িয়ে থাকার ভালোবাসার মেসবাড়িটিও। কালের নিয়মে হয়তো মুছে যাবে। ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে যাবে এই মেসবাড়ির নামটিও। জীর্ণ শরীরে দাঁড়িয়ে থাকা মেসবাড়িটি ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে তৈরি হবে নতুন ইমারত। যেখানে থাকবে না মুক্তারামে থেকে, তক্তারামে শুয়ে, শুক্তারাম খেয়ে মতন সহজ সরল গল্পেরা। এক ভাঁড় রাবড়ি আর একটা সিনেমার টিকিট পেলেই যাঁর জীবন চলে যেত সেই মানুষটি শেষ স্মৃতিটুকু মুছে যাবে সবার অজান্তেই। 

kolkata news
Advertisment