না হুইল চেয়ার, না ট্রলি। ৯৮ বছর বয়সে সটান হেঁটে চলে গিয়েছেন অপারেশন থিয়াটারে এবং অপারেশন করার জন্য বারেবারেই উৎসাহিত করেছেন চিকিৎসকদের। শেষমেশ অপারশেন করিয়ে দু'দিন পর লিফট থেকে নেমে হাঁটলেনও। এই 'ঠাকুমা'-কে ভুলতেই পারছেন না সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিতসকরা। একশো ছুঁইছুই সাহসীনি ঠাকুমার কাহিনীতে বুঁদ হয়ে আছে হাসপাতাল।
শঙ্করীবালা দে। সরকারি নথিতে বয়স ৯৮। বাড়ি পূর্ব বর্ধমানের সুহারী গ্রামে। চেস্ট ওয়ালের উপর চামড়ার ক্যান্সার। পোশাকী নাম স্কোয়ামস সেল কারসিনোমা। রোগ ধরা পড়ার পর এ হাসপাতাল, ও হাসপাতাল করতে হয়েছে বেশ কয়েকবার। এরই মধ্যে রোগটা অনেকটা ছড়িয়েও পড়েছে। তবে বর্ধমান মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকরা জানিয়ে দিয়েছিলেন, অস্ত্রোপচার প্রয়োজন। কিন্তু ৯৮ বছর বয়স দেখে ঝুঁকি নেয়নি হাসপাতাল। অজ্ঞান করার বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্থ ছিলেন চিকিৎসকরা। এরপর বেসরকারি হাসপাতাল, নার্সিং হোমের দরজায় কড়া নাড়া। তাছাড়া একাধিক নামীদামি চিকিৎসকের পরামর্শও নিয়েছে তাঁর পরিবার।
তবে ছোটাছুটিই সার হয় শঙ্করীবালা দেবীর পরিবারের সদস্যদের। অস্ত্রোপচার করে ঝুঁকি নিতে চাননি কেউই। এদিকে আবার এই রোগের ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার ছাড়া গতিও নেই। শেষ পর্যন্ত রাজি হয় সাগর দত্ত মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক মানস গুমটা ও অমিতেশ ঝা'র অধীনে ভর্তি হন নবতীপর বৃদ্ধা। তবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানিয়ে দেওয়া হয়, অজ্ঞান করে অস্ত্রোপচার সম্ভব নয়।
চিকিৎসক মানস গুমটার কথায়, "প্রথমে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম ৯৮ বছরের মহিলা কী করে এতটা 'মেন্টাল সাপোর্ট' পান। তাঁর সংগ্রামী জাবনটাই সাহস যোগাতে উদ্বুদ্ধ করেছে। সাধারণত অপারেশনের ক্ষেত্রে রোগী ট্রলি বা হুইল চেয়ারে যায়। ওঁর যা বয়েস তাতে হুইল চেয়ার তো প্রয়োজন ছিলই। কিন্তু, উনি নিজেই বললেন হেঁটে যেতে পারবেন। পাশাপাশি হেঁটে আমি জিজ্ঞেস করলাম, 'কিগো ঠাকুমা ভয় করছে না?' চটাপট জবাব আসে, "কিসের ভয়। তোরা আমার ছেলে। তোরা আছিস আমার আবার কিসের ভয়!"
ঠাকুমার চিকিৎসা করার অভিজ্ঞতা মনে গেঁথে গিয়েছে মানসবাবুর। তিনি বলেন, "চামড়ার ক্যান্সার। অপারেশন করা ছাড়া উপায় ছিল না। ছোটখাট ঘা। ওটাকে বাদ দিয়ে প্ল্যাস্টিক সার্জারির দরকার ছিল। তবে এই বয়সে মনের জোর ও সাহসটা আমাদের কাছে প্রাপ্তি। চিকিৎসক মহল মুগ্ধ।"
এরকম রোগী পাওয়া সহজ নয়। তা মানলেন প্লাস্টিক সার্জেন অমিতেশ ঝা-ও। তিনি বলেন, "ওঁর মনের জোর অনেক। ওপর থেকে মনে হচ্ছে চামড়ার ক্যান্সার। বারবার বলছিলেন, অপারেশন কর। উনি 'মেন্টালি স্ট্রং'। ওনার অনুমতির পর অপারেশনের জন্য এগোলাম। বায়োপ্সি রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছি।"
শঙ্করীদেবীর নাতি সত্যজিতের কথায়, "ঠাকুমাকে নিয়ে আমরা নানা হাসপাতাল, চিকিৎসকের কাছে ছুটে গিয়েছি। কিন্তু শেষমেশ সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এসে চিকিৎসা হল। বাড়ি ফেরার সময় হেঁটে হেঁটেই গাড়িতে চেপেছেন। বাড়িতে এসেও এখন সুস্থই আছেন ঠাকুমা। ঠাকুমা বহুদিন ধরেই ভাত খান না। ছাতু, মুড়ি খান। এখনও কারও সাহায্য ছাড়াই তিনি নিজের কাজ নিজেই করেন।"
একশো ছুঁই ছুই -এর সাহস ও মনের জোর দেখে হাসপাতালের চিকিৎসক থেকে নার্স, কর্মী সকলেই তাজ্জব বনে গিয়েছেন। লোকাল এনাসথেসিয়া করে অস্ত্রোপচারও হয়েছে। সুস্থ হয়ে বাড়িও ফিরেছেন তিনি। 'ঠাকুরমার ঝুলির' রূপকথা এখন সাগর দত্ত হাসপাতালের চিকিৎসকদের মুখে মুখে।