"পুতুল নেবে পুতুল?" একটা সময় পড়ায় পাড়ায় এই ডাক ছিল বেশ পরিচিত। স্মার্টফোনের যুগ আসতে তখনও ঢের দেরি। বাচ্চাদের খেলনা বলতে কয়েকটা গাড়ি আর বেশীরভাগই পুতুল। পুতুলের বিয়ে ছিল ছোটদের অন্যতম আনন্দের এক খেলা। এসব এখন বড়ই ফিকে। ডিজিটালের যুগে বড্ড বেমানান। পুতুল খেলার বিষয়টি এখন পুরোপুরি উধাও হয়ে গিয়েছে। তার পরিবর্তে জায়গা করে নিয়েছে মোবাইল ফোন। পুতুল নিয়ে এখনকার বাচ্চাদের আর খুব বেশি খেলতে দেখা যায় না। সব সময়ই স্মার্টফোনের ভিডিও গেমে বুঁদ হয়ে আছে। নতুন প্রজন্মের অনেকেই জানে না কেমন ছিল সে সময়ের সব পুতুল! আর সেই পুতুলকেই বাঁচিয়ে রাখতে বারুইপুরের উজ্জ্বল সরদার নিজের বাড়িতেই গড়ে তুলেছে একটি সংগ্রহশালা।
বছর পঁয়ত্রিশের উজ্জ্বলবাবু ছোট থেকে নানা ধরণের জিনিস সংগ্রহের নেশা। শুধুমাত্র রাজ্যেরই নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের এমনকি বিদেশেরও বিভিন্ন ধরনের পুতুল জায়গা করে নিয়েছে তাঁর এই সংগ্রহশালায়। দোতলা বাড়ির ড্রয়িং রুমের শোকেজ জুড়ে সাজানো নানা রকম আকৃতির অসংখ্য পুতুল। কিছু অতি সাধারণ। আর কিছু প্রচলিত পুতুলের চেয়ে অনেকটাই আলাদা। পুতুল সংগ্রহের পাশাপাশি উজ্জ্বলের আরও দুটি আকর্ষণীয় সংগ্রহ সুন্দরবনের বিভিন্ন প্রত্নত্তাত্বিক জিনিস এবং বিভিন্ন সময়ের গুণী মানুষের হাতের লেখা। বেশির ভাগটাই নিজে সংগ্রহ করেছেন।
আরও পড়ুন- ‘তারার ছায়া’য় স্মৃতির সমাহার, অপূর্ব-কীর্তিতে চাগিয়ে উঠছে ইতিহাস-প্রেম
অনেকের মতন উজ্জ্বলবাবুও ছোটবেলায় আর পাঁচ জনের মতন মুদ্রার পাশাপাশি ডাকটিকিট সংগ্রহ করতেন। এরপর বয়স বাড়ার সঙ্গে সংগ্রহ করার নেশা পেয়ে বসে। উজ্জ্বলবাবুর কথায়,"বারুইপুরের বেশ বর্ধিষ্ণু পরিবার আমাদের। আমার ছোটবেলার কথা ভালোই মনে আছে, আমার বাবার দাদু দিদিমার কোলে কোলে ঘুরে পুরনো দিনের গল্প শুনতাম, এরকমই একদিন আমার বাবার দিদিমা আমায় একটা জর্দার কৌটো দিয়ে বলেছিল, 'তুই তো পয়সা জমাস এই কৌটোর ভিতরে পয়সা রাখিস।' এরপর যত দেশের বিদেশের পয়সা পেতাম সব এখানে জমাতে শুরু করি। ইতিহাস নিয়ে পড়াশুনা করছি পুরনো দিনের ইতিহাস ভালো লাগছে।'
তিনি বলেন, 'বুড়ো দিদিমা যখন বেঁচে ছিলেন তখনও বুঝিনি, উনি মারা যাওয়ার পরে একদিন সব পয়সা জর্দার কৌটো থেকে বের করেছি। পয়সা ঘাটতে গিয়ে দেখলাম পয়সাগুলো সব রাখা রয়েছে সাদা কাগজের উপর। কাগজটা খুলে দেখি একটি অঙ্কের প্রশ্নপত্র! প্রশ্নপত্রটি ছিল ১৯৪৭ সালের। যেটা আমার কাছে এই পয়সার চেয়েও বেশী মূল্যবান মনে হয়েছিল। তখন জমানো পয়সাগুলোর থেকে বেশী অবাক হয়েছিলাম প্রশ্নপত্রটি পেয়ে। যা এখনো আমার কাছে রাখা রয়েছে সংগ্রহে। আমার বেশ ভালো লেগেছিল। সেই থেকে শুরু।"
আরও পড়ুন- কলকাতার এই প্রবীণ সংগ্রহ করেন উনিশ শতকের অমূল্য সব ‘সুচ-সুতোর’ ভালোবাসা
কয়েক হাজার বছরের পুরনো পুতুলের যে পরম্পরা রয়েছে তা কীভাবে বিবর্তিত হচ্ছে এই ভাবনা চিন্তায় অনুপ্রাণিত করেছিল উজ্জ্বল সরদারকে। আর সেই কারণেই তাঁর এই সংগ্রহশালায় বিরাট অংশজুড়ে জায়গা করে নিয়েছে বিভিন্ন ধরনের বিভিন্ন সময়ের হরেকরকম পুতুল। স্বামী, স্ত্রী ও এক সন্তানকে নিয়ে উজ্জ্বল বাবুর সংসার। এছাড়া তাঁর আরও একটি সংসার রয়েছে। আর তা হলে পুতুলের সংসার। কী পুতুল নেই তাঁর সংগ্রহে? রাজ্যের বিভিন্ন জেলার পাশাপাশি বারাণসীর রাজা-রানি পুতুল, মুর্শিদাবাদের কাঁঠালিয়ার পুতুল, নদীয়ার ঘূর্ণির নিমাই পুতুল, বাঁকুড়ার বিবড়দার টুসু পুতুল,পাঁচমুড়ার ষষ্ঠী পুতুল, হিঙ্গল পুতুল, হনুমান পুতুল, বাংলাদেশ কাপড়ের পুতুল-সহ বিদেশী অনেক রকমের পুতুল রয়েছে উজ্জ্বল সর্দারের সংগ্রহে।
"ভূগোল, ভৌত বিজ্ঞান, জীবন বিজ্ঞান এই সব কিছুরই হাতে কলমে শেখার প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাস হয়। কিন্তু ইতিহাসের ক্ষেত্রে এসব কিছু হয় না। পুরনো রাজাদের হাতিয়ার কেমন ছিল। কেমন ছিল তখনকার মানুষের জীবন যাত্রা! আর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ নিজের জেলার ইতিহাসই অনেকে জানেন না। এসব জানার তাগিদেই ঘর থেকে বেড়িয়ে পরা। সুন্দরবন ঘুরে অনেক পুরনো জিনিসই জোগাড় করেছি যা বহু মূল্যবান।" নিজের ঘরে সুন্দরবনের দক্ষিণরায়ের পুতুল দেখাতে দেখাতে এই কথায় বলছিলেন উজ্জ্বল।
আরও পড়ুন- আদি থেকে আধুনিক, কলকাতার ‘ক্যামেরাম্যান’-এর জিম্মায় এক স্বর্ণালী ‘ইতিহাস’
ম্যানগ্রোভ অরণ্যে ঘেরা এই জনবসতিতে এমন কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন মিলেছে, যা থেকে মৌর্যযুগেও সুন্দরবনে মানুষের বসবাস ছিল বলে বোঝা যায়। অন্তত ৩২২-১৮৫ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের এই সভ্যতা অন্তত ৫০০-৬০০ বছর পর্যন্ত ছিল। এসব ইতিহাস বর্তমান প্রজন্মের অনেকে জানে না। এসব ইতিহাসই সযত্নে রেখেছেন এই সংগ্রাহক। এর জন্যে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে সুন্দরবনের বিভিন্ন দ্বীপ। এরকমই ঘুরতে ঘুরতে উজ্জ্বল খুঁজে পেয়েছেন টেরাকোটার খেলনা, প্রাচীন পুঁতির মালা, পেনড্যান্টের মতো বেশ কিছু জিনিস।
পুতুল এবং সুন্দরবনের প্রত্নত্তাতিক জিনিসের পাশাপাশি উজ্জ্বল সর্দারের আরেকটি নেশা হাতের লেখা এবং পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ। বিধান চন্দ্র রায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, স্যার আশুতোষ মুখার্জীর মতন আরও অনেক বিশিষ্ট মানুষের লেখা সংগ্রহে রয়েছে। উজ্জ্বল বাবুর হাতের লেখা সংগ্রহ করার পিছনে প্রধান কারণ, তিনি মনে করেন এসব মানুষের লিখে যাওয়া জিনিসের উপর হাত বোলালে যেন হয় এসব মানুষকে স্পর্শ করা যায়।
তাছাড়া আগামী প্রজন্মের সঙ্গে পরিচয় ঘটাতে হলে সংরক্ষণের প্রয়োজন। এই কাজটায় তিনি মন দিয়ে করে যাচ্ছেন। আজকে যা নতুন, কাল তা পুরনো বহু মূল্যবান। এসব জিনিস দিয়ে তৈরি হয় ইতিহাস। এই ইতিহাসকেই হাতে কলমে ধরে পরীক্ষা করার জন্যেই উজ্জ্বল সর্দার যত্ন করে সংগ্রহ করছেন অমূল্য এক ভাণ্ডার।