ভোট আসে হাজার প্রতিশ্রুতি নিয়ে, জোর কদমে চলে প্রচার, ভোট যায়, ক্ষমতার হাতবদল হয়। পাঁচ বছর পর পর ছবিটা কম বেশি একই রকম থাকে। এতদিনে তা বুঝে গিয়েছেন উত্তর কলকাতার যৌন পল্লীর কর্মীরা। তাই তাঁদের সহজ হিসেব -"আমাদের কথা কে ভেবেছে, যে আমরা কারোর কথা ভাবব"? বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশে শুরু হয়ে গিয়েছে ভোট উৎসবের তোরজোড়। ১৭ তম সাধারণ নির্বাচনের আগে সোনাগাছির যৌন কর্মীরা জানিয়ে দিলেন, এবার তাঁদের ভোট পড়বে নোটায়। কোনও পক্ষই তাঁদের পক্ষ নেয়নি। অতএব এবার প্রতিবাদ জানাবেন ব্যালট বাক্সে। বুঝিয়ে দেবেন কোনও রঙ, কোনও নেতাতেই আস্থা নেই আর।
আসন্ন নির্বাচনে কাকে ভোট দিচ্ছেন জানতে চাওয়া হলেই ৫৫ বছরের শেফালি রায়ের স্পষ্ট জবাব, "রাজনৈতিক নেতারাই দেশের আইন তৈরি করেন। রোজ কত শত আইন তৈরি হচ্ছে, কত আইন সংশোধিত হচ্ছে। অথচ আমাদের অধিকার নিয়ে সংসদে একবারও আলোচনা হয়না তো"।
লোকসভা কিমবা বিধানসভা, ভোটের মরসুম এলেই হল, কত দল, কত হেভি ওয়েট নেতারা কথা দিয়ে যান শেফালি এবং শেফালির মতো হাজার হাজার যৌন কর্মীর পেশা আইনি স্বীকৃতি পাবে এবার। ভোট মিটলে যে কে সেই। সোনাগাছির কর্মীদের অধিকার নিয়ে বিগত বেশ কিছু বছর ধরে লড়াই করে আসছে অসরকারি সংস্থা দুর্বার। সংস্থার সচিব কাজল বসুর কথায়, "আমাদের পেশা অন্য যে কোনও পেশার মতোই। তাহলে আমাদের কেন এত হেনস্থা হতে হয়? কত বার কত নেতার কাছে আবেদন করলাম। ভোটের আগে সবাই কথা দিয়েছে। আর ক্ষমতায় এসে ভুলে গিয়েছে। ওরা বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে আমাদের এড়িয়ে যেতে পারেন। তাহলে আমরা কেন ওদের দিকটা ভাবব"?
আরও পড়ুন, সমকামী-রূপান্তরকামীদের সঙ্গে বৈঠক করে ভোট চাইবেন বাম প্রার্থীরা
সমস্যাটা কিন্তু শুধুমাত্র রাজনৈতিক নেতাদের ঔদাসিন্য নয়। অনেকেরই বৈধ পরিচয়পত্র নেই। কেউ বাবা মায়ের কাছ থেকে, কেউ বা স্বামীর ঘর থেকে পালিয়ে এসেছিলেন বছর কয়েক আগে। এখন সে ঘরেতেই ফিরবেন পরিচয়ের প্রমাণ নিতে, সেই 'সাহস' এই সমাজ তাঁদের দেয় না। জন্মের শংসাপত্র অনেক দূরের কথা, ঘর ছাড়ার পর নতুন ঠিকানা কিমবা নতুন কাজ কোনওটাই বলে উঠতে পারেন না শেফালিরা।
দুর্বারের নথিভুক্তিকরণের কার্ড, ঊষা ব্যাঙ্কের পাসবই, প্যান কার্ড, সঙ্গে স্থানীয় সাংসদ কিমবা বিধায়কের চিঠি। সে সবের ভিত্তিতে কয়েক দফা যাচাই পর্ব শেষ হলে নির্বাচন কমিশনের দফতরে একটা সাক্ষাৎকার। ভোটার তালিকায় নাম তোলার নিয়ম এরকমটাই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সোনাগাছির এক কর্মী জানালেন, "আমাদের এলাকার বিধায়ক শশী পাঁজা, সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় মাঝে মাঝে আমাদের খোঁজ খবর নেন। ভোটের আগ দিয়ে প্রচারেও আসছেন ওরা। কিন্তু আমাদের কার্ডই নেই, ভোট দেব কী করে"?
"নিজেদের কার্ড নেই। বাচ্চাদের কার্ড করা কতটা কঠিন বুঝতে পারছেন? বৈধ পরিচয়পত্র নেই, তাই সমাজকল্যাণমূলক কোনও প্রকল্পের সুবিধা পাই না আমরা", কাদের 'সমাজ', কাদের 'কল্যাণ', সেই প্রশ্নই আরও একবার উঠে এল ৫০ বছরের কলাবতী দেবীর কথায়, "আমরা এই দেশের নাগরিক নই"? "কেউ অন্তঃসত্তা হয়ে পড়লে আইডি কার্ড ছাড়া সরকারি হাসপাতাল ভর্তি নেয় না", জানালেন সদ্য তিরিশের কোঠায় পৌছনো এক কর্মী।
এখানেই শেষ নয়। শাসক দল মুখ ফিরিয়ে রাখে, তবু সরকারি নীতির প্রেক্ষিতে রাতারাতি পালটে যায় এদের দৈনিক যাপন। ঠিক যেমনটা ঘটেছিল নোটবন্দির সময়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সরে গিয়েছিল পায়ের তলার মাটি। হু হু করে কমতে থাকল খদ্দেরের আসা যাওয়া। রোজ নতুন অনিশ্চয়তা। মনে মনে প্রমাদ গোনা, "আজ জুটেছে, কাল কী হবে, কালের ঘরে শনি..."।
কেউ আসা বন্ধ করলেন, কেউ কমিয়ে দিলেন ঘনঘন আসা। কেউ এলেন অচল নোট নিয়ে। প্রথম দিকে পুরনো নোট নিয়ে এলে হাতের 'লক্ষ্মী' পায়ে ঠেলতেন অনেকেই। "একসময় ভাবলাম ব্যাঙ্কে গিয়ে নোট পালটে ফেলব। একদিন এক খদ্দের একটা ৫০০ টাকা ধরিয়ে দিল। অন্যরকম লাগছিল নোট টা। অন্য মেয়েদের একবার দেখে নিতে বললাম নোটটা, ততক্ষণে খদ্দের পালিয়েছেন", অন্ধকার জীবনের ততোধিক অন্ধকার দিনগুলোর স্মৃতি খুঁড়ে আনছিলেন মধ্য তিরিশের এক মহিলা।
জিরো ব্যালান্সে যখন দেশবাসীকে অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য উৎসাহ দিলেন মোদী, 'নিষিদ্ধ পল্লী'র মেয়েরা ভেবেছিলেন, অবশেষে কেউ তাঁদের মতো প্রান্তিক মানুষের কথা ভাবলেন। অ্যাকাউন্ট খোলা হল সাত তাড়াতাড়ি। কিন্তু আজ অবধি ৫০০ টা টাকাও সরকার ফেলেনি তাঁদের অ্যাকাউন্টে।
আরও পড়ুন, এই ভোটে কি দিন বদলাবে রূপান্তরকামীদের?
জনৈক কর্মীর কথায়, "তাও সিপিএম আমলে আমরা কিছু নৈতিক সমর্থন পেতাম। অন্তত আমাদের সমস্যার কথা শুনতেন নেতারা। বৈধ পরিচয়পত্র নিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতেন। তৃণমূল জমানায় সেরকম কিছু হয়নি"।
সোনাগাছির যে ৯১ জন যৌনকর্মী আইডি কার্ডের জন্য আবেদন করেছিলেন, তাদের মধ্যে ৫০ জন কার্ড পেয়েছেন। অধিকাংশের অভিযোগ স্থানীয় নেতারা সহযোগিতা করেননি। সোনাগাছি সংলগ্ন বউ বাজার, রবীন্দ্র সরণি, রামবাগানের যৌন পল্লীতে ৪০ জন বৈধ পরিচয়পত্রের জন্য আবেদন করেছিলেন। এদের মধ্যে কেউ পাননি কার্ড। বসিরহাট, টিটাগড়, শান্তিপুরেও ছবিটা একই। জনা পঞ্চাশেক কর্মী আবেদন করেছিলেন ভোটার কার্ডের জন্য। কার্ড হাতে পাননি কেউই"।
"দক্ষিণ কলকাতায় চেতলা, খিদিরপুর অঞ্চলে কর্মীদের জন্য ফিরাদ হাকিম চিঠি লিখে দিয়েছেন। এখানে এমনটা করা যায় না"?, প্রশ্ন রাখলেন এক কর্মী।
সামাজিক কিমবা আইনি স্বীকৃতি নেই, তবু সারা বাংলায় তাঁদের সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। কম করে হাজার দশেক যৌন কর্মী। প্রত্যেকের পরিবারের সদস্য ৫। ৫০ হাজারটা আঙুল এবার ভোট দেবেন নোটায়। একটা ভোটও তো বদলে দিতে পারে কত সমীকরণ, কত হিসেব। ৫০ হাজার টা ভোট পারবে না দিন পালটে দিতে? অপেক্ষায় সমাজের চোখে দিনের আলোয় 'নিষিদ্ধ' মানুষগুলো।
Read the full story in English