আমি রায়গঞ্জের ঊষসী চক্রবর্তী। গত ১৬ ফেব্রুয়ারির পর থেকে ডিজিটাল মাধ্যমের খবরের দৌলতে আমি কারও কাছে সুপরিচিত, কারও কাছে আবার কুপরিচিত। কারণ আমি নিজের বাড়ির সরস্বতী পুজো সাম বেদ মেনে করেছি। এমনকি সেই সংক্রান্ত একটা পোস্ট ফেসবুকে করি। তারপর থেকেই বিতর্ক আর আমি সমার্থক হয়ে গিয়েছি। তবে আমার বাবা আমাকে শৈশব থেকেই পুজোর সমস্ত আচার, মন্ত্র-সহ শিখিয়েছেন। নিজে একজন কুলীন ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। ছোট থেকে আমি শুনেছি মেয়েরা পুজো-উপাচারে পৌরহিত্য করতে পারে না। এমনকি ঋতুচক্র চলাকালীন নারীরা অশুচি। তাই পুজোর মতো কোনো শুভ কাজে তাঁরা হাত লাগাতে পারেন না। তবে যত বয়স বেড়েছে বুদ্ধি, জ্ঞান, শিক্ষা বেড়েছে, আর ধীরে ধীরে যুক্তি দিয়ে বিচার করে বুঝেছি এগুলো এক একটা কুসংস্কার। কারণ, আমাদের কোন পৌরাণিক ধর্ম গ্রন্থে এসব কথা লেখা নেই। তাই আমার মনে হয় এই কুসংস্কারগুলো ভাঙা দরকার।
পৌরহিত্য করার অধিকার নারী -পুরুষ সবার সমানভাবে রয়েছে। আর ঋতুচক্র একটা জৈবিক ক্রিয়া কেউ বলেন এটা ভগবানের সৃষ্টি। তাই ঋতুচক্র কখনই ‘অশুভ’ হতে পারে না। আমি বিশ্বাস করি মন শুচি মানে সব শুচি। আমার মতে, উপবাস করে পুজো না করলে, সেই পুজো ঠাকুর গ্রহণ করেন না এই ধারণাটাও কুসংস্কার। কারণ উপবাস মানে পেটে খিদে আর মনে খাবারের চিন্তা । আর সেই চিন্তা নিয়ে পুজোতে কোনো ভক্তি আসে না। মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। তাই যাঁদের উপবাসে মানা, তাদের খেয়েই ভক্তি মনে পুজো করা উচিত। শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব, মা সারদাকে ঋতুচক্রের সময় পুজো করার অধিকার দিয়েছিলেন। তার পরও আমার হিন্দু সমাজ এই কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি!
এদিকে আমার বাড়ির লোকের বেশ কিছুটা সময় লাগলেও, তারা কুসংস্কার ভেঙে পুজো নিয়ে আমার অবস্থানকে সম্মান জানিয়েছেন। তাই সরস্বতী পুজোতে আমি পৌরহিত্য করলে সমাজ আমায় নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত। আমার পক্ষে এবং বিপক্ষে কথা বলার লোকের সংখ্যা বেড়েছে। যারা আমার পক্ষে কথা বলছেন তারা জানিয়েছেন, এতদিন এই কুসংস্কার ভাঙার সাহস পাচ্ছিলেন না। আমায় দেখে এবার সাহস পেলেন। আর তাঁরা কুসংস্কার মেনে ওই ক’টা দিন শুভ কাজের থেকে নিজেদের দূরে রাখবেন না। অনেকে জানিয়েছেন ঋতুচক্রের কথা আলোচনা করতে আর তারা লজ্জা পাবেন না। আমায় দেখে তারা সাহস পেয়েছেন। একজন অশীতিপর বৃদ্ধা আমায় ফোন করে প্রণাম জানিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য , ‘যে গোঁড়ামির বিরুদ্ধে এতদিন ভয়ে মুখ খোলার সাহস পাননি, আজ আমি তা কাজে করে দেখিয়েছি।‘ অনেকে আবার আমায় ফোন করে আশীর্বাদ নিয়ে তাঁদের বিবাহিত জীবন শুরু করতে চেয়েছেন। এক তরুণী আমায় তাঁর বিয়েতে পৌরহিত্য করার আর্তি করেন। সেই তরুণীর বিয়ে পয়লা মার্চ। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে আমার পক্ষে বিয়ের নিয়মনাস্তি জেনে প্রস্তুত হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু তাঁর আবদার ছিল, ‘যতটুকু জানি, সেই জ্ঞান থেকেই যাতে তাঁর বিয়েটা উতরে দিই।‘ বিয়ের মতো মহার্ঘ উৎসবের জন্য আমি তৈরি নই, এটা বলেই সেই তরুণীকে আমি ক্ষান্ত করি।
এবার যারা আমার বিপক্ষে কথা বলছেন, তাঁদের দাবি, ‘আমি ঠাকুরকে অসম্মান করেছি, হিন্দু ধর্মকে অপমান করেছি। এবং এর ফলে পশ্চিমবঙ্গে সুনামি, ভূমিকম্প এমনকি আমফানের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগও নেমে আসতে পারে।‘ আবার কিছুজন বলেছেন, আমার জন্যই ভারতে নাকি করোনা এসেছে। কেউ আবার বলছেন আমার ঋতুচক্রের সময় সাংবাদিকরা জানে মানে, তাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আছে। এছাড়া ফোন আর মেসেজে এখন অবধি বেশ কিছু হুমকি এসেছে। আমাকে গণধর্ষণ করা এবং খুন করার হুমকি এসেছে। সব থেকে আশ্চর্য বিষয় হল পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেশ কিছু মহিলারাও এই ধরনের কথা বলছেন আমার বিপক্ষে।
আমি মনে করি কুসংস্কার ভাঙতে গেলে পক্ষের থেকে বিপক্ষে লোক বেশি থাকবে। কারণ বিধবা বিবাহের পক্ষে সই ছিল কম আর বিপক্ষে সই ছিল বেশি। কিন্তু তারপরেও বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ চালু করতে সমর্থ হয়েছিলেন। অন্যদিকে, এটাও প্রচলিত ছিল যে রানি রাসমণি ব্রাহ্মণ ছিলেন না। তাই তিনি যখন দক্ষিণেশ্বরে ভবতারিনীর মন্দির স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তখন সমাজের থেকে সেভাবে সহযোগিতা পাননি। একইভাবে আমার সরস্বতী পুজোয় পৌরোহিত্যের পর পুরোহিতদের একটা অংশ সংবাদমাধ্যম কে জানিয়েছেন, মনের ইচ্ছেমতো ধর্ম নিয়ে ছেলেখেলার ফলে আমার দূর্যোধনের মতোঅবস্থা হবে। কিছু পুরোহিত জানিয়েছেন দেবী সরস্বতী নাকি আমার এই পুজো গ্রহণ করেননি। আবার কালীঘাটের পুরোহিতরা জানিয়েছেন তারা ঋতুচক্র চলাকালীন কোনও মহিলাকে প্রবেশ করতে দেন না। এবার এসব শুনে আমার মনে কিছু প্রশ্ন জেগেছে। এই লেখার মাধ্যমেই সেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম। আশা করি জবাব পাব--
১. মা সরস্বতী যে আমার পুজো নেয়নি সেটা তারা কী করে জানলেন? ঠিক কি দেখে বোঝেন ঠাকুর কার পুজো গ্রহণ করছেন, আর কারটা প্রত্যাখান করেছেন?
২. ঋতুচক্র চলছে এমন মহিলা পুজো দিতে এসেছেন এটা কীভাবে বোঝা সম্ভব?
৩. যারা বলছেন ঋতুচক্রের সময় জানিয়ে দেওয়া মানেই তার সাথে অবৈধ সম্পর্ক, তাদের কাছে প্রশ্ন এনিয়ে এত গোপোনীয়তা কীসের? এটা তো মল-মুত্র ত্যাগের মতোই জৈবিক বিষয়। সেটা নিয়ে লজ্জা পাওয়া কিংবা লুকনোর কোনো কারণ নেই বলে আমি মনে করি।
৫) অব্রাহ্মণ রানি রাসমনির মন্দিরে স্থাপিত মা ভবতারিনী তাহলে কী যুগ-যুগ ধরেই ক্ষুব্ধ?
৬). আর কতদিন নিজেদের বানানো কুসংস্কার নিয়ে লড়বেন?
অনুলিখন: জয়দীপ সেন