২ নম্বর জাতীয় সড়কের দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের অদূরের জমিতে মাটির ঢিবি এবং কংক্রিট। চারিদিকে ঘাস এবং জরাজীর্ণ ড্রেনেজ পাইপ রয়েছে। জমির ছোট ছোট অংশে কৃষিকাজ হতে পারে। এখানেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টাটা মোটরস সিঙ্গুর ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্টের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। যে আন্দোলন তাঁর দলকে রাজ্যে ক্ষমতায় আনতে সাহায্য করেছিল। ১৫ বছর পর তৃণমূল পশ্চিমবঙ্গের শাসনভার নিজের হাতে রেখেছে। অন্যদিকে, টাটা মোটরসকে একটি বড় অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার পরিস্থিতিও তৈরি হয়েছে। তবে এসবের মাঝে সিঙ্গুরের এই জমিতে যাঁরা চাষ করেছিলেন তাঁরা কিন্তু নিজেদের 'পরাজিত' বলেই ভাবছেন।
এই সপ্তাহের শুরুর দিকে তিন সদস্যের আরবিট্রাল ট্রাইব্যুনাল টাটা মোটরস লিমিটেডকে ৭৬৬ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বলেছে। যে টাকাটা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছ থেকেই মিলবে। ২০১১ সালে মমতা বন্দ্যেপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর তাঁর প্রথম মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত ছিল ৪০০ একর জমি "অনিচ্ছুক কৃষকদের"। যাঁদের জমি পূর্ববর্তী বাম সরকার অধিগ্রহণ করেছিল কিন্তু ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকার করেছিল।
তাঁদেরই একজন সিঙ্গুরের বেড়াবেড়ি গ্রামের বাসিন্দা লক্ষ্মী সাঁতরা (৬৭)। তিনি বলেন, “আমাদের এখানে একটি ছোট জমি ছিল। সবার মতো আমিও আন্দোলনের অংশ ছিলাম। আমি প্রতি মাসে ২ হাজার টাকা এবং ১৬ কেজি চাল পাই (টিএমসি সরকার কর্তৃক অনিচ্ছুক কৃষকদের জন্য সরকারি ক্ষতিপূরণ)। কিন্তু এটাই। আমি এখানে লম্বা ঘাস, জল এবং ঝোপের মধ্যে আমার জমি চিহ্নিত করে উঠতেই পারিনি। আমরা এখন বছরের পর বছর ধরে এখানে আটকে আছি। আমি টাটার ক্ষতিপূরণ সম্পর্কেও জানি না। আমাদের কি হবে?"
লক্ষ্মীদেবীর সমস্যাটি যে একেবারেই অন্যরকমের তা কিন্তু নয়। টাটারা তাদের যন্ত্রপাতি এখান থেকে সরিয়ে নেওয়ার পর অবশিষ্ট ছিল কংক্রিটের কাঠামো এবং রাস্তার অবশিষ্টাংশ। যেখানে এক সময় কৃষিজমি ছিল। এসবের মধ্যে এই এলাকায় কোনটা কার জমি বা একের থেকে অন্যের জমির অংশ আলাদা করে বোঝাটা কার্যত অসম্ভব।
এরকমই একটি সরু কংক্রিটের রাস্তায় সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বছর পঁয়ষট্টির অশোক পোড়েল। তিনি জানান, তিনি সেই কৃষকদের মধ্যেই একজন ছিলেন যাঁরা টাটা প্রকল্পের জন্য স্বেচ্ছায় তাঁদের জমি ছেড়ে দিয়েছিলেন। তাঁর কথায়, “আমার পাঁচ বিঘা জমি ছিল। এরপর কোম্পানি সিঙ্গুর থেকে তাঁদের প্রকল্প সরিয়ে নিল। এত বছর পরে, আমি এখনও আমার জমি চিহ্নিত করতে পারিনি। কারণ সেখানে কোনও সীমানাই নেই। সরকার বলেছে, তারা চাষযোগ্য জমি ফেরত দেবে। আপনি কি সত্যিই এখানে যা দেখছেন তাতে চাষ করা কি সম্ভব?"
তিনি আরও বলেন, “যেহেতু আমি একজন ইচ্ছুক কৃষক ছিলাম তাই আমি সেই সরকারি সুবিধা পাই না যা ‘অনিচ্ছুক কৃষকরা’ পায়। আর আমার জমি পেলাম কাগজে কলমে। আমি এখনও বিশ্বাস করি যে এখানে জগাখিচুড়ি থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র উপায় হল শিল্প।" বর্তমানে স্ত্রী এবং ছেলেকে নিয়েই এখানে থাকেন বৃদ্ধ অশোক পোড়েল। তাঁর ছেলে একসময় সৌদি আরবে গয়নার কারিগর হিসাবে কাজ করছিলেন। তবে করোনা মহামারীর সময়ে ফিরে এসেছিলেন এবং এখনও চাকরি পাননি।
ওই ব্যক্তি জানিয়েছে, বর্তমানে তাঁর বাড়ি লাগোয়া ১৩ কাঠা জমিতেই তিনি চাষের কাজ করেন। ওই জমি থেকেও কংক্রিট এবং লোহার খণ্ড সরাতে বড় মেশিন ব্যবহার করতে হয়েছিল তাঁকে।
এলাকারই একজন ভাগচাষি ছিলেন বেচারাম পাত্র (৭৮)। বৃদ্ধের কথায়, “আমাদের জমি ছিল না। কিন্তু অন্যদের যা ছিল তা নিয়ে কাজ করেছি। আমরা কোনও ক্ষতিপূরণ পাইনি। রাজ্য সরকারের কাছ থেকে শুধুমাত্র মাসিক সাহায্য পেতাম, যেটাও কয়েক মাস আগে বন্ধ হয়ে গেছে। এত বছর পরে, সবাই এখন বলছে শিল্পই হওয়া উচিত। এই জমিটি এখন চাষের কাজে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গেছে।”
টাটা প্রকল্প এলাকা থেকে প্রায় মিনিট কুড়ির দূরত্বে রয়েছে ডাঃ উদয়ন দাসের নার্সিংহোম। টাটা প্রকল্পের জন্য তাঁর ১৩ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল, তার মধ্যে তিনি ব্যবহার করার জন্য মাত্র ৩ একর জমি পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি বলেন, “আপনি যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন যে সিঙ্গুর জমি আন্দোলনের পরে কে জিতেছে, আমি বলব তৃণমূল। রাজ্য সরকার কিছু চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এই জমি চাষযোগ্য নয়। আমরা এই জমিটি আগের অবস্থা ফেরাতেও পারব না বা এটি বিক্রি করতেও পারব না কংক্রিটের রাস্তাগুলি খুব সরু এবং ভারী যানবাহন চলতে পারে না। এই জমিকে এখন কৃষির উপযোগী করতে হলে বিশাল বিনিয়োগের প্রয়োজন।”
আরও পড়ুন- শীতের মেজাজের দফারফা করে বৃষ্টির সম্ভাবনা, ঠান্ডার তুফানি কামব্যাক কবে?
রাজ্য সরকার সিঙ্গুরের (যাঁদের জমির সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে – মালিক, ভাগচাষি এবং কৃষি শ্রমিক) ৩ হাজার ৬১১ জনকে মাসে ২ হাজার টাকা এবং ১৬ কেজি চাল দিচ্ছে। জমিতে চাষ করতে না পেরে কিছু কৃষক পুকুর কেটে মাছ চাষের চেষ্টা চালাচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে দিলীপ সামন্ত নামে এক ব্যক্তি রয়েছেন। তাঁর কথায়, "এটা সময় লাগবে। তবে আমরা আশাবাদী। এটা কার্যকর হবে।"
ওই ব্যক্তি আরও বলেন, “আমরা পাঁচ জনকে নিয়ে একটি সোসাইটি তৈরি করেছি। বিশাল জলাশয়ে মাছ চাষ করছি। এখানে কেউ শিল্পের বিরুদ্ধে ছিল না। আমরা চেয়েছিলাম ৬০০ একরে শিল্প হোক এবং ৪০০ একর উর্বর জমি বাদ দেওয়া হোক।”
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামীণ উন্নয়ন বিভাগের প্রতিমন্ত্রী বেচারাম মান্না বলেন, “অনেক জমিতে চাষ শুরু হয়েছে। বাকি জমিকে কৃষি উপযোগী করার কাজ চলছে। আমি এটা বলতে পারি। টাটার দাবি নিয়ে মন্তব্য করব না।” বেচারাম মান্না সিঙ্গুর জমি আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন।