Hand Pulled Rickshaw Mechanic: গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুর! শরীরে ঘাম টলমল করছে। গায়ে ছেঁড়া-ফাটা পাতলা কাপড়ের আস্তরণ। বয়সের ভারে ভেঙে যাওয়া দেহ নিয়ে উত্তর কলকাতার সরু গলি দিয়ে হাতে রিকশা টানছেন। পিছনে সওয়ারি বসা। দুপাশে লাল ইটের পলেস্তারা খসা বাড়ি। ভেঙ্গে পড়া কার্নিশের ধারে গাছ উঠেছে। এরা সকলেই এই দৃশ্যের রোজকার সাক্ষী।
কলকাতা এবং হাতে টানা রিকসা। দুজনেই একে অপরের পরিপূরক। কলকাতার যত বয়স বাড়ছে ধুলো জমছে ইতিহাসের পাতায়। প্রায় তিনশো বছরের বেশী পুরনো এই শহর। কলকাতা, 'সিটি অফ জয়'। যদিও গত কয়েক দশকে এই শহরের অনেক কিছুই বদলে গেছে। বদলেছে রাস্তাঘাট, বদলেছে কলকাতার ঐতিহ্যরা। পড়ে আছে হাতে গোনা কিছু। এর মধ্যে অন্যতম হাতে টানা রিকশা।
উত্তর কলকাতার অলি-গলি কিংবা রাজপথে এখনও চোখে পড়ে সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি টানা রিকশা। একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কানে আসে ঠুং ঠুং আওয়াজ। বাইরে থেকে আসা মানুষরা অবাক চোখে দেখেন মানুষ চালিত এই দুই চাকার বাহন। সে কবে কোন রাজ্যে থেকে এসব রিকশা চালকরা এসেছেন তার হিসেব মনে নেই বৃদ্ধ শহরের। সবাইকে বুকে টেনে নিয়েছে আপন করে। ওরাও তো এই শহরের মানুষ। এরা ভিন রাজ্যে থেকে কর্মসংস্থান খুঁজতে এসে হাতে রিকশাটাকেই নিজের পেশা বানিয়ে ফেলেছিলেন। বেশীরভাগই আসেন বিহার, ঝাড়খণ্ড এর মত জায়গা থেকে। রিকশার কদর বাড়তে থাকে সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে রিকশা তৈরির কারিগরের সংখ্যাও। এই কারিগরদের মধ্যে অন্যতম বিখ্যাত কারিগর ছিলেন গণেশ ঠাকুর। স্বাধীনতার পর পর পাটনার হাজিপুর থেকে কলকাতায় এসে রিকশা তৈরির কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে ওনার ছোট ছেলে শিবশাহ ঠাকুর ১৯৭৩ সাল থেকে রিকশা তৈরির দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। তখন থেকে আজ পর্যন্ত একইভাবে শিবশাহ কাজ করে যাচ্ছেন।
"আমার বাবা যখন কাজ শুরু করে ছিলেন তখন এই রিকশার ব্যাপক চাহিদা ছিল। আমি যখন এই পেশায় আসি তখন আমি শ্যামবাজার স্কুলে পড়ি। পড়াশুনা ছেড়ে আমার দাদার কাছে কাজ শিখতে শুরু করি। কারখানায় তখন ছ-সাত জন লেবার কাজ করত। পাঁচ থেকে ছটা রিকশা রোজ ডেলিভারি হত। ৫০০টাকার বিনিময়ে পাওয়া যেত রিকশা। এখন তার দাম বেড়ে হয়েছে ১৮ হাজার থেকে ১৯ হাজার টাকা। বিহার, ঝাড়খণ্ডের মানুষরাই বেশী রিকশা টানত। এখন আর কেউ তেমন আসে না। রোজগার কই?" কথাগুলো গড়গড় করে খানিকটা বিরক্তের সুরেই বলছিলেন শিবশাহ। ফড়িয়াপুকুর রাস্তা পার করে সোজা গেলেই দেখা যাবে সারি সারি রিকশার জীর্ণ কঙ্কাল। এর পাশেই সরু গলির মধ্যেই সরু এক ফালি দোকান। এখন লোকজন তেমন একটা খোঁজ করে না। রিকশা তৈরির বায়নাও কম। মেঘলা আকাশ স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়ায় দুপুরে ঘুমিয়ে পড়ে ছিলেন শিব। কলকাতায় হাতে টানা রিকশার কারিগর এখন আর কেউ নেই বললেই চলে। ষাটেরও বেশী বয়স হয়ে যাওয়ার কারণে এখনও এই শিবশাহ পেশাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। আসলে বংশানুক্রমিকভাবে চলে আসা কাজকে এত সহজে ছেড়ে দেওয়া যায়!
যারা রোজগারের জন্যে পরিবার পরিজন ছেড়ে কলকাতায় এসেছিলেন যারা তাদের রিকশা টেনে আর সংসার চলে না। তাই পেশা বদল হয়েছে। যে কয়েকজন আছেন তাঁদের জন্যেই শিবশাহ ঠাকুর যত্ন করে আজও হাতে টানা রিকশা বানিয়ে দেন। এই রিকশা এখন কমতে কমতে উত্তর এবং মধ্য কলকাতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছে।
ইতিহাস ঘেঁটে যা জানা যায়, কলকাতায় রিকশার ব্যবহার শুরু হয় ১৯০০ সালের আশপাশে। কলকাতার চিনা অধিবাসীদের মধ্যেই প্রথম রিকশার ব্যবহার দেখা যায়। বউবাজার অঞ্চলের এইসমস্ত চিনা অধিবাসী মূলত কলকাতা ও খিদিরপুর ডকে খালাসির কাজ করতেন। মাল ওঠানোর সুবিধার জন্যই তাঁরা রিকশার ব্যবহার শুরু করেন। মাঝেমাঝে রাস্তায় যাত্রীদের দিকেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন তাঁরা। কলকাতার বাইরে বাংলার অন্য কোথাও রিকশার প্রচলন ছিল বলে জানা যায় না। তবে ১৯০৫ সালে বর্ধমানে নির্মীয়মাণ কার্জন গেটের একটি ছবির সামনে রিকশা দেখা যায়। তবে চিনা অধিবাসীদের হাত ধরে রিকশা ক্রমশ কলকাতাবাসীর কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯১৪ সালে কলকাতা পুরসভার কাছে একটি আবেদনপত্র জমা পড়ে। তাতে যাত্রী পরিবহণের জন্য রিকশার ব্যবহার শুরু করার কথা বলা হয়। ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ সরকার তৈরি করে 'হ্যাকনি ক্যারিজ অ্যাক্ট'। আর তারপরেই কলকাতার রাস্তায় পাকাপাকিভাবে জায়গা করে নেয় হাতে টানা রিকশা।
একসময় এই শহরে ৩০ হাজার হাতেটানা রিকশা চলত। সূত্র মতে এখন সেই সংখ্যা ১ হাজারেরও কম। কলকাতা পৌরসভা শহরের অধিকাংশ রাস্তায় বন্ধ করে দিয়েছে হাতেটানা রিকশার চলাচল। এসব রিকশা এখন চলছে ধর্মতলা, শিয়ালদহ, বড় বাজার, হাজরা, নিউমার্কেট, হাতিবাগান, শ্যামবাজার ও কলেজ স্ট্রিট এলাকায়। ২০০৫ সালে কলকাতার হাতেটানা রিকশাকে অমানবিক উল্লেখ করে তা তুলে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। যদিও বিক্ষোভ, ধর্মঘটের একেবারে বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে বর্তমানে টানা রিক্সার প্রচলন কমতে কমতে অনেকখানি কমে গেছে। যে কয়েকটা এদিক ওদিক চলতে দেখা যায় তারা যেন কলকাতার বুকে ক্ষত চিহ্নের মতন রয়ে গিয়েছে জরাজীর্ণ শরীরে।