ফুল উৎপাদনে পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়া ব্লক রাজ্যের মধ্যে অন্যতম। সারাবছর বিভিন্ন ধরনের ফুল, বিশেষ করে গোলাপ, বেল, রজনীগন্ধা, গ্ল্যাডিওলাস, এ্যাসটার, গোল্ডেন রড, মুরগাই এসবের সঙ্গে চন্দ্রমল্লিকা বা ক্রিসানথিমামের চাষও হয়ে থাকে। তবে চন্দ্রমল্লিকা চাষ বিগত কয়েক বছরে ক্রমশ বাড়ছে। এই এলাকার উৎপাদিত ফুল এখন পাড়ি দিচ্ছে বাংলা ছাড়িয়ে ভিনরাজ্যে। উৎসাহ বাড়ছে চাষিদের মধ্যে।
এখন গতানুগতিক চাষ থেকে বেরিয়ে একপ্রকার অজান্তেই চাষে বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে প্রয়োজন মাফিক ফুল উৎপাদনে সক্ষম হচ্ছেন চন্দ্রমল্লিকা চাষিরা। তাই বিশেষ লগন বা বাজার দেখে ফুল উৎপাদনে সক্ষম হচ্ছেন তাঁরা। ফলে বাজার মন্দা থাকাকালীন ক্ষেতে ফলন না এনে ফুলের ক্ষেতে আলো জ্বালিয়ে কার্যত দিনের মতো পরিবেশ সৃষ্টি করে ফুলকে দেরি করে ফুটিয়ে অধিক লাভের মুখ দেখতে সক্ষম হচ্ছেন পাঁশকুড়া এলাকার চন্দ্রমল্লিকা চাষিরা। পাঁশকুড়া ব্লকের নারান্দা, মহৎপুর, কেশাপাট এলাকায় বহু চাষি এখন এই মাঠে আলোকপদ্ধতি ব্যবহার করে ফুল দেরীতে ফুটিয়ে লাভের মুখ দেখেছেন বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে।
আরও পড়ুন: হস্তশিল্পে উন্নত ডিজাইনের জন্য কম্পিউটার ব্যবহারের নিদান অমিত মিত্রের
গ্রীক ভাষায় 'ক্রিসস' শব্দের অর্থ সোনালি আর 'অ্যান্থেমন' শব্দের অর্থ ফুল। ক্রিসানথিমামের পুরো অর্থ হলো 'সোনালি ফুল'। এর আদি বাসভূমি জাপান ও চিন। চন্দ্রমল্লিকা ফুল আলোক সংবেদনশীল। বেশিক্ষণ আলোক সংস্পর্শ করলে ফুল আসতে দেরি হয়। পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ চন্দ্রমল্লিকা উৎপাদিত হয় পাঁশকুড়া ব্লকে। পাঁশকুড়ার মহৎপুর গ্রামে ব্যাপক পরিমাণে উৎপন্ন হয় এই ফুল। সাধারণ উপায়ে চাষবাস দীর্ঘদিন যাবৎই এখানে হয়ে আসছে। কিন্তু কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, নিজেদের অজান্তেই তাঁরা নতুন এই আলোকপদ্ধতিটি আয়ত্ত করেছেন। কোনও কৃষিবিজ্ঞানীদের সহায়তায় নয়।
চন্দ্রমল্লিকার খেতে বিদ্যুতের আলো
মহৎপুর গ্রামের কৃষক অমিয় সাহু জানালেন, চন্দ্রমল্লিকা চাষে এই আলোকপদ্ধতি ব্যবহারের ফল এলাকার দু-একজন কৃষক ২০০৪ নাগাদ কিছুটা উপলব্ধি করেন। তিনি বলেন, "এলাকায় অনেক চন্দ্রমল্লিকার ক্ষেত বসতবাড়ির কাছেই রয়েছে। লক্ষ্য করা যায়, বাড়ির সামনে থাকা বাগানের যে অংশ রয়েছে, বা বলা যেতে পারে বাড়ির আলো মাঠে পড়ছে যে অংশে, সেখানে ফুল ফুটতে দেরি হচ্ছে, আর কিছুটা দূরে বাগানের অংশে স্বাভাবিক সময়েই ফুল আসছে। এ বিষয়টি দেখে চাষিরা চন্দ্রমল্লিকা ক্ষেতে এই পদ্ধতি ব্যবহার করার কথা ভাবতে শুরু করেন।"
সাধারণত আশ্বিন মাসের শেষের দিকে লাগানো হয় চন্দ্রমল্লিকার চারা। এর পাঁচ সাত দিন পর থেকেই মাঠে আলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। চাষিদের লক্ষ্য থাকে মাঘ ফাল্গুন মাসে বাজার ধরার। ফুল দেওয়ার ৫০ থেকে ৬০ দিন আগে আলো জ্বালানো বন্ধ করে দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন: অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে মহিষাদলের কাঁসাশিল্প
এই পদ্ধতি ব্যবহার করে ফুলের ফলনের সময় এখন নিজেদের হাতেই রেখেছেন ফুলচাষিরা। বাজারের চাহিদা অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে আলো ব্যবহার করে অসময়ে অধিক ফলনে সক্ষম হচ্ছেন তাঁরা। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতি একরে ৩০০টি ১০০ ওয়াটের ল্যাম্প ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে ইলেকট্রিক খরচ কমানোর জন্য এখন সাদা রঙের সিএফএল ল্যাম্প ব্যবহার করছেন কৃষকেরা। এতে বিদ্যুতের খরচ অনেকটাই কমে। কৃষকদের হিসেবে, দুমাস বা আর একটু বেশি সময় ধরে যদি এক একরে পঁচাত্তর হাজার থেকে এক লক্ষ টাকা বিদ্যুতের পিছনে খরচ করা হয়, তাহলে বিয়ের লগন বা বিশেষ লগনের সময়ে এক একর জমি থেকে দেড় লক্ষের বেশি মুনাফা পাওয়া যায়।
অমিয়বাবুর কথায়, ২০০৩-০৪ সাল নাগাদ এই সমস্ত গ্রামে হাতেগোনা কয়েকজন চন্দ্রমল্লিকার চাষ করতেন। তবে বর্তমানে এই চাষির সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া দূরবর্তী এলাকাতেও চন্দ্রমল্লিকা চাষের প্রসার ঘটেছে। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কৃষি আধিকারিক মৃণালকান্তি বেরা জানান, "যদিও ফুল চাষ উদ্যান পালন বিভাগের আওতায় পড়ে, তবুও কৃষকদের নানা সমস্যায় পাশে থাকে ব্লকের কৃষিদপ্তর। যে কোনও পরামর্শ দেওয়া ছাড়া কৃষকের নানা সমস্যায় পাশে থাকার চেষ্টা করা হয়। আলোকপদ্ধতি একটি বিজ্ঞানের ব্যবহার মাত্র। যদিও এলাকার কৃষকেরা নিজেরাই প্রথমে রপ্ত করেছিলেন। এখন তা আরও উন্নতভাবে ব্যবহার করছেন কৃষকেরা। কৃষিদপ্তরের পরামর্শও নেন বহু চাষি।"