Advertisment

Motivational News: পান-বিড়ি-সিগারেটের দোকানে বসে লিখে ফেলেছেন হাজার হাজার গল্প, একের পর এক উপন্যাস 

বেহালার মদনমোহন তলায় মুরাদপুর কেএমসি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ঠিক উল্টো ফুটেই বাজারের মাঝে পিন্টু পোহানের তিনফুট বাই তিনফুট পান বিড়ি সিগারেটের ছোট্ট দোকান। যাকে বলে গুমটি। খদ্দের সামলানোর ফাঁকে ফাঁকে নিন্দুকের ব্যাঙ্গ বিদ্রূপ উপেক্ষা করে পিন্টু দোকানে বসেই লিখে ফেলেছেন ১২টারও বেশী উপন্যাস। ২০০-রও বেশি গল্প। দুশোর বেশি কবিতা তাছাড়া অসংখ্য ছোট বড় গদ্য। তাঁর প্রকাশিত লেখার সংখ্যা দুহাজারেরও বেশি।

author-image
Shashi Ghosh
New Update
pan seller has written thousands of stories, one novel after another, while sitting in shop

পান-বিড়ি-সিগারেটের দোকানে বসে লিখে ফেলেছেন হাজার হাজার গল্প, একের পর এক উপন্যাস। এক্সপ্রেস ছবি- শশী ঘোষ

Motivational News: "আমি একজন বিশেষ শ্রেণির প্রতিনিধি। ফুটপাথে খেটে খায়। আরেকটা শ্রেণির মনে করে না, ফুটপাথে খেটে খাওয়া মানুষটা কোন সাহিত্যের মত উচ্চ মেধার চর্চা করতে পারে! তাঁরা এটা ভাবতে গিয়ে অবাক হয়, 'ও! দু'হাজারের বেশী বই পড়ে ফেলেছে!' বা পাঁচজন যেখানে কথা বলবে ও সেখানে যুক্তি দিয়ে কথা বলবে? এটায় ওদের কাছে স্পর্ধা মনে হয়েছে। ফলে আমি কখনও সাহায্যে পায়নি। পদে পদে ব্যাঙ্গ, বিদ্রূপ,তামাশা প্রতিদিন র‍্যাগিংয়ের স্বীকার হতে হয়েছে।" একটানা কথাগুলো বলতে গিয়ে জমে থাকা যন্ত্রণাগুলো চোখে মুখে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠছিল পিন্টু পোহানের। বেহালার মদনমোহন তলায় মুরাদপুর কেএমসি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ঠিক উল্টো ফুটেই বাজারের মাঝে পিন্টু পোহানের তিনফুট বাই তিনফুট পান বিড়ি সিগারেটের ছোট্ট দোকান। যাকে বলে গুমটি। খদ্দের সামলানোর ফাঁকে ফাঁকে নিন্দুকের ব্যাঙ্গ বিদ্রূপ উপেক্ষা করে পিন্টু দোকানে বসেই লিখে ফেলেছেন ১২টারও বেশী উপন্যাস। ২০০-রও বেশি গল্প।  দুশোর বেশি কবিতা তাছাড়া অসংখ্য ছোট বড় গদ্য। তাঁর প্রকাশিত লেখার সংখ্যা দুহাজারেরও বেশি। 

Advertisment
pan seller has written thousands of stories, one novel after another, while sitting in shop
বেহালার মদনমোহন তলায় মুরাদপুর কেএমসি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ঠিক উল্টো ফুটেই বাজারের মাঝে পিন্টু পোহানের তিনফুট বাই তিনফুট পান বিড়ি সিগারেটের ছোট্ট দোকান। যাকে বলে গুমটি। খদ্দের সামলানোর ফাঁকে ফাঁকে নিন্দুকের ব্যাঙ্গ বিদ্রূপ উপেক্ষা করে পিন্টু দোকানে বসেই লিখে ফেলেছেন ১২টারও বেশী উপন্যাস। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ

বেহালার বীরেন রায় রোড। রাস্তার ধারের গুমটি দোকানটি আলাদা করে কারো চোখে পড়বে না। শুধু মাত্র দোকানের সামনেটায় এলেই একবার অন্তত থমকে দাঁড়াতে হবেই। পান বিড়ি সিগারেটের সাথে দোকানে জায়গা ভাগ করে রয়েছে বইয়েরা। বিভিন্ন লেখকের বই একদিকে থরে থরে সাজানো। আরেকদিকে নিজেরই লেখা সব বই। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে এই লেখকের রুজি রোজগারের পাশাপাশি লেখালেখির একমাত্র জায়গা এই ছোট্ট দোকান। ইচ্ছে থাকলেই যে উপায় হয় তা পিন্টু পোহান জল জ্যান্ত উদাহরণ। ওনাকে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করতে পারবে না। দোকানে বসেই জীবন সংগ্রামের কথা বলছিলেন পিন্টুবাবু, "ছেলেবেলা থেকে অভাব আর দারিদ্রতার মধ্যে মানুষ। এই অতিরিক্ত অভাব দারিদ্রতা সেখানে বন্ধু বলতে ছিল একমাত্র বই। ছোটবেলা থেকে বইয়ের প্রতি এক অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব করতাম। রদ্দিওয়ালার কাছ থেকে ঠোঙ্গা বানানোর নাম করে পুরনো বই নিয়ে গোগ্রাসে পড়তাম। পড়াশুনা করার ইচ্ছে ছিল ছোট থেকেই। অর্থের জন্যে দু'বার পড়াশুনা বন্ধ করতে হয়েছিল। ১৯৯৮ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাশের পর ইচ্ছে ছিল কলেজে যাওয়া উচ্চশিক্ষা অর্জন করা। কিন্তু সংসারে অভাব থাকায় দেড় হাজার টাকা পকেটে সম্বল করে ফুটপাথে পানের দোকান খুলি। দোকান চালানোর ফাঁকেই চলে পড়াশোনা আর লেখালেখি। এভাবেই বাংলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ হয়। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা পাঠায়। আমার নিজের লেখার প্রতি আত্মবিশ্বাস ছিল। যদি আমার লেখার সংখ্যা দুহাজার হয় এর মধ্যে তিন হাজার লেখা আমি নিজেই বাদ দিয়েছি। প্রথমে কিছু লিটল ম্যাগাজিনে লেখা বেড় হতে শুরু হল। তারপরে প্রথম সারির কিছু পত্রপত্রিকায়। মনে আলাদা বল পেলাম।"  

pan seller has written thousands of stories, one novel after another, while sitting in shop
দীর্ঘদিনের দোকানদারি ও লেখালেখির পর্বের মাঝে বহু বিখ্যাত মানুষের প্রশংসা পেয়েছেন পিন্টু পোহান। এক্সপ্রেস ফটো -শশী ঘোষ

উচ্চ মাধ্যমিকের শেষে ছাপোষা মানুষটি চাকরির অনেক চেষ্টা করেছিলেন। বরাবরই ব্যর্থ হয়েছেন। দু'বেলা দু'মঠো অন্ন সংস্থানের খোঁজে অনেকবার পেশা বদল করতে হয়েছে। কখনও ইলেকট্রিকের কাজ, কখনও রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ, রাস্তার ধারে ফুলের দোকান দেওয়া, বাজারে মাছ বিক্রি করা, মেলায় মেলায় খাবারের স্টল দেওয়া, গ্রিল মিস্ত্রির হেলপার। সব জায়গাতেই ভাগ্যে জুটেছে পরিহাস। প্রতিকূল পরিস্থিতির বিরুদ্ধে পিন্টু পোহানের যেন এক কঠিন লড়াই। যে লড়াই আজও চলছে। গত ২৫ বছর ধরে তিন ফুট বাই তিন ফুটের দোকানটায় হয়ে উঠেছে সাহিত্যের ভাণ্ডার। খরিদ্দার সামলে চলছে পড়াশুনা। চালাচ্ছেন সংসার । পাশাপাশি চলছে তাঁর কলমও। জন্ম নিচ্ছে একের পর এক লেখা এই দোকানে বসেই। তাঁর বিখ্যাত বইগুলোর মধ্যে অন্যতম, 'ইলিশ খেকো ভুত, 'নোটন নোটন পায়রাগুলি', 'পারুল মাসির ছাগলছানা', কচুরিপানার ভেলা এবং ঝিনুক কুমার'। এর সাথে রয়েছে গল্প, কবিতা, তেমনই আছে উপন্যাস। পাবলিশার খুঁজতে গিয়ে আজও রীতিমতন হিমশিম খেতে হয়। পিন্টুবাবুর জীবনে লড়াই যেন অন্যতম সঙ্গী। 

pan seller has written thousands of stories, one novel after another, while sitting in shop
উচ্চ মাধ্যমিকের শেষে ছাপোষা মানুষটি চাকরির অনেক চেষ্টা করেছিলেন। বরাবরই ব্যর্থ হয়েছেন। দু'বেলা দু'মঠো অন্ন সংস্থানের খোঁজে অনেকবার পেশা বদল করতে হয়েছে। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ

"কে সাহায্য করবে আমাদের? যারা মনে করে না খেটেখাওয়া গরিব মানুষের কোনও মেধা থাকতে পারে! তাদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকা মানে জীবনের অমূল্য সময় নষ্ট করা। দোকানদারি করতে করতেই লিখেছি। দোকানদারি করতে করতেই পড়েছি। দোকান বন্ধ করে কলেজে যেতাম। আবার কলেজ থেকে সোজা দোকানেই ফিরতাম। সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সারাদিন আর ঘরে ফেরার কথা ভাবতাম না। কখনও দুপুরবেলা শুধু পাউরুটি আর জল খেয়ে কাটাতাম। কখনও শুকনো মুড়ি। কেউ কখনও জানতে চায়নি কীভাবে সংসার চলে! সারাদিন কিছু খেয়েছি কিনা। বরং অনেক উচ্চশিক্ষিত মানুষকে দেখেছি, গল্প বা কবিতা লিখছি শুনে নাক বিদ্রূপ করেছেন। আমাদের সমাজে মানুষরা সবাই এমনই। কত জন কতশত প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কথা দিয়ে কথা রাখেনি কেউ। হই হট্টগোলের মাঝে কেউ কখনও শান্ত মাথায় লেখালেখি বা পড়াশুনা করতে পারে? আমার মতন মানুষরা এই কঠিন পরিবেশে বসে অসাধ্যকে সাধন করে দেখায়। কারণ আমাদের দ্বিতীয় কোন অপশন নেই।" খদ্দের সামালাতে সামলাতে বলছিলেন পিন্টু পোহান।    

দীর্ঘদিনের দোকানদারি ও লেখালেখির পর্বের মাঝে বহু বিখ্যাত মানুষের প্রশংসা পেয়েছেন পিন্টু পোহান। তাঁকে বাহবা জানিয়ে পিঠ চাপড়ে গিয়েছেন অনেকে, কিন্তু দরকারে পাশে থাকেননি কেউ। কবি সাহিত্যিক মহলে না জুটেছে কোনও তকমা। না পেয়েছেন সরকারি সাহায্যে। আজও বিভিন্ন বিদ্রূপের মুখোমুখি হতে হয়। হাসি মুখে মেনে নেন। আমাদের সমাজ আজও শিক্ষিত হতে পারেনি। একজন পান বিড়ি বিক্রি করা দোকানদার দোকানে বসে গল্প লিখছে-রবীন্দ্ররচনাবলী পড়ছেন তা আজও সমাজের এক শ্রেণির মানুষ নিতে কষ্ট হয়। তবুও স্বপ্ন দেখা ছাড়েননি। চোখে এখনও স্বপ্নের ভিড়। আজও নিয়ম করে দোকান খোলেন। গুছিয়ে বসেন পসরা। সাদা খাতায় খসখস করে লিখে যান একের পর এক গল্প। জীবন সংগ্রামের নিত্য দিনের জমে থাকা শব্দেরা গল্প হয়ে ওঠে তাঁর কলমের ডগায়।  

West Bengal Success Story
Advertisment