এক কামরার আলো আধারি ঘর। ভিতরে ভেজা মাটির গন্ধ। এদিক ওদিক ছড়িয়ে রাখা সদ্য ছাঁচে বানানো অবয়ব। স্ট্যান্ড পাখার সামনে বসে দুহাতে মাটি নিয়ে এক মনে কাজ করে যাচ্ছেন মাঝবয়সী এক লোক। কাঠের বেঞ্চে পর পর সাজানো গণেশজননী, নারায়ণী, কৃষ্ণ-বলরাম, দক্ষিণরায়, বনবিবি, হাজিপির অসংখ্য পোড়া মাটির পুতুল। এগুলো দেখতে প্রচলিত মাটির পুতুলের চেয়ে অনেকটাই আলাদা। টানা টানা চোখ, গোলগাল গড়নের এই পুতুলগুলো দেখলেই বোঝা যায় এসব সাবেক বাংলার। লোকায়ত বাংলার লোকজীবনের এক অমূল্য সম্পদ। সেই আদিম সভ্যতার থেকে হাতের দশ আঙুলের তৈরি মাটির এ জিনিস জড়িয়ে পড়েছে মানব জীবনের সঙ্গে।
দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার মজিলপুরের বোস পাড়া। নেতাজি মূর্তির ঠিক উল্টো দিকে একচালা বাড়ি। সরকারি সাহায্যে পেয়ে কিছুদিন আগেই এই বাড়িটি করেছেন শম্ভু দাস। জয়নগর মজিলপুর স্টেশনে নেমে যে কেউকে জিজ্ঞেস করলেই বলে দেন এই শম্ভু দাসের বাড়িতে যাওয়ার রাস্তা। রাস্তার উপরেই ঘর। দরজা দিয়ে ঢুকেই ঘরটির সিঁড়ির ওপরের দেওয়ালে লম্বা লম্বা কাঠের তাকে পরপর পুতুলের ছাঁচ সাজানো। নিচের মেঝেতে একধারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাঁচা মাটির কিছু পুতুল রাখা। ছাঁচে বানানো পুতুলের অমন নিটোল গড়ন বাংলার বাকি দশ মহল্লার পুতুলের থেকে জয়নগরের মাটির পুতুলকে আলদা করে দেয়।
শিয়ালদহ থেকে যে রেল লাইন নামখানার দিকে যাচ্ছে তার পশ্চিমে গেলে পড়বে জয়নগর আর পূর্বদিকে মজিলপুর। বাংলার অন্যতম প্রাচীন জনপদের মধ্যে অন্যতম জয়নগরের মজিলপুর। শুধু তাই নয়, মাটির ছাঁচের পুতুল তৈরির প্রথম সারিতে নাম রয়েছে এই জায়গার। আর এই ছাঁচের পুতুল তৈরির ঐতিহ্যকে এখনো ধরে রেখেছেন শিল্পী শম্ভুনাথ দাস। পুতুল তৈরির মাঝখানে শম্ভুবাবু বললেন, "এই শিল্পের অতীত গৌরবময় হলেও বতর্মান কিন্তু অনিশ্চয়তায় ঘেরা। দিন যত যাচ্ছে এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই তত কঠিন হচ্ছে। আমাদের আট পুরুষের এই পেশা এখন প্রায় শেষের দিন গুনছে।" তবে থমকে যাওয়ার আশঙ্কা নিয়ে তিনি আজও ধরে রেখেছেন বাংলার একেবারে নিজস্ব শৈলীর এই পুতুল শিল্প।
মজিলপুরের বিখ্যাত পুতুল শিল্পী পাঁচুগোপাল দাসের ছেলে শম্ভুনাথ দাস। তিন ছেলের মধ্যে ছোট ছেলে শম্ভুই একমাত্র এই পেশাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। ২০১০ সালে পাঁচুগোপালের মৃত্যুর পরে বংশ পরম্পরায় পুতুল তৈরির সব দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন শম্ভু। ছোট থেকেই মাটির সঙ্গেই মানুষ, মাটির গন্ধ তাঁর সারা শরীরে, মাটি দিয়ে পুতুল গড়েন। পুতুল নিয়েই সংসার। শম্ভু বলছিলেন, প্রায় ২৫০ বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষ কালীচরণ পেয়াদাকে যশোহর থেকে জয়নগরে এনেছিলেন এখানকার দত্ত-জমিদাররা।
অনেক আগে এখানে গঙ্গা ছিল, পরবর্তীতে যা মজে গিয়ে জনবসতি গড়ে ওঠে। নাম হয় মজিলপুর আর পশ্চিম দিকে জয়নগর। শোনা যায় দেবী জয়চন্ডীর নামে জয়নগরের নামকরণ হয়েছে। পূর্বপুরুষরা সকলেই জমিদারদের পেয়াদা ছিলেন। সে সময় পাহারাদারির পাশাপাশি জমিদারদের ছেলেমেয়েদের খেলার জন্যে নানা ধরনের মাটির খেলনা তৈরি করে দিতে হত। শোনা যায় কালীচরণ নাকি মাটি দিয়ে এই 'টেপা পুতুল' তৈরি করতেন। তখন তাঁর ছেলে জানকীনাথ দাস জয়নগরে এই পুতুল তৈরি শুরু করেন।"
আরও পড়ুন- মনোনয়ন জমা দিতে গেলে ‘ঠেঙিয়ে লাট’ বিরোধীদের! কাঠগড়ায় তৃণমূল
তাঁরই উত্তর পুরুষ শম্ভুবাবুর ঠাকুরদা মন্মথনাথ। মন্মথনাথের গড়া জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা ১৯৮৬ সালে রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার লাভ করে। তাঁর মৃত্যুর পরে সেই পুরষ্কার গ্রহণ করেন পাঁচুবাবুই। গ্রামাঞ্চলে লৌকিক দেবদেবীর পুজো সবচেয়ে বেশি হয়, তাই চাহিদাও প্রচুর। তাই লৌকিক দেবদেবীর মূর্তি যেমন দক্ষিণরায়, ঝোলা বিবি, নারায়ণী আটেশ্বর, বসন্ত রায়, বড় খাঁ গাজি, পঞ্চানন্দ, পীর গোরাচাঁদ, বনবিবি, শীতলা ইত্যাদিও তৈরি করতেন তাঁরা। মন্মথের কাজ আজও দেখা যায় দেশ বিদেশের বিভিন্ন সংগ্রহালয়ে।
এছাড়াও শম্ভুবাবুর বাবা পাঁচুগোপাল দাসও ছিলেন নাম করা শিল্পী। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও শম্ভু আঁকড়ে ধরে রেখেছেন এই শিল্পকে। কিন্তু কত দিন আর পারা যাবে তা নিয়ে সংশয়ে শম্ভুনাথ দাস। জায়গার যে বড়ই অভাব! "ছোট একটু জায়গায় গা ঘেঁষাঘেঁষি রাখতে হয়েছে পুতুলগুলো। একটু অসাবধান হলেই ভেঙ্গে যায়। এছাড়া মাটির দাম বেড়েছে। মাটি জোগাড় করাও খুব কঠিন হয়ে গিয়েছে। এখন মাটির জিনিস ঘর সাজানোর জন্যেই দু একজন কিনে নিয়ে যান। এখন পুতুল নিয়ে চর্চা হয় কতটুকু? কলেজের কয়েকজন আসেন পুতুল নিয়ে রিসার্চ করার জন্যে এই নিয়েই চলছে।" বলছিলেন শম্ভুনাথ দাস।
জয়নগর মজিলপুরের পুতুল দু’প্রকার। হাতে তৈরি এবং ছাঁচের। প্রচলিত দেবদেবীর পাশাপাশি তৈরি হয় নানা লৌকিক দেবদেবীর মূর্তি। হাতে তৈরি পুতুলের মধ্যে নারায়ণী, শীতলা, বনবিবি, দক্ষিণরায়, পঞ্চানন, মানিকপীর, আটেশ্বর, দক্ষিণেশ্বর এসব পুতুলই মানুষ বেশী পছন্দ করেন। আর ছাঁচের পুতুলের মধ্যে রয়েছে গণেশজননী, জগদ্ধাত্রী, রাধাকৃষ্ণ, কালিয়দমন, ষড়ভূজচৈতন্য, কলকাতার বাবু, গয়লা-বৌ, কৃষক ইত্যাদি। এ ছাড়াও রথের সময় জগন্নাথ, ঝুলন-জন্মাষ্টমীর সময় রাধা-কৃষ্ণ, গোপাল, নববর্ষে লক্ষ্মী-গণেশের মূর্তির ভাল চাহিদা থাকে।
২৫০-৩০০ বছরের পুরনো ছাঁচগুলো এখনও যত্ন করে রাখা আছে শম্ভুর কাছে। এসবের পরেও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যে লড়াই করে যেতে হচ্ছে। কেন না, পুতুল তৈরি থেকে রং করার কাজ সবই একা হাতে করতে হয়। মাঝে মধ্যেই বিভিন্ন মেলায় পুতুলের পসরা বসার সুযোগ কিন্তু তাতে বিক্রি তেমন নেই। পরবর্তী প্রজন্মের কেউই এই পেশায় আসতে আগ্রহী নয়। সরকারী সাহায্যে তেমন একটা নেই। জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি। এভাবেই হয়তো একদিন হারিয়ে যাওয়া লোকশিল্পের তালিকায় নাম যোগ হবে মজিলপুরের ছাঁচের পুতুল।