১৮ বছর আগে গুরুদক্ষিণা ছিল ১ টাকা। এখন বেড়ে হয়েছে ২ টাকা। এটা বছরের হিসেবে। ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ৩০০-র ওপর। পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামের উত্তর রামনগরের 'সদাই ফকিরের পাঠশালা' এভাবেই জঙ্গলমহলে শিক্ষা প্রসারে নীরবে কাজ করে চলেছে। পদ্মশ্রী পুরস্কারের জন্য নাম বিবেচিত হওয়ায় অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল পাঠশালার শিক্ষক সুজিত চট্টোপাধ্যায়ের। দিল্লি থেকে যে নম্বর থেকে ফোন এসেছিল সেই নম্বর তাঁর মেয়ে শাশ্বতী মুখোপাধ্যায়কে দেন। ধানবাদের বাসিন্দা শাশ্বতীদেবী ওই ফোন নম্বরে ফোন করেন। মেয়ে কথা বলার পর সুজিতবাবু নিশ্চিত হন পদ্মশ্রী প্রাপকের তালিকায় তাঁর নাম আছে।
"গ্রাম বাংলার শিক্ষককে এভাবে সম্মান জানাবে সেটা খুব অভাবনীয় ব্যাপার। আগামী দিনে গ্রামবাংলায় যাঁরা নীরবে কাজ করছেন তাঁরাও এই ঘোষণায় উৎসাহিত হবেন।" এভাবেও যে জঙ্গলমহল থেকে কাউকে খুঁজে বের করে সম্মান জানানো যায়, সেই ঘোর মঙ্গলবারও কাটেনি সুজিত চট্টোপাধ্যায়ের। পদ্মশ্রী পুরস্কারের ঘোষণা শুনে স্থানীয় রামনগর হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে বলেন, "আসলে গ্রামবাংলার কথা কেউ তো ভাবে না। আমার ভীষণ আনন্দ হয়েছে। খুব খুশি হয়েছি। এই ধরনের পুরস্কার পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। বিশেষ করে আমাদের মত স্কুল শিক্ষকের ক্ষেত্রে। আমি একেবারে গ্রামাঞ্চলে বসবাস করি। আমরা জঙ্গলমহলের বাসিন্দা, আমাদের খুঁজে বের করে পুরস্কৃত করা সত্যিই অবিশ্বাস্য ব্যাপার।"
প্রায় ৪০ বছর রামনগর হাইস্কুল পড়ানোর পর ২০০৪-এ অবসর নেন সুজিত চট্টোপাধ্যায়। তখনও ঠিক কী করবেন সেই সিদ্ধান্ত নেননি তিনি। তবে অবসরের পর আর পাঁচজনের মতোন নয়, একটু অন্যরকম ভেবেছিলেন সুজিতবাবু। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে তিনি বলেন, "ভাবছিলাম আমি কী করব? একদিন পাঁচজন মাধ্যমিক পাস ছাত্রী ২০-২৫ কিলোমিটার দূর থেকে আমার বাড়িতে আসে. আমাকে পড়ানোর প্রস্তাব দেয়। আমিও ভাবতে থাকি পড়ালে কেমন হয়? ওরা জিজ্ঞেস করে মাইনে কত? ওরা দুস্থ পরিবারের, আমি যদি ওদের কাছে টাকা নিই তাহলে আর পড়াশোনা করতে পারবে না। আমি সেদিন বলেছিলাম গুরুদক্ষিণা এক টাকা এটা কিন্তু টিউশন ফি নয়। সেই শুরু সদাই ফকিরের পাঠশালা।" সায়েন্স ছাড়া সব বিষয় পড়ান মাধ্যমিক পর্যায়ে। উচ্চমাধ্যমিক ছাত্রছাত্রীদের পড়ান বাংলা ও সংস্কৃত। স্নাতকস্তরে বাংলা। এছাড়া দূরশিক্ষার ছাত্রছাত্রীরাও রয়েছে তাঁর পড়ার ব্যাচে।
কেন এই নাম? সদাই ফকির কোথা থেকে এলেন? ৭৮ বছরের সুজিতবাবু বলেন, "এছাড়া উপায় ছিল না। ছেলেমেয়েরা ভাবত আমার প্রচুর টাকা। তাই হয়ত টাকা নেয় না। ওদের মন থেকে এই ভাবনা দূর করতেই নাম দিলাম সদাই ফকিরের পাঠশালা। আমার তো সত্যিই টাকা নেই। আমার পেনশনের টাকায় সংসার চলে। "
সুজিতবাবু শুধু শিক্ষা বিস্তারের মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি এলাকার থ্যালাসেমিয়া আক্রান্তদের দিকেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। সেখানে তাঁর ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদেরকে তিনি উৎসাহিত করেছেন। লকডাউনের সময় ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে গ্রামের দুঃস্থ মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। অনেক সমাজসেবী সংস্থাও একাজে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন। তিনি শুধু পড়ান না তাঁদের সমাজসেবায় উদ্বুদ্ধও করেন সুজিতবাবু।
অবসরপ্রাপ্ত এই শিক্ষকের বড় আক্ষেপ এলাকায় কোন কলেজ নেই৷ দূরদূরান্তের কলেজে পড়তে যেতে হয় জঙ্গলমহলের ছাত্রছাত্রীদের। তিনি বলেন, "জেলার মন্ত্রী, জেলা পরিষদের সভাধিপতি, বিধায়কদের কাছেও কলেজ স্থাপনের জন্য আবেদন করেছি। কোনও সুরাহা হয়নি৷ এখনও আমার এটাই আবেদন। এলাকায় স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার একটি শাখা হলে ছাত্র-ছাত্রী সহ সাধারণ মানুষ উপকৃত হবেন।"
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন