ডিউটি শেষে ‘সমাজসেবাই’ তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। নিজের সামান্য বেতনের টাকা থেকেই কাঁধে তুলে নিয়েছেন ৫০ জন ‘আদিবাসী অনাথ পড়ুয়ার’ পড়াশুনার যাবতীয় দায়িত্ব। রামপুরহাটের কুশুম্বা গ্রামের শিবায়ন শহরের বিভিন্ন মোড়ের যান নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব সামলান। আর ডিউটি শেষেই শিবায়ন চলে যান কুশুম্বা গ্রাম ছাড়িয়ে কিছুটা দুরের এক অনাথ আশ্রমে। সেখানে আদিবাসী আবাসিক পড়ুয়াদের পড়াশুনার পাশাপাশি তাদের দেখভালও করেন বছর ২৯ এর শিবায়ন। রামপুরহাট শহরের একাধিক বস্তি এলাকার ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের অবসর সময়ে পড়াশুনা শেখান তিনি। একই সঙ্গে বিয়েবাড়ি বা অনুষ্ঠান বাড়ির বেঁচে যাওয়া খাবার দুঃস্থদের মধ্যে বিলি করেন তিনি।
দিন কয়েক আগেই এক শীতের রাতে রানাঘাট স্টেশনে অভুক্ত মানুষগুলোর মুখে অন্ন তুলে দিয়ে সংবাদ শিরোনামে উঠে এসেছিলেন পাপিয়া কর। এবার বীরভূমের শিবায়ন সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে রাতারাতি সংবাদ শিরোনামে। ছেলেবেলা থেকেই মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত শিবায়ন। কলা বিভাগে স্নাতকস্তর পর্যন্ত পড়াশুনা করে স্নাতকোত্তর স্তরে ভর্তি হতে চেয়েছিলেন শিবায়ন। কিন্তু বাঁধ সাধলো সংসারের অভাব অনটন।
সংসারের হাল ধরতে ২০১৩ সালে সিভিক ভলান্টিয়ার হিসাবে কাজে যোগদান। কিন্তু সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য কিছু করার এক অদম্য ইচ্ছা সব সময় তাকে তাড়া করে বেড়াত। করোনা কালে নিজের বেতনের সামান্য টাকা থেকেই রেল স্টেশন থেকে শহরের নানা প্রান্তের অভুক্ত মানুষ গুলোর জন্য দুবেলা অন্ন সংস্থান করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন শিবায়ন।
শহরের এক অনাথ আশ্রমের ৫০ জন আবাসিক আদিবাসী পড়ুয়ার পড়াশুনার যাবতীয় দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন শিবায়ন। তাঁর এই উদ্যোগকে কুর্নিশ জানিয়েছেন জেলা পুলিশ। মিলেছে সম্বর্ধনাও। কেমন লাগছে সম্বর্ধনা পেয়ে উত্তরে শিবায়ন জানালেন, “এমন এক মুহূর্ত যা কখনও ভোলার নয়। বড় সাহেবের হাত থেকে সম্বর্ধনা পেয়ে মানুষগুলোর পাশে থেকে তাঁদের জন্য করার ইচ্ছা আরও বেড়ে গেছে”।
শুধু যে অনাথ আশ্রমের পড়ুয়াদের পড়াশুনার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন তাই নয়। বিয়েবাড়ি বা অনুষ্ঠান বাড়ির বেঁচে যাওয়া খাবার দুঃস্থদের মধ্যে বিলি করেন তিনি। তাঁর এই সমাজ সেবার কথা রামপুরহাট শহরের সকলেরই প্রায় জানা। অনেকেই এগিয়ে এসেছেন নানান সময়ে তাঁকে সাহায্য করার জন্য।
সামান্য বেতনে এতগুলো পড়ুয়ার দায়িত্ব সামলাবেন কী করে? উত্তরে শিবায়ন জানালেন, “নিজে আর্থিক কারণে উচ্চশিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছি। সামান্য বেতনের সিভিক পুলিশের কাজে ঢুকেছি শুধুমাত্র সংসারের হাল ধরতে। আমি চাই আদিবাসী ওই পিছিয়ে পড়া ছেলেমেয়ে গুলো যেন তাদের পড়াশুনা চালিয়ে নিয়ে যেতে পারে”।
শিবায়নের কথায় “জেলা পুলিশও তাঁর এই কাজকে সম্মান জানিয়ে সাহায্যের হাত বাড়য়ে দিয়েছে। অনাথ আশ্রমের পড়ুয়াদের লেখাপড়ার যাবতীয় সরঞ্জাম জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে শিবায়নের হাতে তুলে দেওয়ার প্রতিশ্রতিও মিলেছে”। সমাজ সেবার প্রতি আগ্রহ কবে থেকে? উত্তরে শিবায়ন জানিয়েছেন, “স্কুলে পড়ার সময় থেকে অন্যের বিপদ দেখে নিজে বাড়িতে বসে থাকতে পারতাম না। সেই থেকেই সমাজ সেবার হাতেখড়ি। সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য কিছু করার ইচ্ছা সব সময়ের জন্যই ছিল। সিভিক ভলেন্টিয়ারের চাকরি পাওয়ার পর নিজের জন্য সামান্য কিছু রেখে বেতনের সবটুকুই সমাজের উপেক্ষিত মানুষের সাহায্যের জন্য খরচ করি”।
তার এই উদ্যোগকে কুর্নিশ জানিয়ে ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের সোশ্যাল মিডিয়া সাইটে তাঁকে নিয়ে একটি অনুপ্রেরণামুলক পোস্টও করা হয়েছে। তবে শিবায়ন বলেন, “এত প্রচারের আলোয় আসতে চাই না। কাজ করে যেতে চাই। অসহায় মানুষদের জন্য আগামীদিনেও আমি কাজ করে যাব”। সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের কাছে শিবায়নের একটাই অনুরোধ, ‘যতটুকু সম্ভব অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ান’।