Advertisment

মৃত্যু কেড়েছে স্ত্রীর আশা! মা-হারা একরত্তিকে বুকে আগলে সোনালী স্বপ্নের জাল যুবকের

পরীক্ষায় পাশ করেও মেলেনি চাকরি। একরাশ যন্ত্রণা বুকে নিয়েই অকালমৃত্যু হয় তরুণীর।

IE Bangla Web Desk এবং Nilotpal Sil
New Update
Subrata Khorat of Jamalpur is trying to make her daughter highly educated

আদরের মেয়েকে হারমোনিয়ামের তালিম বাবার।

শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষায় পাশ করেও দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিতই হয়ে থাকতে হয়েছে। প্রতিবাদ দেখিয়ে কলকাতায় গান্ধীমূর্তির পাশের ধরনামঞ্চে নিজের মস্তকমুণ্ডন করেছেন বঞ্চিত এক চাকরি প্রার্থী। শিক্ষিকা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর উচ্চ শিক্ষিতা রাসমণি পাত্রের এহেন প্রতিবাদ বঙ্গ রাজনীতিতেও তোলপাড় ফেলে দেয়। এরপরেই প্রকাশ্যে আসে 'টেট' উত্তীর্ণ হয়েও শিক্ষিকা না হতে পারার আক্ষেপ বুকে নিয়ে এক উচ্চ শিক্ষিতার জীবনযুদ্ধে হার মানার বেদনাতুর কাহিনী। মুনমুন ঘোষ নামে ওই কর্মপ্রার্থীর আক্ষেপ পূরণের জন্য তাঁর স্বামী এখন তাঁদের একমাত্র মেয়েকে উচ্চশিক্ষিত করে তোলার কঠিন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। যে সংগ্রামের কাহিনীই হয়তো আগামী দিনের হবু শিক্ষকদের কাছে প্রেরণার অন্যতম ভিত্তি হয়ে উঠবে।

Advertisment

স্কুল জীবন থেকেই লেখা পড়ায় নিজের মেধার পরিচয় দিয়ে গেছেন মুনমুন ঘোষ। পূর্ব বর্ধমানের মন্তেশ্বরের উজনা গ্রামের এক প্রান্তিক চাষি পরিবারের মেয়ে মুনমুন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর স্তর উত্তীর্ণ হয়েছেন। এরই পাশাপাশি সাফল্যের সঙ্গে তিনি 'বি-এড'
কোর্সও সম্পূর্ণ করেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল স্কুল শিক্ষিকা হওয়ার। সেই স্বপ্ন নিয়েই তিনি ২০১৪ সালে প্রাইমারি 'টেট' পরীক্ষা দেন। তাতে তিনি কোয়ালিফাইও করেন। তার পর থেকেই তিনি চাকরির আশায় বুক বেঁধেছেন।

এরই মধ্যে আর পাঁচটা বাবা-মায়ের মত মুনমুনের বাবা-মাও তাঁদের মেয়েকে পাত্রস্থ করার ব্যাপারে মনস্থির করে ফেলেন। সেইমতো ২০১৯ সালে জেলার জামালপুরের জাঙ্গিরপুর গ্রামের চাষি পরিবারের যুবক সুব্রত খোরটের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। ২০২০ সালে মুনমুন কন্যা সন্তানের মা হন। সেই কন্যা সুনয়নার বয়স এখন চার বছর ছুঁইছুঁই। সে এখন স্থানীয় অঙ্গনওয়াড়ি স্কুলে বর্ণ পরিচয়ের পাঠ নিচ্ছে।

মুনমুনের স্বামী সুব্রত খোরট বলেন, "আমি আমার স্ত্রী মুনমুনের মত উচ্চ শিক্ষিত নই। পরিবারের আর্থিক অবস্থাও ভালো নয়। আমি আর আমার বাবা নিমাই খোরটে মিলে পারিবারিক চার বিঘা জমি চাষ করি। তা থেকে সামান্য যা আয় হয় তা দিয়েই সংসার চলে। তবে এ নিয়ে আমার স্ত্রী মুনমুনের কোনও আক্ষেপ ছিল না। প্রাইমারি 'টেট' পরীক্ষায় কোয়ালিফাই করার পর যেহেতু একবার ২০১৬ সালে এবং তার পর ২০২১ সালের প্রথম দিকে ’ভাইবা’ হয়ে গিয়েছিল, তাই মুনমুনের প্রত্যাশা ছিল তাঁর চাকরিটা হবেই।"

publive-image

আদরের নাতনিকে বর্ণ পরিচয়ের পাঠ ঠাকুমার।

সুব্রত আরও জানান, চাকরির বেতনের টাকাতেই মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে উচ্চ শিক্ষিত করা ও সংসারের শ্রীবৃদ্ধি ঘটানোর ইচ্ছাই বারবার মুনমুন প্রকাশ করতো। কিন্তু বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও তা না হওয়ায় মুনমুনের আক্ষেপের অন্ত ছিল না।

আক্ষেপ বুকে নিয়েই মুনমুন স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি ও মেয়েকে নিয়ে সংসার সামলাচ্ছিলেন। তারই মধ্যে হঠাৎ করে ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে মুনমুনের জীবনে নেমে আসে এক ঘোর বিপদ। সুব্রত বলেন, 'তখন দেশজুড়ে করোনার দাপট চলছে। ওই বছরের জুন মাসে হঠাৎ করেই একদিন মুনমুন জ্বরে আক্রান্ত হয়। চিকিৎসার জন্যে ওঁকে ডাক্তার বাবুর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ওষুধ খেয়েও জ্বর কমে না। এদিকে জ্বরের মধ্যেই আবার তাঁর শ্বাসকষ্টও শুরু হয়। এই অবস্থায় আর কোনও ঝুঁকি না নিয়ে মুনমুনকে বর্ধমানের একটি নার্সিংহোমে ভর্তি করি। সেখানে টানা ১৫ দিন চিকিৎসা চললেও শেষ রক্ষা হয়নি। ওই বছরে ১৩ জুলাই মাত্র ৩০ বছর বয়সে মুনমুন জীবন যুদ্ধে হার মানে।'

মুনমুন যখন মারা যান তখন তাঁর মেয়ে সুনয়নার বয়স মাত্র দেড় বছর। সেই থেকে মাতৃহারা শিশুকন্যা সুনয়নাকে পরম স্নেহে লালন পালন করে চলেছেন তাঁর দাদু নিমাই খোরট, ঠাকুমা কল্পনাদেবী ও বাবা সুব্রত। কল্পনাদেবী বলেন, “আমার বৌমা রুপে ছিল লক্ষ্মী আর গুণে ছিল সরস্বতী। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস আর বঞ্চনার কারণে ’টেট’ উত্তীর্ণ অনেক যোগ্য চাকরিপ্রার্থীর মত আমার বৌমারও স্কুল শিক্ষিকা হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। সেই আক্ষেপ বুকে নিয়েই অকালে আমার বৌমাকে চলে যেতে হল।"

আরও পড়ুন- Premium: নেশা-পেশায় জোকারওয়ালা, দু’দশক ধরে কলকাতায় বড়দিনে সান্তা ফেরি সেলিমের   

কল্পনাদেবী ও নিমাইবাবু একই সুরে জানান, তাঁদের পুত্রবধূর স্বপ্ন যাতে তাঁর মেয়ে পূরণ করতে পারে সেই জন্যে তাঁরা তাঁদের নাতনিকে উচ্চ শিক্ষিত করতে চান। তাঁদের ছেলে সুব্রতও তাই চায়। এখন নাতনি বর্ণ পরিচয়ের পাঠ নিচ্ছে। মুনমুন গান-বাজনা ভালোবাসতো তাই নাতনিকে একটা হারমোনিয়াম কিনে দেওয়া হয়েছে। বয়স্ক ওই দম্পতির কথায়, "ইচ্ছা রয়েছে একটা ভালো নামজাদা স্কুলে নাতনি সুনয়নাকে ভর্তি করার। কিন্তু বাধা আসছে টাকা পয়সা নিয়ে।"

এদিকে এসব কথার ফাঁকেই কল্পনাদেবী রাজ্যের শাসকদলের বিরুদ্ধেও ক্ষোভ উগরে দেন। তিনি বলেন , “২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে আমি তৃণমূলের প্রার্থী হয়ে ভোটে লড়ে জয়ী হই। দীর্ঘ পাঁচ বছর আমি জ্যোৎশ্রীরাম গ্রাম পঞ্চায়েতের নির্বাচিত সদস্য ছিলাম। আমার ছেলে সুব্রত বাম আমল থেকে সক্রিয় ভাবে তৃণমূল করছে। তাই বৌমার চাকরিটা যাতে হয়ে যায় আমি আর আমার ছেলে দলের অনেক নেতা, সাংসদ ও বিধায়কের কাছে অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু কেউ পাত্তা দেয়নি। এমনকী নাতনির ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমার ছেলেকে একটা কাজের ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্যেও দলের নেতাদের বলেছিলাম। কিন্তু সব নেতাদের কাছ থেকে শুধু প্রত্যাখ্যানই মিলেছে।"

আরও পড়ুন- রাজ্যজুড়ে ঠান্ডার ভরপুর আমেজ, ভরা শীতে কোন কোন জেলায় বৃষ্টির পূর্বাভাস?

সুব্রতও ক্ষোভ চেপে না রেখে বলেছেন, "তৃণমূলের নেতারা এখন দলের পুরনো কর্মীদের প্রত্যাখ্যানই করছেন। তবে আমি সংকল্প করেছি, যত কষ্টই হোক কায়িক পরিশ্রম করে অর্থ জোগাড় করে আমি আমার মেয়ে সুনয়নাকে উচ্চ শিক্ষিত করবই। কেননা টেট উত্তীর্ণ হয়েও আমার স্ত্রীর স্কুল শিক্ষিকা না হতে পারার আক্ষেপ আমার মেয়েকেই পূরণ করতে হবে।" এসব শুনে জামালপুরের বর্তমান তৃণমূল বিধায়ক অলক মাঝি জানিয়েছেন, দলের পুরনো ওই কর্মীর বাড়িতে গিয়ে তিনি খোঁজ-খবর নেবেন।

Purba Bardhaman TET West Bengal
Advertisment