ডিজিট্যাল দানবের তান্ডবে শেষ হতে বসেছে বাঙালির সুপ্রাচীন ঐতিহ্য। ডিটিটালাইজেশন না কি সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তারের লড়াই? আজকের প্রযুক্তির যুগে আলপনা যেন ধীরে ধীরে তার সেই মাহাত্ম আজ কোথাও হারিয়ে ফেলছে। বদলে বাজারে রঙ্গোলির বাড়তে থাকা চাহিদা এবং বিক্রির দাপটে ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়ছে বাংলার আদি ও অকৃত্রিম আলপনা দেওয়ার ঐতিহ্য। বাঙালির সেই আদিম ও অনন্ত আলপনার ঐতিহ্য যাতে তার হারানো জৌলস ফিরে পেতে পারে তার লক্ষ্যে দীর্ঘদিন করেই কাজ করে চলেছেন আলপনা গবেষক বিধান বিশ্বাস। আর তারই উদ্যোগে কলকাতায় ১৯ শে মে থেকে ৪ঠা জুন ছবি ও ঘর আর্ট গ্যালারি সেজে উঠেছে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী আলপনার সাজে।
আলিপনা বা আলপনা, উৎস সংস্কৃত শব্দ 'আলেপন' অর্থ প্রলেপ দেওয়া বা লেপন করা। চালের গুঁড়ো বা খড়িমাটি জলে গুলে অনুষ্ঠানে মাঙ্গলিক হিসেবে তা আঁকা হয়। তাতে জীবনধারণের প্রয়োজনীয় নানা সামগ্রীর সরল উপস্থাপনা। বস্তুত আলপনা গ্রাম বাংলার সাংস্কৃতিক রত্ন ভান্ডারী নিদর্শন। শহরের আগ্রাসন যত বেড়েছে তত হরেক গ্রামীণ শিল্পকলার মতন আলপনা ক্রমশ হারিয়ে যেতে বসেছে। বর্তমানে না মেলে গ্রাম বাংলার গৌরব নিকোনো উঠোন বা না পাওয়া যায় লাল মাটির মেঝে। হারিয়ে যাওয়া এই প্রাচীন শিল্পকে ফিরিয়ে আনার লড়াই সেই সঙ্গে আলপনা এই শিল্পকলাকে স্থায়ী রূপ দিতেই বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী আলপনাকে কেন্দ্র করেই আয়োজিত হতে চলেছে এক ওয়ার্কশপ। থাকছে গ্রাম বাংলার হরেক আলপনাকে চাক্ষুস দেখার সুযোগ। বিধান বিশ্বাস যিনি নিজে একজন আলপনা গবেষক। বাংলার বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়েছেন আলপনার খোঁজে। তাঁর তুলিতে ফুটে উঠেছে সেই সব উঠোনের সাজ।
শৈশবে বাড়িতে নানা পার্বণে মা ঠাকুমাদের আলপনা দেবার চল এবং প্রতিনিয়ত তা দেখার অভ্যাস থেকেই মূলত আলপনার সঙ্গে একাত্ম হওয়া শিল্পী বিধান বিশ্বাসের। পশ্চিম সীমান্ত বাংলার মেয়েরা নানারকম নকশা বা আঁকাআঁকি করেন দেওয়ালে আবার পূর্ববঙ্গের মানুষের কোজাগরি লক্ষ্মী পুজো ও পৌষ পার্বণে আলপনা দেবার রীতি, এই ধরণের লৌকিক আমেজ বা চিত্র কলার একটা দিক যা সহজে অনুধাবন বা অনুশীলন করা যায় না। তাকে নিয়ে চর্চা করার এক অমোঘ আগ্রহ জন্মায় ছোট থেকেই।
গোবর লেপা হাতে তৈরি কাগজে পরবর্তীতে লাল মাটি লাগিয়ে জমি তৈরি করে তার ওপর খড়িমাটি দিয়ে আলপনার নকশা ফুটিয়ে তুলতেন তিনি। গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত এলাকা ঘুরে শিল্পী নানাবিধ ব্রত কথা ভিত্তিক ঠাট বা ইংরেজি প্রতিশব্দ তুলে আনেন তার আলপনার চরিত্র হিসেবে। ১৯৮৫ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভিজুয়াল আর্টসের উপর ডিপ্লোমা করার পর তিনি প্রায় ৬ বছর বাংলার লোকসংগীত এর চর্চা করেছিলেন। সেই সুবাদে তিনি স্বনামধন্য লোকসংগীত শিল্পী কালিদাস গুপ্তের সাহচর্য পেয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি যুক্ত ছিলেন বাংলার লোকনাট্যের সঙ্গে।
আলপনার ইতিহাস সম্পর্কে বলতে গিয়ে শিল্পী বিধান বিশ্বাস বলেন, “পাঁচ হাজার বছরের পুরনো হরপ্পা সভ্যতাতেও বাংলার আলপনার নকশার সন্ধান মিলেছে। এরপর বৌদ্ধ যুগ পেরিয়ে আজও লোকসমাজে রয়েছে গিয়েছে আলপনার মাহাত্ম। মূলত ব্রত অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বাংলার আলপনার প্রচলন। আধুনিক যুগের আগে ব্রত ও আলপনার মধ্যে দিয়ে সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠী তাদের ধর্ম বিষয়ক নানান চিন্তাভাবনা ফুটিয়ে তুলত”।
শিল্পী বিধান বিশ্বাস শুধুমাত্র আলপনার সূত্র খোঁজা অথবা আঁকার মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখেননি, ভারতবর্ষ এবং তার বাইরে তিনি প্রায় ৭৬ টি চিত্র প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছেন বাংলার লোকশিল্পের অগ্রগতির উদ্দেশ্যে। ১৯৯৫ সাল থেকে তিনি বহু কর্মশালা এবং সেমিনারের আয়োজন করে চলেছেন। সেই সঙ্গে বাংলার এই সুপ্রাচীন ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে ও তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে লড়াই জারি রেখেছেন তিনি।
নানান প্রদর্শনী বা কর্মশালার মধ্য দিয়ে আলপনার প্রসার বিস্তার করার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের নিত্যব্যবহার্য জিনিসে বা গৃহ শয্যায় অর্থাৎ সৌন্দর্য ও নান্দনিকতার ছোঁয়া আনতে সেই সঙ্গে তাকে দৃষ্টিনন্দন করতে আলপনার ব্যবহার করে সকলকে চমকে দিয়েছেন। একই সঙ্গে "বাংলার আলপনা' প্রদর্শনীতে রাঢ়বাংলার অজস্র প্রচলিত ব্রতকথাকে আল্পনায় ফুটিয়ে তুলেছে শিল্পী নিজেই। যা বাংলার লুপ্তপ্রায় আলপনাশিল্পের বেঁচে থাকার এক অনন্য প্রয়াস।
আজকের ডিজিটালাইজেশনের যুগে হারিয়ে যেতে বসেছে বাংলার এই সুপ্রাচীন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির নিদর্শন তার জায়গায় স্থান 'রঙ্গোলির বিক্রি বেড়েছে বহুগুণে। আলপনা-গবেষক বিধান বিশ্বাস এপ্রসঙ্গে জানিয়েছেন, 'অবাঙালিদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। তার ফলেই বাংলায় রঙ্গোলির দাপট অব্যাহত। কয়েক বছর পর আর এই শহরে আলপনা দেওয়া হবে কি না সন্দেহ আছে। নতুন প্রজন্ম আলপনা দিতে জানে না। এই কারণেই বিভিন্ন পুজোয় আর্ট কলেজের ছাত্রছাত্রীদের ডাক পড়ে।' কয়েক বছর আগে থেকেই বাজারে আলপনা স্টিকার এসে গিয়েছিল। যা সংস্কৃতির জন্য এক বড় ধাক্কা। সেই হিসাবে রঙ্গোলির 'অনুপ্রবেশ' কিছুটা দেরিতেই হচ্ছে।' শহর বা শহরতলীতেই ভাটা পড়েছে এই ঐতিহ্যের। আজও কলকাতা থেকে কয়েকশো কিলোমিটার দূরে বাঁকুড়া বা পুরুলিয়ার আদিবাসী গ্রামগুলোয় এখনও আলপনা স্বমিহমায় বিরাজ করছে।