((শুধু শহর কলকাতা নয়, এ রাজ্যের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে এমন অনেক স্থাপত্য, যারা নিত্য চোখের সামনে থাকে বটে, কিন্তু তার ইতিহাস ও তার সঙ্গে বিজড়িত কাহিনিগুলি অজ্ঞাতই থাকে। এ রাজ্যের কিছু ‘হেরিটেজ’ হিসেবে চিহ্নিত ও ‘হেরিটেজ’ ঘোষণার অপেক্ষায় থাকা স্থাপত্যের কথা তুলে আনছেন দুই স্থপতি সুতপা যতি ও সায়ন্তনী নাগ। সে সব স্বল্প-জানা কথা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায়।)
কলকাতায় তাঁর নামে রয়েছে দু-দুটি মসজিদ। ব্যাঘ্রবিক্রমে লড়েছেন ইংরেজদের সঙ্গে। বহু যুদ্ধে জয়ী হয়ে অবশেষে শ্রীরঙ্গপত্তনমের যুদ্ধে নিজের দুর্গে তাঁর পতন। ব্রিটিশ সৈন্য ভেঙে ফেলেছে নগরের প্রাচীর, যুদ্ধ উপদেষ্টারা পরামর্শ দিচ্ছেন গুপ্ত দরজা দিয়ে পালিয়ে যেতে। তিনি বলছেন, ‘হাজার বছর ভেড়ার জীবন যাপনের থেকে একদিন বাঘের মতো বাঁচা অনেক ভালো’। দক্ষিণ ভারতের এই বাঘ মহীশূরের নবাব সুলতান ফতেহ আলি সাহাব টিপু। সংক্ষেপে টিপু সুলতান। যার নামে কলকাতার দুটি প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে দুই মসজিদ। অথচ তিনি নিজে কোনোদিন এ শহরে পা রাখেননি। ধর্মতলা আর টালিগঞ্জে দুটি টিপু সুলতান মসজিদ গড়ে ওঠার পিছনের কাহিনি জানতে হলে ইতিহাসের পাতা ওল্টাতে হবে।
আরও পড়ুন, ময়নাগড়ের ময়নামতী
১৭৫০ সালের ২০ নভেম্বর টিপুর জন্ম। পিতা হায়দার আলি প্রথমে মহীশূর রাজ্যের সেনাপ্রধান, পরবর্তীকালে মহীশূরের রাজা। বড় ছেলে টিপু তাঁরই সুযোগ্য পুত্র। তৎকালীন রাজনীতিতে টিপু সুলতানের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। তাঁর শাসনকালে যুদ্ধবিগ্রহ লেগে থাকলেও তিনি ছিলেন সুশাসক। মহীশূরকে তিনি এক গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে গড়ে তোলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতেই সেখানে জীবনযাত্রার মান, শ্রমের মজুরি উঁচু ছিল। তিনিই প্রথম রকেট আর্টিলারি ব্যবহার করেন। ইঙ্গ মহীশূর যুদ্ধ, পল্লিলুর যুদ্ধ ও শ্রীরঙ্গপত্তনমের যুদ্ধে তা ব্যবহৃত হয়েছিল। মহীশূরের রেশম বস্ত্র অর্থাৎ মাইসোর সিল্ক উৎপাদনকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যান তিনি। সিল্কের সংরক্ষণ এবং উৎপাদন পদ্ধতি শেখার জন্য বাংলার সুবেদারের কাছে বিশেষজ্ঞ পাঠান। নিজের রাজ্যকে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত রাখার জন্য তৎকালীন অটোমান রাজা এমনকি নেপোলিয়ান বোনাপার্টের সাথেও যোগাযোগ রেখে চলতেন।
তবু টিপু সুলতান ব্রিটিশদের কাছে পরাজিত হয়ে বীরের মৃত্যু বরণ করেন। রেখে যান বহু গল্পকথা। যেমন টিপু সুলতানের তরোয়াল। স্টিলে তৈরি তার হাতলে খোদাই করা আছে মহম্মদের বাণী। টিপুর মৃত্যুর পর বিজয় স্মারক হিসেবে ইংরেজ সৈন্যরা তার শেষ তরবারিটি নিয়ে যায়, দীর্ঘদিন তা ছিল ব্রিটিশ মিউজিয়ামে প্রদর্শিত, পরে তা নিলামে বিক্রি করা হয়। বিজয় মালিয়া এটি কিনে দেশে ফিরিয়ে আনেন। টিপু সুলতানের তরবারি নিয়ে টিভিতে ধারাবাহিক পর্যন্ত হয়েছে।
আরও পড়ুন, হাওড়া ব্রিজ: পঁচাত্তর বছর বয়সী সর্বংসহ
টিপু সুলতানের বহু স্ত্রী ও এগারোজন সন্তানের কথা জানা যায়। ১৭৯৯ সালের ৪ মে টিপুর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী, পুত্র কন্যা এবং তাঁদের পরিবারসহ সবাইকে বন্দি করে ভেলোরের দুর্গে পাঠায় ইংরেজ সরকার। ১৮০৬ সালে তাঁরা বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছেন বলে তাঁদের কলকাতার টালিগঞ্জ এলাকায় রাজনৈতিক নির্বাসনে পাঠানো হয়। তাঁদের জন্য পেনশনও বরাদ্দ করা হয়। কলকাতায় টিপুর কিনে রাখা বিশাল ভূসম্পত্তি ছিল। এভাবেই টিপুর বংশধরদের কলকাতায় আগমন। টিপুর কনিষ্ঠ পুত্র প্রিন্স গোলাম মহম্মদ আনোয়ার আলী শাহ তখন নিতান্তই বালক। কিন্তু বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে তিনি তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। বহু জনহিতকর কাজে অংশগ্রহণ করেন, রাস্তা ও গৃহনির্মাণেও তাঁর অবদান ছিল। তবে তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ পিতার স্মৃতিতে দুটি মসজিদ নির্মাণ করা।
কলকাতায় মসজিদ নির্মাণের সূচনা অধিকাংশই ইংরেজ আমল থেকে। ১৭৫৬ সালে সিরাজদৌল্লার ফোর্ট উইলিয়াম অঞ্চল দখলের আগে কলকাতায় মুসলিমদের তেমন আধিক্য ছিল না। পলাশির যুদ্ধে সিরাজের পতনের পর তাঁর সৈন্যসামন্ত, লোকজন মুর্শিদাবাদে ফিরে গেলেও কিছু রয়ে যান। ইংরেজরা শাসনভার গ্রহণ করার পর নানা প্রান্তের মুসলমান শাসকদের বহু দূত উপঢৌকন নিয়ে আসত শাসকের দরবারে। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি নতুন করে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণের কাজে বহু মুসলিম মিস্ত্রি, কর্মী, দিনমজুরের আগমন হল কলকাতায়। ব্যবসা বাণিজ্যের পীঠস্থান হয়ে ওঠা শহরে চামড়ার কারবারি, ঘোড়ার ব্যবসায়ী, রাজমিস্ত্রি, বাবুর্চি, ওস্তাগর হিসেবে পারদর্শী মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে লাগল। ফলে মসজিদের প্রয়োজনও বাড়তে লাগল। তবে এসব মসজিদের নির্মাতা বা পৃষ্ঠপোষকদের নাম জানা যায় না, বোঝা যায় এগুলি নির্মাণে অভিজাত বা উচ্চবিত্তদের তেমন ভূমিকা ছিল না। জনশ্রুতিতে উঠে আসে গুলু ওস্তাগর, বিবি বান্নো (ধাত্রী), কালু খানসামা প্রমুখের নাম। কোনও প্রতিষ্ঠালিপি বা ফলক পাওয়া যায় না। এমতাবস্থায় দুটি রাজনৈতিক নির্বাসনের ঘটনায় কলকাতায় মুসলিম বসতিস্থাপন শুরু হয়। একটি, অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের মেটিয়াবুরুজে নির্বাসন। দ্বিতীয়টি টিপু সুলতানের বংশধরদের টালিগঞ্জ অঞ্চলে নির্বাসন।
টিপু সুলতানের সম্পত্তির বেশিটাই বেদখল বা বেহাত হয়েছে। বর্তমানের রয়্যাল ক্যালকাটা গলফ ক্লাব, টালিগঞ্জ ক্লাব সবই আসলে ছিল টিপুর সম্পত্তি। ব্রিটিশ সরকার টিপুর পরিবারকে যে মাসোহারা দিচ্ছিল, সেই টাকায় টিপুর পুত্র গোলাম মহম্মদও প্রচুর ভূসম্পত্তি কিনেছেন মধ্য ও দক্ষিণ কলকাতায়। আচার্য জগদীশ চন্দ্র বোস রোডের ক্রিস্টান সিমেটারির জমিও ১৮৪০ সালে গোলাম মহম্মদের থেকেই কেনা। ১৮৭২ সালে তিনি ‘গোলাম মহম্মদ ট্রাস্ট’ গঠন করেন, যা ছিল এ দেশের সবচেয়ে ধনী মুসলিম ট্রাস্টগুলির অন্যতম।
গোলাম মহম্মদের নামাঙ্কিত রাস্তা প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড ও দেশপ্রাণ শাসমল রোডের সংযোগস্থলে সবুজ গম্বুজাকৃতির চূড়ার যে অভিনব স্থাপত্য, সেটিই শাহি টিপু সুলতান মসজিদ। ১৮৩৫ সালে চুন-সুরকির গাঁথনিতে তৈরি এই মসজিদকে গোলাম মহম্মদ মসজিদও বলে। বাংলার অন্য কোনো মসজিদের সাথে এর স্থাপত্যরীতি মেলে না, কেবল বসিরহাটের শালিক মসজিদের সাথে এর কিছু মিল পাওয়া যায়। এটির বৈশিষ্ট দুই সারিতে দশটি গম্বুজ, প্রতিটি গম্বুজের মাঝে ছোট ছোট আঠেরোটি মিনারেট। এছাড়া চার কোণে আটকোনা স্তম্ভের মাথায় চারটি বড় মিনার। ওই মিনারের পিলারের গায়ে তিন স্তরে ছোট ছোট খিলান খোদাই করা, যা গথিক খিলানের ধাঁচে। মসজিদের বাইরের দেয়ালে জোড়া খিলান, তাতে হিন্দু রীতির পংখের কাজ। আবার খিলানের নিচে ব্রিটিশ কলোনিয়াল যুগের স্টাইলে ছদ্ম দরজার আদল, দুপাশে গ্রিক ধাঁচের থাম। সব মিলিয়ে ইঙ্গবঙ্গ স্থাপত্য ধারার মিশেল।
হুবহু একই স্থাপত্যরীতিতে কয়েক বছর পর ১৮৪২ সালে নির্মিত হয় ধর্মতলার ১৮৫, লেনিন সরণীর টিপ সুলতান মসজিদ। দুটির মাথাতেই সমসংখ্যক গম্বুজ ও মিনার, চূড়ার রঙ সবুজ। তবে ধর্মতলার মসজিদটির মিনারের গঠনপ্রণালী খানিক আলাদা, ছোট মিনারেটগুলি উচ্চতায় খানিক বড়। দেওয়ালে কুলুঙ্গির নকশা, পংখে পলেস্তারার কাজ হুবহু এক। তবে টালিগঞ্জের মসজিদ চত্বরে রয়েছে টিপু সুলতানের বংশধরদের এগারোটি কবর। আছে অজু করার জন্য একটি পুকুর, জনশ্রুতি, কেউ অশুচী বস্ত্রে তা ব্যবহার করায় আজ অবধি যথেষ্ট গভীর হওয়া সত্বেও জলশূন্য। ধর্মতলার মসজিদের পাশে একসময় ছিল বড় পুষ্করিণী ‘এসপ্ল্যানেড ট্যাঙ্ক’। পুরোনো ছবিতে দেখা যায় সেই পুকুরের জলে গম্বুজ ও মিনার সহ মসজিদের প্রতিবিম্ব। এই মসজিদে মার্বেল ফলকে লেখা ‘This Masjid was erected during the Government of Lord Auckland, G.C.B. by the Prince Gholam Mohomed, son of late Tipoo Sultan, in gratitude to God and in commemoration of the Honorable Court of Directors granting him the arrears of his stipend in 1840’. ধর্মতলার মসজিদটিতে হাজার লোকের একসঙ্গে নমাজ পড়ার জায়গা আছে। ১৯৮০ সাল নাগাদ মেট্রো রেলের কাজের জন্য এই মসজিদটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। টিপু সুলতান শাহি মসজিদ প্রোটেকশন অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার কমিটি এবং মেট্রো রেল কতৃপক্ষ যৌথভাবে এর সংস্কার করে এবং এটি কলকাতা করপোরেশন দ্বারা হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃত হয়। সব ধর্মের মানুষের প্রবেশাধিকার আছে এই মসজিদে, যা অধিকাংশ মুসলিম উপাসনাগারেই নেই।
এর পরেও রয়ে যায় কিছু কথা। সংবাদসূত্রে জানা যায় কালের নির্মম পরিহাসে টিপু সুলতানের বংশধরদের কেউ কেউ চরম দারিদ্রের শিকার হয়েছেন। কেউ রিকশা চালিয়ে, কেউ আবার লোকের বাড়ি কাজ করে অন্নসংস্থান করেন। তবে আশার কথা, সম্প্রতি ওয়াকফ সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত কিছু অর্থসাহায্য পৌঁছচ্ছে তাঁদের হাতে। নাহলে বীর টিপু সুলতানের পরিবারের প্রতি এ দেশের চরম অবহেলা ক্ষমাহীন অপরাধ হয়েই থেকে যেত।