Premium: সরু একফালি গলি, তারই কোণায় লুকিয়ে কলকাতা শহরের প্রথম 'মোমোর ঠেক'
Tibetan Delight: ধুলোমাখা হলুদ সাইনবোর্ডে লেখা দোকানের নাম। এছাড়া আর নেই কোনও চোখ ধাঁধানো কারুকার্য। নিতান্ত সাধারণভাবে পাতানো কিছু চেয়ার-টেবিল। এই নিয়েই সমতলের বুকে রূপকথার গল্প লিখে যাচ্ছে এই পাহাড়িয়া দোকান। ১৯৮১ সালে পথচলা শুরু কলকাতায় এই দোকানের। সাদা-কালো জমানার তিব্বতি খানার এই ঠেকের হাফ সেঞ্চুরি হতে আর বছর ছয়েক বাকি।
Tibetan Delight: ধুলোমাখা হলুদ সাইনবোর্ডে লেখা দোকানের নাম। এছাড়া আর নেই কোনও চোখ ধাঁধানো কারুকার্য। নিতান্ত সাধারণভাবে পাতানো কিছু চেয়ার-টেবিল। এই নিয়েই সমতলের বুকে রূপকথার গল্প লিখে যাচ্ছে এই পাহাড়িয়া দোকান। ১৯৮১ সালে পথচলা শুরু কলকাতায় এই দোকানের। সাদা-কালো জমানার তিব্বতি খানার এই ঠেকের হাফ সেঞ্চুরি হতে আর বছর ছয়েক বাকি।
Tibetan Delight: কলকাতার সঙ্গে মোমোর প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল এই দোকানটিই।
Tibetan Delight: তখনও অনলাইনের এত রমরমা ছিল না। ফোনের সিঙ্গেল স্ক্রিন টাচ করলেই খাবার নিয়ে হাজির হত না বাড়ির দরজায়। পাড়ার মোড়ে মোড়ে সন্ধের জল-খাবার বলতে ছিল চপ-মুড়ি। মোমোর ফুড চেইন তখনও গড়ে ওঠেনি এই শহরে। ভোজনবিলাসীদের কাছেই থাকত চপ-মুড়ির বাইরে অন্য ধরণের খাবারের দোকানের সন্ধান। এরকমই এক দোকান 'টিবেটিয়ান ডিলাইট' (Tibetan Delight)। তিব্বতি এবং পাহাড়ি খাবারের স্বাদ নিতে এখানে ভিড় করতেন বেশিরভাগ কলেজ পড়ুয়ারা।
Advertisment
রবীন্দ্র সদনের (Rabindra Sadan) মেট্রো (Metro) দিয়ে বেড়িয়ে চৌরঙ্গির গলি পেরিয়ে একফালি দোকানটি হয়ে উঠেছিল তিব্বতি খাবারের স্বর্গরাজ্য। টিবেটিয়ান ডিলাইটই কলকাতার সঙ্গে মোমোর প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। চপ, কাটলেট ছাড়াও যে মোমো, থুকপা এবং আরও সহস্র খাবারের অস্তিত্ব এই পৃথিবীতে আছে তা জানতে পারে কলকাতার (Kolkata) মানুষ।
সরু একফালি গলি, স্যাঁতস্যাঁতে নোনা ধরা দেওয়াল। তার একপ্রান্তে ছোট দোকান। গলির মধ্যে সূর্যের আলো ঢোকে না। দু'পাশে সাবেকি বাড়ি। চারপাশে অদ্ভুতুড়ে পরিবেশ। মৃদু আলো জ্বলে থাকে সর্বক্ষণ। ঝাঁ চকচকে বিজ্ঞাপনী মোড়ক নেই। ধুলোমাখা হলুদ সাইনবোর্ডে লেখা দোকানের নাম। এছাড়া আর নেই কোনও চোখধাঁধানো কারুকার্য। অতি সাধারণভাবে পাতানো কিছু চেয়ার টেবিল। এই নিয়েই সমতলের বুকে রূপকথার গল্প লিখে যাচ্ছে এই পাহাড়িয়া দোকান।
Advertisment
টিবেটিয়ান ডিলাইটের অন্যতম কর্ণধার প্রশান্ত মুখিয়া। এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।
১৯৮১ সালে 'টিবেটিয়ান ডিলাইট' এর জন্ম এই শহরের বুকে। সাদা-কালো জমানার তিব্বতি খানার এই ঠেকের হাফ সেঞ্চুরি হতে আর বছর ছয়েক বাকি। দার্জিলিং (Darjeeling) থেকে কলকাতায় এসে এই ব্যবসা শুরু করেছিলেন জিৎবাদল মুখিয়া এবং তাঁর পুত্র উদয় মুখিয়া। তাঁদের হাত ধরে শুরু হয় এই দোকান। পরবর্তীতে এই দোকানের দায়ভার নেন প্রশান্ত এবং তাঁর স্ত্রী। কিছু দিন আগে ব্যবসায়িক নিয়ম-কানুনের গেরোয় পড়তে হয়েছে রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষকে। যদিও সেসব বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে নিজের যাত্রা ফের শুরু করে দিয়েছে দোকানটি।
একফালি দোকানের ভিতরে বসলে যেন মনে হয় লাল চিনে লণ্ঠনের জাদুটোনা। অনেকটা 'এন্টার দ্য ড্রাগন' (Enter the Dragon) সিনেমার একটি দৃশ্যের মতো। যে দৃশ্যে ভিলেনের ঘরে ড্রাগ তৈরি হচ্ছিল। তেমনটাই। একেবারেই নীহাররঞ্জন গুপ্তের কোনও গল্পের প্রেক্ষাপট যেন। দরজার কাছেই একটি টেবিল। আর, বাকি দুটির একটিতেই 'কপোত-কপোতী' গল্প জুড়েছেন। এককোণে ক্যাশ কাউন্টার। দেওয়ালে টাঙানো চিনা অক্ষর। মেনুকার্ডে জ্বল জ্বল করছে খাবারের নাম। এখন অনেক ধরনের মোমো বানানো হলেও টিবেটিয়ান ডিলাইট এখনও সাবেকি মোমো তৈরিতেই নিজেদের আটকে রেখেছে।
প্রশান্ত মুখিয়া বলছিলেন "আমরা ইচ্ছে করেই অন্য কোন মোমো তৈরির দিকে যাই না। মোমো আমাদের পাহাড়ের মানুষদের লোকাল ফুড। ওখানে কোন ফ্লেভার মোমো তৈরি হয় না। আমরা আমাদের কাস্টমারদের মোমোর আসল স্বাদ উপভোগ করানোর জন্যেই সাবেকি মোমোতেই সীমাবদ্ধ থেকেছি। আমারা আমাদের খাবারের দামও খুব একটা বাড়াই না। যার জন্যে কলেজ পড়ুয়া, অফিসকর্মীদের আজও এটি খুব প্রিয় জায়গা।"
দার্জিলিং থেকে কলকাতায় এসে এই ব্যবসা শুরু করেছিলেন জিৎবাদল মুখিয়া এবং তাঁর পুত্র উদয় মুখিয়া। এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।
নেই সেরকম প্রচার। ফুড ব্লগারদের (Food blogger) অনেকের কাছেও এর ইতিহাস অজানা। এক কোণায় দোকান হলেও শহরের প্রথম মোমোর দোকানটিকে কখনও লোকসানের মুখ দেখতে হয়নি। যাঁরা আসল খাদ্যরসিক, তাঁরা ঠিক সময় বুঝে চলে আসেন এখানে। খদ্দেরের অভাব হয় না। আধাঁরি পরিবেশে ধোঁয়া ওঠা চিলি পর্ক, মোমো, থুকপার আসরে ডুব দিয়ে বসে থাকা যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সেই ট্র্যাডিশন আজও চলছে। প্রতিদিন শয়ে শয়ে কাস্টমারকে পরিষেবা দিতে দিতে মুখিয়া পরিবার কলকাতারই স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গিয়েছেন। পারিবারিক সম্বল বলতে তাঁদের এই রেস্তরাঁই।
সরু একফালি গলি, স্যাঁতস্যাঁতে নোনাধরা দেওয়াল। তার একপ্রান্তে ছোট দোকান টিবেটিয়ান ডিলাইট। এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।
সেটিকে টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মুখিয়া পরিবার। এই দোকানের সঙ্গে মোমোর ইতিহাস জড়িয়ে। মোমো ছাড়াও টিবেটিয়ান ডিলাইটের অন্যতম আকর্ষণ চিকেন 'কোথে'। 'কোথে' হল একপাশে হাল্কা ভাজা, অন্যপাশে স্টিমড মোমো। মুখে দিলেই গলে যাবে। সেই অপূর্ব স্বাদে বিভোর মন দিকবিদিক হারিয়ে পাহাড়ি পথ ধরে সোজা পৌঁছে যাবে ফালুট কিংবা সান্দাকফুর (Sandakphu) চুড়োয়। পেট এবং মন দুটোই ভরে যাবে একপ্লেটে। চোখের সামনে যেন ভেসে ওঠে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ। আর ঢেউ খেলানো পাহাড়। এখানে বসে এগুলো ভাবতে শুরু করলেই অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে অর্ডার অনুযায়ী সামনে চলে আসবে পাহাড়ের ধোঁয়া ওঠা গরম খাবার।