Advertisment

জল কমে দিঘিজুড়ে পানা, মুখ ফেরাচ্ছে দেশি-বিদেশি পাখি, দুশ্চিন্তার মেঘ চুপি পাখিরালয়ে

শীতে দেশ বিদেশের নানা প্রজাতির পাখি ভিড় জমায় ছাড়িগঙ্গার চুপির পাখিরালয়ে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
The movement of birds is decreasing in Purbasthali chupir aviary

পাখির আনাগোনা কমছে চুপি-তে। ছবি: প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়।

পৌরাণিক ব্যাখ্যা অনুযায়ী সাগর রাজবংশের রাজা ভাগীরথ গঙ্গাকে এই পৃথিবীতে এনেছিলেন। তাই গঙ্গার অপর নাম হয় ভাগীরথী।
তিন দশকেরও বেশী সময় আগে গঙ্গার গতিপথ ঘুরে যাওয়ার জেরে 'ছাড়িগঙ্গার' জন্ম হয়। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব বর্ধমানের পূর্বস্থলী ২ ব্লকের 'চুপির কাষ্ঠশালির' সেই ছাড়িগঙ্গাই পাখিদের কাছে প্রিয় স্থান হয়ে ওঠে। চুপির পাখিরালয়ের পরিচিতি এখন দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু যাকে ঘিরে এত উন্মাদনা সেই ছাড়িগঙ্গা এখন নানা কারণে অবলুপ্ত হতে বসায় দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছেন পর্যটকবাহী নৌকার মাঝি ও ব্যবসায়ীরা।

Advertisment

শীতের মরশুমে দেশ বিদেশের নানা প্রজাতির পাখি উড়ে এসে জড়ো হয় ছাড়িগঙ্গার চুপির পাখিরালয়ে। পাখি দেখার টানে এই রাজ্য সহ দেশ-বিদেশের নানা প্রান্তের পর্যটকরা চুপির কাষ্ঠশালির’ ছাড়িগঙ্গায় ছুটে আসেন। পর্যটকদের আগমনের সঙ্গে রোজগারের পথও খুলে যায় এলাকাবাসী ও নৌকার মাঝিদের। কিন্তু গঙ্গার স্রোতের জল ঢোকা কমে যাওয়ায় এখন ছাড়িগঙ্গা যেন অবলুপ্ত হতে বসেছে। তা আঁচ করেই হয়তো এই বছর শীতে চুপির পাখিরালয়ে পাখিদের আগমন ঘাটতি ঘটেছে বলেই এলাকাবাসীদের ধারণা। পাখিদের ঘাটতি দেখে তাই কার্যত হতাশ পর্যটকবাহী নৌকার মাঝি ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।

publive-image

পূর্বস্থলীর চুপি কাষ্ঠশালীর পাখিরালয়ের একদিকে রয়েছে ছাড়িগঙ্গার বিশাল জলাশয়। অপর দিকে রয়েছে গাছ গাছালিতে ভরা সবুজের সৌন্দর্য্য। শীত পড়লেই চিন, তিব্বত, সাইবেরিয়া, রাশিয়া প্রভৃতি দেশের পাখিদের আগমন শুরু হয় চুপির পাখিরালয়ে। সেই সব পাখিদের নামও গালভরা। রেড ক্রেস্টেড পোচার্ড, পিনটেল, কটন টিল, কমন কুড, সিঁদুর মাথা উইজিয়ন, ব্রোঞ্জ উইন জাকানা, লার্জ ইগ্রেট, গ্রে হেরন এই সব পাখির এখানে দেখা মেলে। এই পাখি দেখার টানে পর্যটকরা এখানে ছুটে আসেন। পাখি দেখতে আসা পর্যটকদের জন্য এখানে তৈরি করা হয়েছে কটেজ-সহ পরিযায়ী আবাস। রয়েছে নৌকাবিহারের ব্যবস্থাও। নৌকায় চড়েই বিশাল জলাশয় ঘুরে দেশ-বিদেশের পাখি দেখার সাধ মেটান পর্যটকরা। পাখিদের ছবি ক্যামেরা বন্দি করার জন্য পর্যটকরা সারাটা দিন নৌকা বিহারে মত্ত থাকেন।

এত কিছুর পরেও যে কারণে এলাকাবাসী মনে করছেন ছাড়িগঙ্গা অবলুপ্তির পথে চলে যাচ্ছে, তা জানলেও সবাই অবাক হবেন। স্থানীয় বাসিন্দা জয়ন্ত প্রামাণিক বলেন, “এক সময়ে পূর্বস্থলীর কাষ্ঠশালি গ্রামের ঠিক পাশ দিয়েই বয়ে যেত ভাগীরথী। তবে বিগত তিন দশকে ভাগীরথী একটু একটু করে কাষ্ঠশালি থেক দূরে সরে গিয়েছে। এমনকী পুরনো মায়াপুরের মণ্ডলপাড়ার সামনের যে চ্যানেল দিয়ে ছাড়িগঙ্গায় ভাগীরথীর জল ঢুকতো সেই জায়গাটিও পলি পড়ে মজে গিয়েছে। পলির মাত্রা এতটাই যে আগামী জানুয়ারি মাসের মধ্যে ওই জায়গা সম্পূর্ণ বুজে যাওয়ার আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে।

publive-image

এলাকাবাসী এও মনে করছেন, ড্রেজিং করে ওই পলি যদি তুলে ফেলা না হয় তাহলে চ্যানেলটি দিয়ে আগামী দিনে ভাগীরথীর জল ছাড়িগঙ্গায় ঢুকতেই পারবে না। কিন্তু সেটা নাকি করা হয়নি। আর সেই কারণেই ছাড়িগঙ্গায় জলের গভীরতা অনেক কমে গিয়েছে। এখন চ্যানেলে মাত্র ফুট দুয়েক গভীর জল আছে। জানুয়ারিতে সেই জলও শুকিয়ে গেলে সেখানে পুরোপুরি চর পড়ে যাবে বলে এলাকাবাসীদের আশঙ্কা। তাঁদের ধারণা ছাড়িগঙ্গায় জল আসা বন্ধ হয়ে গেলে পাখিও আর আসবে না। পর্যটকরাও আসবেন না। তেমনটা হলে পর্যটক নির্ভর এই এলাকার মানুষের জীবিকাও মুখ থুবড়ে পড়বে।

এলাকার অপর কয়েকজন বাসিন্দার অভিযোগ, “ছাড়িগঙ্গা যত শুকিয়ে যাচ্ছে ততই বাড়ছে মাটি মাফিয়াদের সক্রিয়তা। তারা এখনই চর দখলের তৎপরতা শুরু করে দিয়েছে।'' এলাকাবাসীদের আশঙ্কা, এভাবে চলতে থাকলে ছাড়িগঙ্গার অস্তিত্ব অচিরেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ড্রেজিং করে পলি সরিয়ে ভাগীরথীর জল আগের মতই ছাড়িগঙ্গায় ঢোকানোর ব্যবস্থা করুক প্রশাসন, একটাই দাবি স্থানীয়দের।

publive-image

পর্যটকবাহী একটি নৌকার মাঝি রনজিৎ দাস জানান, “নৌকায় পর্যটকদের চুপির পাখিরালয় ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য শতাধিক মাঝি রয়েছেন। মূলত শীতের সময়েই দেশি-বিদেশি পর্যটকরা বেশী সংখ্যায় চুপির পাখিরালয় দখতে আসেন। তাঁরা নৌকাবিহার করে পাখি দেখেন, পাখিদের ছবি তোলেন । পর্যটকদের নৌকাবিহার করিয়েই মাঝিদের রোজগারের সংস্থান হয়। এলাকার ছোট মাঝারি ব্যবসায়ীদেরও রোজগার হয়।''

অপর মাঝি বৃন্দাবন রাজবংশী বলেন, “আগে মাঝিরা দু’দিক থেকে ছাড়িগঙ্গায় ঢুকতে পারতেন। কিন্তু এখন একটা দিক পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। আর অপর দিকে চর পড়ে ডাঙা হয়ে গেছে। তারই মধ্যে ছাড়িগঙ্গার যেটুকু জায়গায় অল্পবিস্তর জল রয়েছে সেই জায়গাও কচুরিপানায় ভরে গিয়েছে। তাই বাধ্য হয়েই কচুরিপানা সরিয়ে মাঝিদের নৌকা নিয়ে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। ছাড়িগঙ্গার এমন করুণ অবস্থা দেখে এখন পর্যটকরাও বিরক্তি প্রকাশ করছেন।''

ছাড়িগঙ্গা অবলুপ্তির পথে চলে যেতে বসেছে একথা মানতে নারাজ পূর্বস্থলীর বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায়। উল্টে তিনি দাবি করেন, ''এই বছর বৃষ্টি কম হওয়ার কারণে ভাগীরথীর জল এখন চৈত্র বৈশাখ মাসের মত হয়ে রয়েছে। ভাগীরথীর জল এত কম থাকাটা
আগে কখনও হয়নি। ভাগীরথীতে জল কমার কারণে ছাড়িগঙ্গাতে জল ঘাটতি ঘটেছে।''

বিধায়কের আরও দাবি, ''ছাড়িগঙ্গায় এমন কিছু পলি পড়েনি। জল বাড়লেই পলি সরে যাবে।'' কচুরি পানায় গোটা ছাড়িগঙ্গা ভরে গেছে এই অভিযোগও বিধায়ক মানতে চাননি। তিনি বলেন, ''পাখিদের ডিম পাড়ার প্রয়োজনে ছাড়িগঙ্গার কিছু জায়গায় কচুরিপানা তো রাখতেই হবে। চুপির পাখিরালয়ের কাছেই ২ একর খাস জমি পাওয়া গিয়েছে। আরও পর্যটক টানতে
ওই জায়গায় পর্যটক আবাস, ফুলের বাগান ও পার্ক তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।''

West Bengal East Burdwan
Advertisment