'হাতে কালি, মুখে কালি, বাছা আমার লিখে এলি!' একটা সময় ছিল যখন মায়েরা তাঁর সন্তানদের এসব অহরহ বলতেন। এখন যদিও এর গুরুত্ব নেই বললেই চলে। ডিজিটালের যুগে কালি এবং কলম দুটোই তো প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। প্রাচীন মানুষ নিজের মনের ভাব প্রকাশ করত গুহাচিত্র এঁকে। তীক্ষ্ণ পাথরের ফলা দিয়েই লেখা হয়েছিল মানবজাতির ইতিহাস। সময় যত গড়িয়েছে বদলেছে মানুষের ভাবপ্রকাশের ভঙ্গিমাও। তীক্ষ্ণ পাথরের ফলার পরিবর্তে মানুষের আঙ্গুলের ফাঁকে এসে বসে পাখির পালক। গাছ গাছড়া থেকে পাওয়া কালি। এভাবেই বিবর্তিত হতে হতে আবিষ্কৃত হয় ঝর্নাকলম।
যেসব মানুষ টুকটাক কমবেশি লেখালেখি করেন তারাই শুধু এখনও কলমে আটকে আছেন। যদিও সেটি বল পয়েন্ট পেন! যাকে আমরা চলতি ভাষায় ডট পেন বলেও ডাকি। শেষ কবে ঝরনা কলম ব্যবহার করেছেন? যদি প্রশ্ন করা হয়! তা হলে নিশ্চিত যে তিনি প্রথমে বুঝতেই পারবেন না, যে তাকে কী নিয়ে প্রশ্ন করা হচ্ছে। তার পর তাকে যদি বলা হয় যে ফাউন্টেন পেনের কথা বলা হচ্ছে তা হলে তিনি বেজায় বিব্রত হয়ে বলবেন, সেই কবে ছোটবেলায় লিখতাম বটে। এখন এসব অকেজো। এসব অকেজো কলম নিয়েই তো কারবার শুভব্রত গঙ্গোপাধ্যায়ের। যখন যেখানে পেরেছেন সংগ্রহ করেছেন দুর্মূল্য সব কলম। মানব সভ্যতার ইতিহাসের অন্যতম সাক্ষীর এই উপাদানকে। দিন যত এগিয়েছে মানুষ বিজ্ঞান প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়েছে। এখন তিন আঙ্গুলের লেখার থেকেও বেশী দশ আঙ্গুলের কি বোর্ডেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
আরও পড়ুন- ‘তারার ছায়া’য় স্মৃতির সমাহার, অপূর্ব-কীর্তিতে চাগিয়ে উঠছে ইতিহাস-প্রেম
আজকের নতুন প্রজন্মের কাছে কলম বিষয়টি অনেকটা বিলুপ্তপ্রায় জিনিসের মতন। কলমের কতরকম প্রকারভেদ আছে তা সম্বন্ধে জানেই না। শুভব্রত গাঙ্গুলি কলম নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বলছিলেন, 'এখনকার প্রজন্মের সবাই কম্পিউটারে মুখ গুঁজে রয়েছে। কি বোর্ড কিংবা স্মার্ট ফোনের কি প্যাডে অবিরাম টাইপ করে চলেছে। সারাক্ষণ আঙ্গুলের ওপর চাপ দেওয়ার ফলে স্নায়ু রোগ দেখা দিচ্ছে। এসব ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে খুবই ক্ষতিকারক। এছাড়া বল পয়েন্ট পেন ব্যবহার পরিবেশের জন্যে ক্ষতিকারক। সম্পূর্ণ প্ল্যাস্টিকে তৈরি বল পয়েন্ট কলম একবার ব্যবহারের পর ফেলে দিতে হয়। এসবই জমা হচ্ছে নদী, নর্দমায়, শেষমেশ সমুদ্রে। এত এত প্ল্যাস্টিকের জন্যে পরিবেশ দূষণ বাড়বেই! সেই জায়গায় ফাউন্টেন পেন চলে বছরের পর বছর। আমার কাছে বেশিরভাগটা রয়েছে এধরণেরই কলম।'
আরও পড়ুন- আদি থেকে আধুনিক, কলকাতার ‘ক্যামেরাম্যান’-এর জিম্মায় এক স্বর্ণালী ‘ইতিহাস’
শুভব্রত বাবু নিজে একজন ঝর্ণা কলমের একনিষ্ঠ ভক্ত। গত তিরিশ বছর ধরে সংগ্রহ করে চলেছেন এসব কলম। যদিও নিজেকে সংগ্রাহক বলতে একদম পছন্দ করেন না। তিনি যা সংগ্রহ করেছেন তা নিজের ভালোলাগা থেকে করেছেন। সেসব কলমের ইতিহাস কবে কোথায় তৈরি সবই তার মুখস্থ। মধ্যযুগে পাখির পালকের নিচের অংশ ফালি করে তা চেঁছে তীক্ষ্ণ করে লেখার কাজে ব্যবহার করা শুরু হয়। এধরনের কলমকে বলা হয় কুইল পেন। আঠারো শতকের দিকে স্টিল ডিপিং পেনের উদ্ভব ঘটলে কুইল পেনের প্রচলন কমে যায়, কেননা স্টিল ডিপিং পেনকে বারবার চেঁছে তীক্ষ্ণ করতে হতো না। যদিও স্টিল ডিপিং পেন এবং কুইল পেন উভয় কলমেরই আলাদা কালির প্রয়োজন হতো। ফাউন্টেন পেনের আবিষ্কারক হিসেবে অবশ্য কৃতিত্ব পাবেন মিশরের শাসক খলিফা মা'দ আল-মুয়িজ। তিনি ৯৫৩ সালের দিকে এমন একটি কলমের কথা চিন্তা করেন, যে কলমের ভেতর কালি জমা করে রাখা যায়। এতে কালি পড়ে গিয়ে কাপড়-চোপড় নষ্ট হবার সম্ভাবনা থাকে না। সেই চিন্তা থেকেই প্রথম ফাউন্টেন পেনের আবিষ্কার হয়েছিল বলে জানা যায়। ১৮৮৪ সালে এসে লুইস ওয়াটারম্যানের হাত ধরে এটি বাণিজ্যিক রূপ পায়। অনেকে মনে করেন ফাউন্টেন পেন থেকে ঝর্না কলমের বাংলা অনুবাদ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কলমের ইতিহাস বলতে গেলে অনেকটাই লম্বা।
আরও পড়ুন- কলকাতার এই প্রবীণ সংগ্রহ করেন উনিশ শতকের অমূল্য সব ‘সুচ-সুতোর’ ভালোবাসা
ঘরদোর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নানা ধরণের কলম আর কালির দোয়াত। এর মাঝেই কলমের ভরা সংসার শুভব্রত গাঙ্গুলির। কলম দেখাতে গিয়ে শুভব্রত বাবু বলছিলেন, ঝরনা কলম এবং রাধিকানাথ সাহার গল্প। 'সুলেখা কালির কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু এই প্রজন্ম জানে না রাধিকাবাবুর কথা। সম্ভবত ভারত থেকে ঝরনা কলমের আন্তর্জাতিক পেটেন্ট নেওয়াতে তিনিই প্রথম। গবেষক শোভন রায়ের কল্যাণে সেই ইতিহাস আমরা সকলেই কম বেশী জানতে পেরেছি। শোভন বাবুর থেকেই জানতে পারি লক্ষ্মী পেনে লিখেছেন গান্ধীজী, বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদ, মৌলানা আজাদ। সৌভাগ্যবশত এই কলম আমার কাছেও একটি আছে। বাংলার প্রথম গভর্নর লর্ড কারমাইকেলের মতো ইংরাজ শাসকরাও ব্যবহার করতেন এই পেন। ১৯১৬ সালে এই পেনের দাম ছিল দু’টাকা আট আনা!'
আরও পড়ুন- পুতুল নাচের ইতিকথা, সংগৃহীত পুতুলেরা যেন নিজেদের গল্প বলছে
কালের নিয়মে ফাউন্টেন পেনের ব্যবহার কমে এসেছে। অভিজাত পরিবার ব্যতীত এই কলম দেখেছেন এমন লোকের সংখ্যাও এখন হাতে গোনা। তবে রুচিশীল মানুষের কাছে এর চাহিদা কিন্তু ঠিকই আছে। তারই প্রমাণ পাওয়া যায় শুভব্রত গঙ্গোপাধ্যায়ের মতন কলম প্রেমীর কাছে। ফাউন্টেন পেন সংগ্রহের মতো চমৎকার শখটি নতুন এবং আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন চুপিসারে। হাতের লেখা পোক্ত করার জন্যে স্কুলে স্কুলে পৌঁছে যান ঝর্না কলম নিয়ে। ছাত্রদের বোঝান কালি, কলমের গুরুত্ব। এই কাজে শুভব্রত বাবু পাশে পেয়েছেন সুলেখা কালির কর্ণধার কৌশিক মৈত্রকেও। রোজ কত কিছু হারিয়ে যাচ্ছে। এই হারানোর ইতিহাস যা দিয়ে লেখা হয়, সেটাই যত্নে আগলে রাখছেন শুভব্রত। নিজের লেখা থেকে শুরু করে ডিজিটাল মাধ্যম সবটাতেই আস্তে আস্তে জমিয়ে রাখছেন কলমের বিবর্তনের গল্প। অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকেই 'ফাউন্টেন পেন' কিংবা 'ঝরনা কলম' ছিল প্রেমের প্রতীক, ভালোবাসার প্রতীক, আভিজাত্যের প্রতীক। এই অনুভূতিগুলোয় হয়তো ধরে রাখতে চাইছেন কলকাতার এই কলম প্রেমী।