কলকাতায় তখনও ক্যামেরা নিয়ে এত মাতামাতি ছিল না। সাহেব সুবোধরা একটা যন্ত্রের সাহায্যে মানুষের ছবি তুলতে পারে তা সবে এই দেশের মানুষ জেনেছে। সময়টা দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি। জাপানিরা যুদ্ধের ছবি তোলার জন্যে ১৯৩০ সালে তৈরি করল ৮ এমএমের মিনিয়েচার স্পাই ক্যামেরা। কলকাতা শহরে তখন নতুন নতুন আমদানি হয়েছে নতুন এই যন্ত্রের। তাতে চলমান ছবি ধরে রাখা যায়। আজকের মতো তো তখন হাতের মুঠোয় ভিডিও রেকর্ডিং-এর ব্যবস্থা ছিল না।
ঢাউস সেই যন্ত্র চালানো ছিল রীতিমতো হাঙ্গামা। কীভাবে চলত সেই ক্যামকর্ডার? বৈদ্যুতিক শক্তিতে নয়, তখনকার ক্যামকর্ডার চলত চাবি ঘুরিয়ে দম দেওয়া শক্তিতে। ইতিহাস ঘাঁটলে ক্যামেরা নিয়ে এইসব তথ্য টুকটাক জানা যায়। যারা ছবি তুলতে কমবেশী ভালবাসেন তাঁদের কাছে এসব ক্যামেরা চাক্ষুষ করা মানে জীবন সার্থক। কিন্তু চোখের সামনে এসব ক্যামেরা দেখা, আজকে দিনে একরকম কল্পনার অতীত বৈকি! আর এইসব কল্পানাতীত ক্যামেরায় সযত্নে আগলে রেখেছেন তাপস কুমার বসু।
অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মচারী তাপসবাবুর বয়স ৭৪ বছর। পুরানো ক্যামেরা, গ্রামফোন, ভিসিআর বা ওয়াকম্যান, যাকে আমি আপনি আবর্জনা বলে মনে করি তাপস কুমার বসুর কাছে তা অমূল্য সম্পদ। উত্তর কলকাতার এই বাসিন্দা ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সংগ্রহ করে চলেছেন নানা জিনিস। তাঁর সংগ্রহের প্রধান সামগ্রী ক্যামেরা। আদি থেকে আধুনিক ক্যামেরার যে বিবর্তন মোটামুটি সব ক্যামেরা সংগ্রহ করে রাখাই তাঁর একমাত্র শখ। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিজ্ঞানের যে উন্নতি হয়েছে তা ক্যামেরার বিবর্তন দেখলেই বোঝা যায়। প্রথম পিনহোল ক্যামেরা থেকে বর্তমান সময়ের ডিএসএলআর সিসিক্যামেরা সবই তিনি তাঁর সংগ্রহে রেখেছেন।
কীভাবে শুরু হয় ক্যামেরা সংগ্রহের নেশা? সংগৃহীত ক্যামেরাগুলোর পাশে বসেই তাপসবাবু বলেন, "আমার শখটা এল খুব আকস্মিক ভাবে, আমি তখন খুব ছোটই ছিলাম স্কুল জীবনের কথা বলছি, আমারা তখন থাকতাম পূর্ব মেদিনীপুর। বাড়িতে দুর্গাপূজার আগে ঘর গোছানোর সময় একটি বড় বাক্স খুঁজে পায়।
ওই বাক্সের মধ্যে ছিল পুরনো কয়েকটি ক্যামেরা, পুরনো হাত ঘড়ি, কিছু ফাউন্টেন পেন, প্রাচীন মুদ্রা, দেশলাইয়ের বাক্স, এগুলো খুঁজে পেয়ে মাত্র আমি অতি আগ্রহে নিজের সংগ্রহে রেখে দিয়েছিলাম। বাড়িতে সকলকে জানিয়ে দিলাম এখন থেকে আমি এসব সংগ্রহ করবো। এভাবেই আমার সংগ্রহের নেশা শুরু।"
আরও পড়ুন- পাহাড়ের কোলে ছবির মত সাজানো ছোট্ট গ্রাম, গেলে ফিরতে মনই চাইবে না
চারতলা ফ্ল্যাটের তিনকামরার ঘরের একটি ঘর জুড়ে শুধু ক্যামেরা আর লেন্স। যতটুকু পেরেছেন সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছেন সব ক্যামেরা। দেওয়াল জুড়ে হরেক রকম আদ্যিকালের ঘড়ি। এই ঘরকে দেখলে হঠাৎ জাদুঘর বলেই মনে হবে। কারণ ঘরজুড়ে দুর্লভ সব জিনিস। যার মধ্যে নজর কাড়ে বিভিন্ন মডেলের ক্যামেরা। সব থেকে পুরনো পিনহোল ক্যামেরা। এ ছাড়া ১০০ বছর বা তারও আগের মডেলের কয়েকটি ক্যামেরাও তাঁর সংগ্রহে আছে। এর বাইরে আছে জাপানি ব্র্যান্ডের ইয়াসিকা, ক্যানন, কোসিনা, নিকন, ফুজি ফিল্ম, পেনট্যাক্সসহ নানা দেশের বিভিন্ন সময়ের নামীদামি ব্র্যান্ডের ক্যামেরা। এইসব ক্যামেরা গুলো তিনি কীভাবে সংগ্রহ করেন?
তাপস বসু জানান, "কিছু ক্যামেরা কেনা হয়েছে এবং কিছু লোকেদের থেকে উপহার পেয়েছি। এটি কোনও ব্যয়বহুল শখ নয় ইচ্ছে থাকলে সকলেই সংগ্রহ করতে পারে" ২০১২ সালে, পরিচালক ঋতুপর্ণা ঘোষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপর একটি তথ্যচিত্র তৈরি করছিলেন, তখন রবি ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর একটি ছবি তোলার দৃশ্যে সেই সময়ের একটি প্লেট ক্যামেরার প্রয়োজন ছিল সেই প্লেট ক্যামেরা একমাত্র পাওয়া গিয়েছিল বসু বাবুর কাছেই।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরার আকার-আকৃতি যে পরিবর্তন হয়েছে, তাপসবাবুর সংগ্রহ দেখলে তা স্পষ্ট হয়। বক্স আকৃতির দুই লেন্সের টিএলআর (টুইন লেন্স রিফ্লেকটিভ) আর বিভিন্ন পুরোনো মডেলের এসএলআর ক্যামেরাগুলো নজর কাড়ে। কোসিনার ভিডিও ক্যামেরা, যেটাতে প্রথমবারের মতো ভিডিওর পাশাপাশি একই সঙ্গে ভয়েস রেকর্ড হতো। অ্যানালগ ফিল্ম ক্যামেরার ওপর অ্যানালগ ডিসপ্লেযুক্ত ক্যামেরা, ফিল্মের পকেট ক্যামেরা, তাৎক্ষণিক প্রিন্ট বের করার পোলারয়েড ক্যামেরাসহ নানা আকর্ষণীয় ক্যামেরা যা দেখলে মনে হয় এখন ছবি তোলা কতটা সহজ হয়ে গিয়েছে। ফোনের সঙ্গেই হাই রেজুলেশন ক্যামেরা এসে গিয়েছে। যা দিয়ে ছবি ভিডিও সবই করা যায় নিমেষে।
আরও পড়ুন- ‘তারার ছায়া’য় স্মৃতির সমাহার, অপূর্ব-কীর্তিতে চাগিয়ে উঠছে ইতিহাস-প্রেম
নতুন প্রজন্মের অনেকেই জানে না ক্যামেরার এই বিবর্তনের ইতিহাস। তাঁদের জন্যেই হয়তো জীবন্ত দলিল রেখে যাচ্ছেন। তাপস কুমার বসু হেসে বলেন, "আজকে যা নতুন কাল তা পুরনো এন্টিক জিনিস। এসব এন্টিক জিনিসই সবার জন্যে রেখে যেতে চাই। যাতে সবাই আমাদের বিবর্তনের ইতিহাস জানতে পারে।"