'যদিও আকাশ ধোঁয়াশায় ম্রিয়মান, তোমার জন্য লিখছি প্রেমের গান।' সকাল থেকেই কবির সুমনের এই গানটির লাইন দুটি মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আজ তো ভ্যালেন্টাইন ডে! শহর জুড়ে প্রেমের মরশুম। শীতের আমেজ এখনও যায়নি। রোদের আলোর সাথে শীতল হাওয়া জানান দিচ্ছে বসন্তের। প্রেম দিবসে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে চলছে ভালবাসার উদযাপন। আচ্ছা ভালোবাসার রং কী? কেউ বলবেন লাল! কেউ বা নীল। যদি বলি রং অনেক। রামধনুর মতো। সব রঙের মিশেলে তৈরি এক পবিত্র অনুভূতি। তবে ঠিক শুনেছেন। প্রেম না মানে জাতি, না মানে ধর্ম! না লিঙ্গ! প্রথাগত ছক ভাঙ্গার গল্প তৈরি হয় প্রতিনিয়ত। এরকমই এক ভিন্ন প্রেমের ছক ভাঙ্গার গল্প তৈরি করেছেন রুপান্তরকামী রঞ্জিতা সিনহা এবং শিভান্স ঠাকুর। এক ছাদের তলায় তাঁদের ছোট সংসার। সমাজ-সম্প্রদায়-পরিবার সকলের বাঁকা চাউনিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ওঁরা প্রতি মুহূর্ত বুঝিয়ে দিচ্ছে এভাবেই বেঁচে থাকা যায়। এই পৃথিবী আমাদের সকলের।
ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্রান্সজেন্ডার বোর্ডের সদস্য রঞ্জিতা সিনহা শিভান্স ঠাকুরের সঙ্গে আট বছর ধরে সম্পর্কে রয়েছেন। রঞ্জিতা একজন রুপান্তরকামী মহিলা। ফেসবুকে দুজন দুজনের সঙ্গে আলাপ। কথা বলতে বলতে মন দেওয়া নেওয়া। এরপর মাঝে কেটে গিয়েছে অনেকগুলো বছর। প্রেমের বয়স বাড়তে থাকে। "বর্তমান সময়ে ভোগবাদের মাধ্যমে ভ্যালেন্টাইনস ডে-র প্রচার বাড়ানো হচ্ছে।
কিন্তু, আমাদের কাছে ভালোবাসাটা বড় পাওনা" বলছিলেন রঞ্জিতা। কচি কলাপাতা রঙের ফতুয়ায় পাশে বসা শিভান্স ঠাকুর মনোযোগ দিয়ে শুনছিল রঞ্জিতার কথা। "প্রতিদিনই ভালোবাসার দিন, তবে ভালোবাসার জন্য একটি বিশেষ দিন থাকার বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের কাছে মনের জোর বাড়িয়ে দেয় ভালোবাসা। ভ্যালেন্টাইনস ডে উদযাপন করতে ভালো লাগে ভালোবাসার মানুষটির জন্য সময় দিই। এক সাথে সময় কাটাতে ভালো লাগে।" বলে চলছিলেন রঞ্জিতা সিনহা।
শিভান্স এবং রঞ্জিতার জীবনে বহুবার প্রেম এসেছে। তবে সেই প্রেম বেশীদিন চিরস্থায়ী ছিল না। বারংবার প্রেমে প্রতারিত হয়ে রঞ্জিতার ভালোবাসার থেকেই বিশ্বাস উঠেই গিয়েছিল। এরপর আলাপ শিভান্সের সঙ্গে। বয়সে ছোট শিভান্স একজন 'ট্রান্সম্যান'। প্রথম দিকে রঞ্জিতা এতটা গুরুত্ব না দিলেও পরের দিকে তাঁর বুঝতে দেরি হয়নি এই সম্পর্ক সব থেকে আলাদা। "যার কাছে আবদার বায়না সবই করা যায়। মন খুলে কাঁদা যায় দুঃখ পেলে। এমনই মানুষই তো দরকার সারা জীবন কাটিয়ে দেওয়ার জন্যে। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে প্রেম জিনিসটা ভরসার জায়গা। ভালোবাসার দিন উদযাপন করতে তার জন্যে নিদিষ্ট কোন দিনের প্রয়োজন পরে না। প্রতিটা দিনই ভালোবাসার।" এমনটাই বলছিল শিভান্স। প্রেমে দিবস যেন একটা নতুন ভোরের অপেক্ষা।
সমকামীদের প্রতিনিয়ত টিকে থাকার লড়াই নতুন কিছু নয়। ডিজিটালের যুগে সমকাম নিয়ে এই সমাজের কুসংস্কার এবং গোঁড়ামি এখনও যায়নি। বহু প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে যেতে হচ্ছে রূপান্তরকামী মানুষদের। রূপান্তরকামীদের অধিকার অর্জনের লড়াই ঘরে এবং ঘরের বাইরে সমানভাবেই চলে। অবহেলিত নিপীড়িত ট্রান্সজেন্ডারদের জন্যে রঞ্জিতা সিনহা সব সময়ই দরজা খুলে রেখেছেন। কেউ ট্রান্সম্যান। কেউবা নন-বাইনারি। কেউ ট্রান্সওম্যান। একে অন্যকে ভালোবাসছে। এই ভালোবাসার বাড়িতে কোনও ঘৃণা নেই আছে শুধুই প্রেম। রঞ্জিতা এবং শিভান্সের সম্পর্ক মধ্যে সকলে ভালবাসা-প্রেমের নতুন মানে খুঁজে পান। আবিষ্কার করেন প্রেমের নতুন রঙ। রঞ্জিতা বলেন, "আগের থেকে সমাজ অনেক পরিণত। আমরা ধীরে ধীরে মানুষকে বোঝাতে পেরেছি আমাদের অস্ত্বিতের কথা। কিন্তু এখনও অনেক জায়গা রয়েছে যেখানে একজন ট্রান্স ভাই বা বোন বিপদে পড়লে কেউ এগিয়ে আসে না। এটা খুব দুঃখজনক। তবে আমার বিশ্বাস এগুলো সব একদিন ঠিক হয়ে যাবে। ভালবাসাকে কখনও আটকে রাখা যায় না। এই পৃথিবীর সবই মানুষই সুন্দর। তেমনই সুন্দর আমাদের সব সম্পর্কই।"