৯ বছরের প্রীতি। ডাক নাম তার পুটু। এই মুহূর্তে 'সুপারস্টার সিঙ্গার' হয়ে শুধু ভারত নয়, বর্ধমানের মেয়েটির নাম ছড়িয়েছে বিদেশেও। ছোট্ট প্রীতি বলছে, "প্রথম হওয়ার জন্য আমি আমার জান লাগিয়ে দিয়েছিলাম। তবে আরও প্রাকটিস করতে হবে। আরও মন দিয়ে গান করতে হবে। হিমেশজি বলেছেন, আমার গলা কোকিলের মতো। প্লে-ব্যাকের অফারও করেছেন।" বর্ধমান শহরের বাদামতলার বাড়িতে বসে পুটু দীর্ঘক্ষণ কথা বলল ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-র সঙ্গে। বর্ধমান মিউনিসিপ্যাল হাইস্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রীটি জানাল 'সুপরাস্টার সিঙ্গার' হওয়ার গোপন রহস্য।
অভিনন্দন! তোমাকে তো এখন সারা ভারত চেনে, কিন্তু বাড়িতে সকলে কী নামে ডাকে?
আমার ডাক নাম পুটু। আমার জ্যেঠু আমাকে বলে ফাটিপুটু (হেসে লুটোপুটি)।
দীর্ঘ লড়াইয়ের পর প্রথম হওয়ার স্বীকৃতি। কেমন লাগছে?
আমার ভীষণ ভাল লাগছে। আমি কোনওদিনই ভাবিনি যে সুপারস্টার সিঙ্গার হব। আমি ভেবেছিলাম হয়তো আমি টপ সিক্সটিন-এ উঠব। হয়তো টপ সিক্স-এ পৌঁছব, সুপার ফিনালেও যাব। কিন্তু আমি উইনার তো হতে পারব না। এটাই ছিল প্রথম থেকে আমার ভাবনা।
তোমরা বয়স ৯ বছর। অন্যান্য প্রতিযোগীরা অনেকেই তোমার থেকে বয়সে বড়। তাহলে কি করে সম্ভব হল?
(গলায় আত্মবিশ্বাস) উইনার হওয়ার জন্য আমি আমার জান লাগিয়ে দিয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত সাফল্য পেয়েছি। আমি এর জন্য ভীষণ খুশি। এটা ধরে রাখার জন্য আরও প্র্যাকটিস করতে হবে। আরও মন দিয়ে গান করতে হবে।
হিমেশ প্রথম থেকেই তোমাকে পছন্দ করছিল...
প্রীতি: (মুখের কথা টেনে নিয়ে) হিমেশজি আমাকে বললেন যে সুপারস্টার হবে তাকে অনেক সুপারস্টার নমস্তে দেওয়া হবে। আমাকে ১০-১৫টা দেওয়া হবে। আমি তো ভীষণ খুশি। উনি আরও বলেন, অডিশন থেকেই তোমাকে ভালোবেসে আসছি। তোমার গলা ভীষণ মিষ্টি। তুমি ভাল গান গাও, একেবারে কোকিলের মতো গাও। তোমার সুর আছে। উইনার হওয়ার পর সুপারস্টার নমস্তে দিল।
অলকা ইয়াগনিকও একদিন বললেন না তুমি বাঙালি...
অলকা ম্যামও আমাকে খুব ভালোবেসেছেন। বলেছেন, আমি নাকি ছোট অলকা ইয়াগনিক। আমি যখন প্রথম অডিশনে গিয়েছিলাম, তখন অলকা ম্যাম বলেছিলেন, তুমি বাঙালি? তখন আমি বলেছিলাম, হ্যাঁ আমি বাঙালি। জাভেদ আলিও আমাকে খুব ভালোবাসেন।
তুমি বর্ধমানের মতো একটা জেলা শহর থেকে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছো। কি মনে হয়েছিল?
আমাদের এই বর্ধমান শহর থেকে কেউ কখনও যায়নি এত বড় রিয়েলিটি শো-তে। আমিই তো প্রথমবার গেলাম। তাই আমার মাথায় অনেক দায়িত্ব ছিল। মনে হত, উইনার হয়ে আসতেই হবে। আমি তাতে সফল হয়েছি। আমি এতে ভীষণ খুশি। আমার বর্ধমানের বাসিন্দারাও খুব খুশি। তাঁরা আমাকে অনেক সমর্থন করেছেন। পাশে থেকেছেন।
মুম্বাইয়ে জীবনটা কেমন ছিল?
(খুব সতর্ক গলায়) ওখানকার জার্নিটা ভীষণ কঠিন ছিল। ভীষণ মুশকিল ছিল। সকালবেলা হয়তো ২-৩ ঘন্টা রেস্ট পেতাম। এর মধ্যে আমাদের গান বাছাই হয়ে যেত। কোন গানটা গাইব, সেটা দিয়ে দিত। রাতারাতি সেই গান তুলতে হত। চার-পাঁচটা করে গান দিত। সেই গানের কথা, সুর মুখস্ত রাখতে হত। কারণ, হঠাৎ বলে দিত, কাল ব্যান্ড রিহার্সাল আছে। প্র্যাকটিস করে পরশুদিন শুট করতে হবে। রাত রাত জেগে তখন আমাদের গান গাইতে হত। গান যদি পুরোপুরি তুলতে না পারতাম, তাহলে নীচে ব্রেকফাস্ট করতে যেতাম না। গানটা যদি হয়ে গেলে আমি ফ্রি হয়ে যেতাম, তারপর ব্রেকফাস্ট বা অন্য কিছু করতাম। এরপর সারাদিন ব্যান্ড রিহার্সাল হত।
প্রায় ৫-৬ মাস মুম্বাইতে ছিলে। কেমন হিন্দি শিখেছ।
ওখানে গিয়ে খুব ভাল হিন্দি শিখে গিয়েছি। সবাই হিন্দি বলতো, বাংলা কথা কম হত। আমরা দু'জন বাঙালি ছিলাম। আমরা খুবই ক্লোজ ছিলাম। বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে গিয়েছি। আমার মনের কথাটা ওকে বলতাম। ওর মনের কথাও আমাকে বলতো। তবু আমরা বাঙালি হলেও হিন্দিতেই কথা বলতাম। বাংলা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। বাংলায় কথা বললে আটকে যেত।
দীর্ঘ দিন তুমি স্কুলে যাওনি। হাফইয়ার্লি পরীক্ষাও দেওয়া হয়নি। স্কুল থেকে কীভাবে সাহায্য পেয়েছ?
স্কুল যাব। স্কুলের ম্যাডামরা আমকে ভীষণ হেল্প করেছেন। হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা চলে গেছে। সেটা আমি দিতে পারিনি। ম্যামেরা আমাকে বলেছেন, 'তুমি এখন যেটা নিয়ে আছো সেটা করো। পড়াশোনাটা এসে করবে। কিন্তু চ্যাপ্টার কমপ্লিট করতে হবে। নেক্সট এক্সাম তোমাকে দিতে হবে। একবারে ফাইনাল দেবে'।
ওই যে ব্রেষ্ট ফ্রেন্ড হয়েছে, সে কে?
ওখানে গিয়ে আমি একজন বেষ্ট ফ্রেইন্ড পেয়েছি। বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের অঙ্কনা দিদি। ওখানে আমার বয়সী কেউ ছিল না। যাঁরা ছিল, তাঁরা কম্পিটিশন থেকে ছিটকে গিয়েছিল। প্রথমে আরোহী, উর্গেন ছিল। তারা চলে যাওয়ায় আমরা আরও বেশি কাছাকাছি আসি।
একজন বাঙালি হিসাবে প্রথম হওয়া। কোনও সংশয় ছিল?
প্রথমে আমরা ৫ জন বাঙালি ছিলাম। একটা সংশয় ছিল, পাঁচজন বাঙালির মধ্যে দু'জন ফিনালে যাবে! সেই দুজন কে! আমি ভাবিনি যে আমি নিজের জায়গা করে নিতে পারব।
তোমার মা বললেন, তুমি দেড় বছর বয়স থেকেই মায়ের সঙ্গে গুনগুন করে গান গাইতে। মায়ের কাছে কতটা সাহায্য পেয়েছিলে?
(একটু ভেবে) ছোট বেলার গানের কথা সবটাই আমার মনে আছে। বাচ্চাদের গান যেমন হয় আরকি...যেমন ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে, ব্যাঙের ছাতা ধরে ধরে গান করতাম। ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে আমার প্রিয় গান ছিল। আমার মায়ের মোবাইল ফোনে একটা গান হত, আনন্দধারা বহিছে ভূবনে। ওই গানটা শুনে আমি একা একা তুলেছিলাম। সেটা মাকেও শেখাতে হয়নি। একেবারে নিজেই করেছিলাম গানটা।
মায়ের কাছে কতটা সাহায্য পেয়েছিলে?
মা আমাকে রেওয়াজ করাতো। সারেগামাপাধানিসা..। ওগুলো থেকেই আমার গানের ইচ্ছাটা তৈরি হয়েছিল।
রেওয়াজ কতটা দরকার?
রেওয়াজ করতেই হবে। রেওয়াজ না করলে গলা খারাপ হয়ে যাবে। রেওয়াজ না করলে গানের ওয়ার্ডগুলো ভাল শোনা যাবে না। রেওয়াজ করাটা তাই ভীষণই প্রয়োজন।
হিমেশ কী বলল প্লে ব্যাক নিয়ে?
হিমেশ আমাকে বলেছেন, আমি তোমাকে দিয়ে গান করবো। এর মধ্যে ছোটদের যদি কোনো গান থাকে তবে তো কোনও কথাই নেই। না হলে জলদি জলদি বড় হয়ে যাও, তোমাকে দিয়েই সেই প্লেব্যাকে করাব।
ক্লাাসিক্যাল বেস হওয়ায় তেমন কোনও সুবিধা হয়েছে?
তা হয়েছে। তবে আমাকে সব নয়ের দশকের গান দেওয়া হয়েছিল। ক্লাসিকাল শিখতাম বলে আমার আরও সুবিধা হয়েছে। ওখানে সবাই ক্লাসিক্যাল শেখে। যারা ক্লাসিক্যাল করত না, তারাও ভালো গান করত। ওখানে স্নেহা বলে একজন ছিল, সে ক্লাসিকে, আর আমি ক্লাসিক্যালে বেস্ট ছিল। আমাকে ক্লাসিক্যাল গান দিত না। যেহেতু আমি ৯০ দশকের গান গাইতাম। পুরোটাই ৯০ দশকের গান করেছি।
কাদের গান বেশি করেছ?
লতাজি, আশাজি আর অলকা ইয়াগনিকজির গান বেশি ছিল। তবে দু'-একটা অনুরাধা পাড়োয়ালজি ও কবিতা কৃষ্ণমূর্তিজির গানও আমি গেয়েছি।
সুপারস্টার সিঙ্গার হয়ে তোমার পরিচিত বেড়েছে। সামনে অনেক লড়াই। ছোট্ট পুটু কি ভাবছে?
আমাকে আরও পরিশ্রম করতে হবে। আরও এগোতে হবে। আরও রেওয়াজ করতে হবে। কম্পিটিশনে আমায় জিততে হবে। আমি চেষ্টা করছি পুরো জান দিয়ে যাতে অন্তত একবার প্লে-ব্যাক করতে পারি। ইতিমধ্যে হিমেশজি অঙ্কনা, নিষ্ঠাকে প্লে-ব্যাকের সুযোগ করে দিয়েছেন। আমাকে বলেছেন, ওরা যেহেতু বড়, তাই ওরা প্লে-ব্যাকের জন্য তৈরি। কিন্তু আমি অনেক ছোট। হিমেশজি বলেছেন, ছোটদের যদি কোনো সিনেমা থাকে, সেখানে তোমাকে অবশ্যই সুযোগ দেবেন। আর ছোটদের যদি কোনো গানের সুযোগ না আসে, তুমি জলদি জলদি বড় হয়ে যাও তোমাকে প্লেব্যাকে নিয়ে নেব।
সাক্ষাৎকার শেষে কয়ামত সে কয়ামত তকের সুপারহিট সেই গান- তুমভি আকেলে, আমভি আকেলে... সেই অনবদ্য সুর শোনা গেল প্রীতির গলায়।
প্রীতির বাবা প্রিয়ত ভট্টাচার্য পেশায় ব্যবসায়ী। মুম্বাইতে ৫-৬ মাস প্রীতির সবসময়ের সঙ্গী ছিলেন তার মা প্রিয়া। প্রিয়া জানালেন, ৫ বছর বয়স থেকে মেয়ে গানে তালিম নিচ্ছে অধ্যাপিকা তাপসী ঘোষের কাছে। ছোটবেলায় মায়ের গলার সঙ্গে সুর মিলিয়ে গান করত প্রীতি। তখন গলা শুনেই মনে হয়েছিল পুটুর মিউজিক খুবই পছন্দ, বললেন প্রিয়াদেবী।