Advertisment

ওড়নায় মুখ ঢেকে নয়, ঝলসানো মুখেই লড়াই জারি অ্যাসিড আক্রান্ত মনিষার

এই লড়াইয়ে চোখে জল এনে দিতে বাধ্য।

author-image
Sayan Sarkar
New Update
কলকাতায় অ্যাসিড আক্রান্তদের সঙ্গে আড্ডায় শাহরুখ", মনীষা পৈলান, manisha pailan, চিৎকার ফাউণ্ডেশন, অ্যাসিড আক্রান্ত, মনীষা পৈলান, monisha pailan, manisha pailan, acid attack survivor, মনীষা পৈলান, অ্যাসিড আক্রান্ত, ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প

ওড়নায় মুখ ঢেকে নয়, ঝলসানো মুখেই লড়াই জারি অ্যাসিড আক্রান্ত মনিষার

অ্যাসিড ক্ষত মুছে সমাজের মুলস্রোতে ফিরে আসতে ‘চিৎকার’! অ্যাসিড হানা রুখতে জারি মনীষার লড়াই। সেদিনের সেই অভিশপ্ত রাতটা কিছুতেই ভুলতে পারছেন না দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগরের লড়াকু মেয়ে মনীষা। অ্যাসিড ক্ষত পুড়িয়ে দিয়েছে গোটা মুখ, কেড়ে নিয়েছে দৃষ্টি। দমিয়ে রাখতে পারেনি অদম্য মনের জেদ আর তার উজ্জ্বল হাসি।

Advertisment

সালটা ২০১৫, শীতের রাতে বাড়ি ফেরার পথে অ্যাসিড হামলার শিকার হন সে-দিনের বছর ২০-এর মেয়েটি। শরীর জ্বলে যেতে শুরু করে মনীষার। সেই মুহূর্ত থেকেই শুরু হয় তাঁর ও পরিবারের যন্ত্রণার দীর্ঘ পর্ব। মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে মারে তারই পুর্ব পরিচিত সেলিম হালদার।  অ্যাসিড ক্ষত রুখতে পারেনি মনীষা পৈলানের জীবন যুদ্ধ। বয়স ২৮-এর নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে মনীষা ছোট থেকে স্বপ্ন দেখতেন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। কিছুটা খাম খেয়ালি স্বভাবের মনীষার আজ অ্যাসিড আক্রান্তদের পাশে দাঁড়াতে ভরসা ‘চিৎকার’।

উদ্দেশ্যের কথা বলতে গিয়ে মনীষা বলেন, “আমাদের মূল উদ্দেশ্য এই হামলার প্রতিকার ও প্রতিরোধে লাগাতার প্রচার চালিয়ে যাওয়া। আমরা জানি বর্তমানে এই হামলা অনেক বেড়ে গেছে। তাই আমাদের এই প্রচার অনেক বেশি চালিয়ে যেতে হবে যাতে প্রত্যেকটা মানুষ, ছাত্র-ছাত্রী শিশু অবদি এই হামলা সম্পর্কে সচেতন হয়”।

ইতিমধ্যে 'চিৎকার' -এর বেড়েছে অনেকটাই। চলতি মাসের প্রথমে অ্যাসিড হামলা নিয়ে সচেতনতা প্রচারে ‘চিৎকার’ পৌঁছে গিয়েছিল কলকাতা সুরেন্দ্রনাথ কলেজে। ছিলেন অ্যাসিড আক্রান্ত আরও এক তরুণী সঞ্চয়িতা যাদব। অনুষ্ঠান সম্পর্কে মনীষা জানিয়েছেন, “মূলত রাজ্যে যেভাবে অ্যাসিড হামলা দিন দিন বেড়ে চলেছে সেই নিয়ে কথা এবং প্রত্যেকটা অপরাধী কিভাবে অবাধে ঘুরে বেরাচ্ছে অন্যদিকে আক্রান্তরা নানান ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সেইসব ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা আলোচনার মূল বিষয় হয়ে উঠেছিল। অন্যদিকে খোলা বাজারে যেভাবে বেআইনি অ্যাসিড বিক্রি হচ্ছে, তা নিয়েও বিশেষ সচেতন করাটাও আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল”।

নিজের জীবনেও প্রতিনিয়ত লড়াই জারি রয়েছে মনীষার। দীর্ঘ আট বছর পেরিয়েছে। আজও সুবিচারের আশায় দিন গুনছেন মনীষা। ‘দিব্যি চোখের সামনেই সুখের সংসার করছে ছেলেটা। আর সেদিনের সেই একটা মুহূর্ত আমার জীবনকে বদলে দিয়েছে। আজ প্রচুর মানুষের ভালবাসা পাচ্ছি। অনেকেই আমার সঙ্গে আছেন। কিন্তু সেই দিন একা জ্বলে যাওয়া শরীরে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি অ্যাসিডের ক্ষত’, কাপা গলায় একটানা কথাগুলো বলে গেল অ্যাসিড আক্রান্ত মনীষা।

আজও গ্রাম গঞ্জে হামেশাই ঘটে চলেছে অ্যাসিড হামলার ঘটনা। সেই বিষয় তুলে ধরে মনীষা নিজের জীবন সম্পর্কে বলেন, 'আমার নিজের ক্ষেত্রে আট বছর ধরে জারি রয়েছে আইনি লড়াই। অনেক মেয়েই আছেন যারা এতদিন ধরে আইনি লড়াই চালিয়ে যেতে পারেন না। সেক্ষেত্রে অ্যাসিড হামলা যারা করছেন তাদের কঠোর শাস্তি একমাত্র এই ধরণের হামলা রুখে দিতে পারে’।

কলকাতায় অ্যাসিড আক্রান্তদের সঙ্গে আড্ডায় শাহরুখ
ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প

নিজের জীবনের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করে মনীষা বলেন, ‘‘যেহেতু আমার বাড়ি একটু গ্রামের দিকে, আর আমি নিন্মবিত্ত পরিবারের মেয়ে, আমাদের গ্রামে অনেকে মেয়েরই ক্লাস সিক্স বা সেভেনে পড়তে পড়তে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমি কোনওদিন ভাবতেই পারতাম না নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে বিয়ে করব, চাকরি নিজে পায়ে দাঁড়ানোটা আমার লক্ষ্য ছিল। যে ছেলেটি আমাকে অ্যাসিড ছুঁড়ে মারে আমাকে যখন বিয়ের প্রস্তাব দিল, ‘না’ বলে দিয়েছিলাম। ছেলেটা আত্মহত্যার নাটক করে। তার মধ্যে বি.এ. পাশ করেছি। এক শীতের সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে ও আমার মুখে অ্যাসিড ছুড়ল। যন্ত্রণায় গোটা শরীরটা যেন অবস হয়ে গিয়েছিল। পুলিশের ওকে ধরতে সময় লেগে গেল ২ বছরের বেশি। ১০ দিনের মাথায় ও জামিন ও পেয়ে গেল। এখন দিব্যি সংসার করছে ও। আমার জীবনটা নষ্ট করে দিল।’ ‘আগে ভাবতাম এই সব নিয়ে। এখন আমার পোড়া এই মুখই আমার ও অন্যদের চলার অনুপ্রেরণা। অনেক মানুষকে আমার এই লড়াইয়ে পাশে পেয়েছি। তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ'।

অ্যাসিডের ঝাঁঝালো কেমিক্যাল নষ্ট করে দিয়েছে একটা চোখ, বিকৃত হয়ে গেছে মুখের চামড়া, দিনের পর দিন হাসপাতালে যন্ত্রণাভোগ করেছেন একা একা। সেই যন্ত্রণাই ক্রমশ তাঁকে ভিতর থেকে কঠিন করে তুলেছে। ওড়নায় মুখ ঢেকে নয়, পুড়ে যাওয়া মুখেই সোশাল মিডিয়াকে অবলম্বন করে অ্যাসিড ক্ষত মুছে সমাজের মুলস্রোতে ফিরে আসতে ‘চিৎকার’হয়ে উঠেছে তাঁর লড়াইয়ের অন্যতম হাতিয়ার।

লড়াই জারি রেখে সমাজের আরও পাঁচটা অ্যাসিড আক্রান্তের পাশে আজ দাঁড়িয়েছেন তিনি। জারি রেখেছেন তাঁর হাড় না মানা লড়াই। সে প্রসঙ্গে মনীষা জানিয়েছেন, ‘‘সব কিছু মুখ বুজে মেনে নেব বলে আমি বেঁচে ফিরে আসিনি, অ্যাসিড আক্রান্তদের পাশে থাকার অঙ্গীকার ও যারা এই কাণ্ড ঘটাচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমার সঙ্গী আমার ‘চিৎকার’।  

মনীষা পৈলান নামটার পাশে ‘অ্যাসিড আক্রান্ত’ শব্দটা নিতান্তই বেমানান। ওটা মনীষার পরিচয় নয়। বরং সমাজের বুকে একটা অস্বস্তি ও। উচ্ছল, চনমনে মেয়েটাকে দেখলেই পিতৃতন্ত্র-এর যেন একটা ভয় হয়। এত কিছু করে, মুখ পুড়িয়ে, একটা চোখ নষ্ট করে দিয়েও এতটুকু মাথা হেট করানো গেল না? আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরল না একটুও! মনীষার গল্প যেন এক ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প।

acid attack
Advertisment