Advertisment

'আমি ভাল নেই', মায়ের সঙ্গে ফোনে শেষ কথা যাদবপুরের মৃত ছাত্রের

বন্ধু ও পরিজনরা জানিয়েছেন যে পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীল, লাজুক কিন্তু, লেখাপড়ায় দুর্দান্ত ছিল ওই পড়ুয়া।

IE Bangla Web Desk এবং Chinmoy Bhattacharjee
New Update
Jadavpur Student

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ।

উদ্বিগ্ন পরিবারের মোবাইল থেকে করা কল বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া, প্রধান অভিযুক্তের সঙ্গে এক কাপ চা পান, প্রমাণ নষ্টের অভিযোগ, পরিবার-বন্ধুবান্ধব এবং তদন্তকারীদের সঙ্গে কথোপকথন- যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্রের মৃত্যুতদন্তে এক রোমহর্ষক চিত্র সামনে নিয়ে এল।

Advertisment

১৭ বছরের পড়ুয়াকে ৯ আগস্ট চার তলা হস্টেল ভবনের দ্বিতীয় তলার বারান্দা থেকে পড়ে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সঙ্গে কথা বলার সময় তাঁর পরিবারের সদস্যরা বলেছেন যে তাঁরা রাত ৯টার দিকে বাড়ির ছেলেকে বেশ কয়েকবার ফোন করেছিলেন। ঘটনার কয়েক ঘণ্টা আগে, ফোনের অন্য প্রান্তে কেউ যেন তাঁদের মোবাইলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। তাঁরা আরও জানিয়েছেন যে পুলিশ যাকে অন্যতম প্রধান আসামি হিসেবে অভিযুক্ত করেছে, ওই কিশোরের দেখাশোনার জন্য সেই সৌরভ চৌধুরীর ওপরই তাঁরা বিশ্বাস রেখেছিলেন। এমনকী, প্রশংসার ইঙ্গিত হিসেবে মৃত ছাত্রের পরিবার সৌরভ চৌধুরীকে মিষ্টিও পাঠিয়েছিল।

কান্নায় ভেঙে পড়ে ছেলেটির মা বলেন, 'যখন আমরা আমাদের ছেলের কাছে যেতে পারিনি, তখন ওর সিনিয়রদের ডেকেছিলাম। তারা বলেছিল যে সে ভালো আছে এবং ১৫ মিনিট পরে তাকে আমাদের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিচ্ছে। ও কেবল হ্যাঁ বা না-এ উত্তর দিচ্ছিল। এমন সময়ে হঠাৎ এক বিকট শব্দ হল, যেন ও একগুচ্ছ লোকে ঘেরা। আমি ভয় পেয়ে ওকে জিজ্ঞাসা করলাম কী হচ্ছে? ও বলল, আমি ভালো নেই। ছেলের সঙ্গে এটাই আমার শেষ কথোপকথন।'

তার ছোট ভাই জানিয়েছে, রবিবার হস্টেলে তার ১৭ বছর বয়সি দাদাকে পৌঁছে দেওয়ার পর পরিবার সৌরভের সঙ্গে কথা বলেছিল। এরপর বুধবার নির্যাতিত তার ছোট ভাইকে জানায় যে সে সৌরভ-সহ হস্টেলের সিনিয়রদের সঙ্গে চা খেতে গিয়েছিল। মৃত ছাত্রের বাবা বলেন, 'আমরা ভেবেছিলাম সে সৌরভ ও মনোতোষের (অন্য অভিযুক্ত ঘোষ) কাছে নিরাপদ। আমরা গ্রামের মানুষ, সরল মানুষ। এমনকী আমি সৌরভের কাছে সোনাপাপড়ির একটি প্যাকেটও পাঠিয়েছিলাম এবং তাকে বলেছিলাম যে আমার ছেলে একটি সাধারণ ছেলে, তাকে একটু দেখ।'

সৌরভ ২০২২ সালে গণিতে এমএসসি করেছে। কিন্তু, তারপরও হস্টেলেই থাকত। ছয় প্রাক্তন ছাত্র-সহ এখনও পর্যন্ত এই মামলায় গ্রেফতার হওয়া ১২ জনের মধ্যে সে একজন। এক তদন্তকারী আধিকারিক বলেন, 'এই প্রাক্তন ছাত্রদের একটি আলাদা ঘর ছিল। যেখানে তারা নিজেদের পরিচয় দেওয়ার জন্য নতুনদের ডাকত।' হস্টেলের এক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্র বলেন, 'অনেক প্রাক্তন ছাত্র এখনও হস্টেলের ঘর দখল করে আছে, যদিও তারা বাইরে কাজও করছে। কিন্তু, তারা প্রভাবশালী। তাই প্রবেশে কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই।'

ওই কিশোরের মৃত্যুর পর হস্টেলের প্রধান ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। পুলিশ বলেছে, প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে যে বেশ কয়েকজন ছাত্র প্রমাণ নষ্ট করার চেষ্টা করেছিল। পুলিশ সূত্রে খবর যে অভিযুক্তরা কীভাবে প্রমাণ লোপাট করতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা করার জন্যই হস্টেলের কাছে একটি মিটিং হয়েছিল। এরপর ওই কিশোরকে ভোর ৪টা ৩০-এ মৃত ঘোষণা করা হয়। পুলিশ পরীক্ষার জন্য অভিযুক্তদের ফোনগুলো ফরেনসিকে পাঠিয়েছে। এই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ নষ্ট করে ফেলা হয়েছিল, সেটা উদ্ধার করেও পুলিশ তদন্ত চালাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের যাঁরা ওই ছাত্রকে চিনতেন, তাঁরা ওই কিশোরকে 'সহজ-সরল এবং শ্রদ্ধাশীল' বলে বর্ণনা করেছেন। প্রথম বর্ষের ওই ছাত্র কুইজে অংশ নিতে চাইছিল বলে অনেকেই জানিয়েছেন।

কলকাতা থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে নদিয়া জেলার একটি গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারের কাছে তাদের সন্তানকে এমন একটি মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো ছিল গর্বের ব্যাপার। স্থানীয় সমবায় ব্যাংকের কর্মী এবং একজন আশা কর্মীর এই ছেলে ছিল মায়ের খুব আদরের। তার মা বলেন, 'আমাদের ছেলে মা-বাবার মতই নিজের ছোট ভাইয়ের যত্ন নিত। আমি বাড়ি ফেরার আগেই সে ঘরের সব কাজ সেরে ফেলত। আমি দুই সন্তান থাকার পরও আশাকর্মীর কাজ করতে পারছি কারণ, ও আমার এক অত্যন্ত দায়িত্ববান ছেলে ছিল।'

আরও পড়ুন- নতুন অশান্তির শঙ্কায় সন্ত্রস্ত মণিপুর, ভয় ধরানো হুমকি কুখ্যাত জঙ্গিগোষ্ঠীর

মৃত ছাত্রের বন্ধু রৌনক বক্সি বলেন, 'ও লেখাপড়ায় দুর্দান্ত ছিল। সাধারণত বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা বাংলা বা মাতৃভাষাকে খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখে না। তবে, ওর বাংলা বা মাতৃভাষাতেও প্রবল আগ্রহ ছিল। পড়ার ক্ষেত্রে কোথাও বুঝতে অসুবিধা হলে ও কোচিং সেন্টারে বারবার করে যেত। ওর কোনও রাগ ছিল না। আমি কখনও ওকে লড়াই করতে দেখিনি।' মৃত ছাত্রের গৃহশিক্ষক প্রশান্ত বিশ্বাস বলেন, 'আমি জানি ও ভাষা ভালোবাসত। এমনকী আমি ওকে বলেছিলাম যে বাংলা পড়ে বিশেষ লাভ হবে না। কিন্তু, তারপরও ও আমাকে বলেছিল যে সে বাংলা নিয়েই পড়তে চায়। ও যাদবপুরে ভর্তি হওয়ার পরও আমি ওর সঙ্গে কথা বলেছি, শুভকামনা জানিয়েছি।' তার স্কুলের সহপাঠী আয়ুষ সরকার বলেছে, 'ও খুব লাজুক ছিল। মোটেও রুক্ষ বা কঠিন ছিল না। কিন্তু, তার মানে কি ওকে মারধর করতে হবে?'

Arrest Student Death Jadavpur University
Advertisment