Boatman Of Bengal: নদীমাতৃক বাংলায় একসময় নৌকাই ছিল আদি বাহন। নৌকোই জল আর মানুষের মধ্যে একটা সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মূল পথ প্রদর্শক। মানুষ যত উন্নত হয়েছে বদলেছে তাদের পুরনো আদব কায়দা। যান্ত্রিক সভ্যতার অতলে বিলীন হয়ে গিয়েছে গ্রাম বাংলার মনমুগ্ধকর সেই সব ছবি। কাইলেবাছারি, বালাম, খোরোকিস্তি, পানসি, মাসুলা, কোসা, ভেদী, পাটিয়া। এই নামগুলোর কোথা থেকে এসছে জিজ্ঞেস করলে অনেকে এখন মাথা চুলকাতে বসবেন! একেবারে যেন ভিনদেশি সব নাম! অথচ আপাত-অচেনা এই নামগুলো আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গেই জড়িয়ে ছিল মাত্র একশো বছর আগেও। এখন যা ভুলে যাওয়ার খাতার পাতায় নাম লিখিয়ে নিয়েছে এসব নামেরা।
কাইলেবাছারি, বালাম, কিংবা খোরোকিস্তি, এগুলো আসলে নানান ধরণের নৌকোর নাম। প্রতিবেশী দেশে এখনও এদের টুকটাক ব্যবহার রয়েছে। ডিজিটাল শহুরে জীবনে অবশ্য নৌকো টৌকার খবর এখন কে বা রাখে? হাওয়া খেতে বেড়িয়ে মাঝগঙ্গায় দু একটা নৌকা চোখে পড়লে খানিক ভালোলাগে বটে! ব্যাস ওইটুকু! এই পর্যন্ত সীমাবদ্ধ আমাদের আদি বাহনের প্রতি ভালোবাসা। এমন সময়ে এই ভালবাসাকেই আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছেন মাঝ বয়স্ক লোক। যিনি, সুজলাং সুফলাং বাংলার নৌকোর-কথা বলে চলেছেন এ যান্ত্রিক শহরে বসেই। নাম স্বরূপ ভট্টাচার্য, পেশায় নৃতত্ত্ববিদ। আজ তারই গল্প বলবো।
নৌকোর ইতিহাস অনেক পুরনো। পৃথিবীর তিন ভাগ জল এক ভাগ স্থল। এই একভাগ স্থলেই মানুষ গড়ে তুলেছে নিজস্ব সভ্যতা, সংস্কৃতি। নৌকা বা নাও এই জলযানই হয়ে ওঠে সভ্যতা গড়ে ওঠার প্রধান অঙ্গ। তা সে ডিঙি হোক কিংবা বিশালায়তন ময়ূরপঙ্খী। জল এবং স্থলের মধ্যে যোগাযোগস্থাপন করতে নৌকোই ছিল ভরসা। সভ্যতার শুরু থেকে নৌপথ ছিল যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম। তাই ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, প্রতিটি সভ্যতা গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করে। তাই ময়ূরপঙ্খী, সুলতানি, বজরা, ডিঙি, খেড়ো, ডোঙ্গা, পানসি, এমন কত নামের নৌকো বাংলার নদীর বুকে একসময় ভেসে বেড়াত। সেইসব নৌকোর ছিল আলাদা আলাদা ব্যবহার, আলাদা আলাদা গড়ন। বিশ্ব জুড়ে নৌকো ঘিরে গড়ে ওঠা হরেক সংস্কৃতি, ইতিহাস গ্রাম-গ্রামান্তরে, দেশ-দেশান্তরের এসবেরই ইতিহাসই খুঁজে বেড়ান নৌ গবেষক স্বরূপ ভট্টাচার্য। বলতে গেলে, নৌকোই তাঁর আবেগ, প্রেম একমাত্র ভালোবাসা। আবার নৌকোই তাঁর জীবনচর্যা, গবেষণাও বটে।
ছাদে টিনের ছাউনি দেওয়া ছোট্ট টেবিলটা তাঁর কাজের জায়গা। বলা যেতে পারে এখানেই লুকিয়ে ইতিহাসের খনি। টেবিলে সাজানো নৌকার রেপ্লিকা। যা স্বরূপ বাবুই তৈরি করে রাখছেন। পুরো ছাদ-জুড়ে বিভিন্ন আকারের সব নৌকা। কাজ করতে করতে বলছিলেন, "আমাদের নদীমাতৃক দেশ। এখন নদীকে অন্য কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। আমরাও চাইছি নদীর জলকে অন্য কোনও কাজে লাগাতে। ফলে নদীতে নাব্যতা কমে যাচ্ছে। যে নৌকা চলতে পারতো তাও আটকে যাচ্ছে। এমন আরও অনেক জিনিস চারপাশে হচ্ছে। যেমন ধরি, সুন্দরবন থেকে গড়ান কাঠ এবং গোলপাতা নিয়ে আসার একটা নৌকা ছিল। নৌকোটার নাম 'বেতনাই'। বেতনাই নৌকা আর বানানো হয় না। কারণ গোলপাতা নিয়ে আসা আর হয় না। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে বারণ আছে গোলপাতা নিয়ে আসার। ফলে সেই নৌকার আর প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এটা বুঝতে পারলাম শুধু একটা নৌকা শুধু সেই কাজের জন্যেই ব্যবহৃত হয়। রান্নাঘর যেমন শুধু রান্নার কাজের জন্যেই ব্যবহার হয়। ঠিক সেই রকম প্রত্যেক নৌকার এক একটা বিশেষত্ব রয়েছে। নিদিষ্ট অঞ্চলে সেটা বানানোর একটা কৌশল আছে। যদি সেই নিদিষ্ট কাজটাই বন্ধ হয়ে যায় তবে নৌকাটার গুরুত্ব হারিয়ে যাবে। ঠিক যেমনটা এখন হচ্ছে।"
স্বরূপ ভট্টাচার্যের ঘরদোর জুড়ে নৌকার যেসব রেপ্লিকা রয়েছে তার বেশীরভাগই এখন হারিয়ে গিয়েছে। প্রতিটি মডেল দেখাতে গিয়ে বলছিলেন নৌকোর মাপ, কোথায় সেসব ব্যবহার হয় বা একসময় হতো, কতদিন আগে কি কাজে ব্যবহার করা হত, তার তথ্যপঞ্জি। একই ধরনের যাত্রীবাহী অথবা মালবাহী নৌকোর চেহারা আবার অঞ্চলবিশেষে একেক রকমের হত। উত্তর এবং দক্ষিণবঙ্গের নদীর নাব্যতা আলাদা হওয়ায় তাদের নির্মাণশৈলীও আলাদা। পূর্ববঙ্গ-পশ্চিমবঙ্গেও রয়েছে তেমন ফারাক। আবার খালবিলে যে নৌকো চলে, তার সঙ্গে বিস্তর ফারাক উপকূলবর্তী অঞ্চলের নৌকোর। মাছ ধরার জন্য তৈরি নৌকো (ফিশিং বোট) আর প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্য তৈরি নৌকো বাইচের ধাঁচও একেবারেই আলাদা। এমনকি সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাংলার নৌকা বাইচ।
বাইচ খুব পুরনো একটা খেলা, গ্রামীণ খেলা। কিন্তু, যা অবাক করার মতন তা হল গ্রাম বাংলায় এই খেলা নিয়ে এত মাতামাতি। অথচ দেশজ এই খেলা নিয়ে শহরের মানুষের কোনও ধারনাও নেই। এমনকি এই খেলা কবে থেকে শুরু? কি তার ইতিহাস? আমাদের কাছে তার তথ্যই নেই। কম্বোডিয়া, চিন, ভিয়েতনামে নৌকা বাইচ খেলা হয়। কেরলায় আজও এই খেলা হয় জাঁকজমকপূর্ণভাবে। এমনকি ব্রিটিশরাও এই খেলাটিকে অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ চালু করেছিল। ওখানকার নাম 'বোট রেস'। যদিও বাইচ খেলা বোট রেস সামান্য আলাদা। বর্ষায় মালঞ্চ, কচুখালী, ন্যাজাট, সূর্যবেড়িয়ার মতো সুন্দরবনের বেশ কিছু জায়গায় এখনও বাইচখেলা দেখা যায়।
"নৌকা বানানো হত শাল আর সেগুন কাঠে। শাল আর সেগুন কাঠ এখনও পাওয়া যায় তবে ভীষণ দাম। ফলে এই কাঠের নৌকাগুলো হয় না বললেই চলে। কিছু সেগুন কাঠ বিদেশ থেকে আসে তবে দাম অনেক পড়ে যায়। এখন বেশীরভাগ নৌকা তৈরিতে ব্যবহার হয় লোকাল কাঠ। এই যেমন অর্জুন, বাবলা, খিরিশ, জিলাপি এইসব কাঠ। এখন ব্যক্তিগত কাজে আমোদ প্রমোদে নৌকো ব্যবহার আর হয় না। যার ফলে ময়ূরপঙ্খী, বজরা এসব নৌকাগুলো আর দেখা যায় না। এখন যা চলে তা সব ডিঙ্গি নৌকা।" নৌকা নামক জলযান কথা বলতে গিয়ে একের পর এক এসব বলছিলেন, স্বরূপ বাবু। কবি মনসামঙ্গলে বিশ্বকর্মাকে দিয়ে সমুদ্র যাত্রার উপযুক্ত সপ্তডিঙ্গা বানিয়েছিলেন বলে কথিত। সেই বিশ্বকর্মা বা নৌকো কারিগরদের জীবন ও কাজ স্বরূপবাবু কাছের থেকে দেখে যাচ্ছেন। সভ্যতার আদিম যানের প্রতি স্বরূপ ভট্টাচার্যের ভালোবাসা তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতন। ভালোবাসার টানেই ভবিষ্যতের জন্যে তৈরি করে যাচ্ছেন বাংলার নৌকা সংস্কৃতির এক অমূল্য আর্কাইভ।
আষাঢ় ও শ্রাবণ মাস এলেই বাংলার খাল বিল, নদী-নালাগুলো জলে ভরে যায়, বেড়ে যায় বৃষ্টির পরিমাণ। নদীমাতৃক দেশে নৌকা প্রাচীন ও জরুরি বাহন। বর্তমানে হাতেগোনা দু-একটা পালের বাদামী নাও চোখে পড়লেও নৌকায় আগের মত আর মানুষ ওঠে না। নতুন বউ শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য পালতোলা নৌকার বায়না আর ধরে না। রংবেরঙের পাল খাটিয়ে পণ্যের পসরা সাজিয়ে ভাটিয়ালির সুরের তালে তালে ভেসে বেড়ানো সওদাগরী বহর আর দেখা যায় না। কবি সাহিত্যিকরা পালের নাউকে উপজীব্য করে যুগে যুগে রচনা করেছিলেন কবিতা, গল্প, ছড়া, গান। আজ সবই অতীতের স্বর্ণযুগের পাতায় তোলা। এখন নদীর বুকের জল শুকিয়েছে। ভেসে চলা আদরের নৌকাদের পড়ে আছে হাড় পাঁজর। আর এই নিয়েই দিব্যি ভালো আছেন স্বরূপ ভট্টাচার্য আর তার আদরের নৌকারা।