ষাটের দশকে সত্যজিৎ রায়ের তৈরি, ‘চারুলতা’র প্রথম দৃশ্য মনে পড়ে? সিনেমার শুরুর প্রথমেই উঠে আসে ছবির কুশীলবদের নাম, তখন চারু ব্যস্ত থাকে স্বামী ভূপতির রুমাল সেলাইয়ে। তার নিপুণ সুচ-সুতো চালনায় এমব্রয়ডারি হুপ বা কাঠের বেড়ি বরাবর ইংরেজি অক্ষর ‘বি’র চার পাশ ঘিরে ফুটে ওঠে পাতার মোটিফ। শুধু চারুলতা বললে খানিক ভুল হবে। ‘পরশপাথর’, ‘মণিহারা’, ‘সমাপ্তি’ এবং ‘ঘরে বাইরে’ ছবিতেও সত্যজিৎ নিয়ে এসেছিলেন বঙ্গরমণীর এই অসাধারণ গার্হস্থ শিল্পকলাকে। বর্তমানে এই শিল্পকলা সম্বন্ধে অনেকে ওয়াকিবহাল নন। একটা সময় ছিল যখন সেলাইয়ের কাজ শেখা ছিল বাড়ির মেয়েদের বাধ্যতামূলক। উনিশ শতকের সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় হওয়া শিল্পটি আজ অনেকটাই অবলুপ্ত। সেলাইয়ের কাজ কেমন হয়, হয়তো এখন অনেকেই জানেন না।
এই অবলুপ্ত হয়ে যাওয়া শিল্পকে ৮৮ বছরের এক বৃদ্ধ আজও সযত্নে সংরক্ষণ করে যাচ্ছেন। নাম পরিমল রায়। ভবানীপুরের বাসিন্দা। পরিমলবাবুর সংগ্রহের মূল বিষয় সূচিশিল্প। উনিশ শতক এবং বিশ শতকের অত্যন্ত জনপ্রিয় হওয়া এক শিল্পকলা। পুরনো সেলাই শিল্প কেমন ছিল তা জানাতেই একের পর এক সংগ্রহের শুরু এই প্রবীণের। এই মুহূর্তে পরিমল রায় পূর্ব ভারতের সেরা এফেমেরা (ক্ষণস্থায়ী জিনিস) সংগ্রাহক। এই বয়সে এসেও এখনও সারাদিন খুঁজে চলেন হারিয়ে যাওয়া শিল্পকর্ম। এভাবেই খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গিয়েছেন অমূল্য এক সূচি শিল্প। সুকুমার রায়ের আবোল তাবোল। সুকুমার রায়ের লেখা আবোল তাবোলের সমস্তটাই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সেলাইয়ের মাধ্যেমে। এত নিখুঁত ভাবে সুক্ষ সুক্ষ কাজকে যে সুচ আর সুতো দিয়ে ফুটিয়ে তোলা যায় তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। পরিমল বাবুকে এই সেলাইগুলো সংগ্রহ করতে সাহায্যে করেছেন জয়ন্ত কুমার ঘোষ। জয়ন্তবাবু নিজেও একজন সংগ্রাহক। পেশায় ব্যবসায়ী। পরিমল বাবুকে নিজের গুরু বলে মনে করেন। জয়ন্তবাবুই বলছিলেন, "আমারা যতদূর মনে করছি সুকুমার রায়ের সমসাময়িক কিংবা তাঁর মৃত্যুর পরে কোন অজ্ঞাত শিল্পীর হাতে তৈরি করা এই সূচি শিল্প। এই শিল্পের বয়স কমপক্ষে আশি থেকে নব্বই বছর তো হবে। পরিমলবাবু আবোল তাবোলের প্রথম সেলাই করা ছড়াটি সংগ্রহ করেন বছর দশেক আগে। তখন থেকেই এর উৎস খুঁজে বের করার চেষ্টা শুরু করে দেন। প্রথমে একটা দু'টো করে সংগ্রহ করছিলেন। আমি জানার পর আমার আগ্রহ বাড়তে থাকে। আমিও ওনাকে সাহায্যে করতে থাকি।"
একটা সময় ছিল যখন বিবাহযোগ্য মেয়েদের বিয়ের পাত্রপক্ষের কাছে পরীক্ষা দেওয়ার সময় দু'টি প্রশ্ন অবশ্যই করা হত। ‘মা তুমি রাঁধতে জানো?’ আর ‘সেলাই-ফোঁড়াইয়ের কাজ পারো?’ যে মেয়ে ক’দিন পরে সন্তানের জন্য মোজা-কাঁথা তৈরি করবে, তাকে নমুনা হিসাবে তখন পেশ করতে হত সুচ-সুতোর কিছু কাজকর্ম। তাতে কখনও থাকত দেবদেবী বা মনীষীর ছবি, কখনও পশুপাখি, আবার কখনও কোনও কবিতার লাইন। দুর্ভাগ্যে মা ঠাকুরমার আমলের এসব জিনিস এখন আর তৈরি হবে না। যাদের বাড়িতে সেলাইয়ের কাজ রয়েছে সেগুলির প্রয়োজন এখন ফুরিয়েছে। বেশির ভাগই চলে গিয়েছে ফেরিওয়ালার ঝুড়িতে। এরকমই এক ফেরিওয়ালার ঝুড়ি থেকে পরিমল রায় খুঁজে বের করেছেন গার্হস্থ শিল্পকলাকে। জয়ন্ত বাবুর কথায়, "আমরা খোঁজ খবর নিয়ে যতটুকু জানতে পেরেছি এর শিল্পী এবং উত্তরসূরিরাও কেউ নেই। আমাদের ধারণা এই আবোল তাবোলকে সেলাইয়ের মাধ্যমে যে বা যারা করেছেন তা করতে অনেক বছর সময় লেগেছে। অনেক ধৈর্য আর ভালোবাসা না থাকলে এত সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলা যেত না। মূল অংশগুলো সংগ্রহ করেছি এ বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে। সব সংগ্রহ হয়ে যাওয়ার পর আমার অফিসের ছেলেদের সাহায্যে দেড়শ'র বেশী আবোল তাবোলের সেলাইকে ফ্রেমিং করতে পেরেছি। কিছু কিছু ডবল ফ্রেম করা হয়েছে। পরিমল বাবুর দশ বছরের চেষ্টায় আবোল তাবোলের দুশ'র বেশী সূচি শিল্পকে সংগ্রহ করা গিয়েছে। এই কাজে কলকাতা কথকতা চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, উজ্জ্বল সর্দার বাবুও অনেক সাহায্যে করেছেন আমাদের। এই শিল্পকর্মকে মানুষের সামনে তুলে ধরার জন্যে আমরা প্রদর্শনীরও আয়োজন করেছি।"
এই বছরেই আবোল তাবোলের ১০০ বছর, তেমনই সুকুমার রায়ের প্রয়াণেরও শতবর্ষ। সে উপলক্ষে নেহুরু মিউজিয়ামে আবোল তাবোলের এই সূচি শিল্পটির প্রদর্শনীর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জয়ন্ত কুমার ঘোষই এর মূল উদ্যোক্তা। সেলাইয়ের কাজ আগেকার দিনে কতটা গুরুত্ব সহকারে করা হত তা তুলে ধরার জন্যে এমন আয়োজন। আগামী ২০শে জানুয়ারি থেকে ৪ঠা ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নেহেরু চিলড্রেন মিউজিয়ামে চলবে প্রদর্শনী। সুকুমার রায়ের আবোল তাবোলের পাশাপাশি নেহেরু চিলড্রেন মিউজিয়ামে বাচ্চাদের নিয়ে অভিনব এক অনুষ্ঠান করা হবে।
আরও পড়ুন- কলকাতার বড়দিনের ঐতিহ্য, ৯৩ বছর ধরে তিলোত্তমায় কেকের কাব্য লিখছে সালদানা