পুরনো আমলের পাঠশালা ব্যবস্থার ঢঙে জনা পঁচিশ পড়ুয়াকে পড়াচ্ছেন একজন শিক্ষক বা শিক্ষিকা। বিনামূল্যে মিলছে পাঠ সরঞ্জাম, খাবার। শরীরচর্চা, খেলাধুলো- সব কিছুরই ব্যবস্থা রয়েছে। বাহ্যত কোনও সমস্যা নেই। ভাল উদ্যোগ। সর্বভারতীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যেগে রাজ্যের প্রতন্ত এলাকার হতদরিদ্র ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা শেখানো হচ্ছে। কিন্ত পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে গজিয়ে ওঠা এমন কয়েক হাজার নন ফর্মাল স্কুলকে ঘিরে লোকসভা নির্বাচনের আগে কার্যত ঘাম ছুটেছে বাম ও তৃণমূল নেতৃত্বের। তাঁদের অভিযোগ, একল বিদ্যালয় নামে পরিচিত এই স্কুলগুলি বাস্তবে সংঘ পরিবারের আঁতুড়ঘর। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মগজে এখান থেকেই ঢুকিয়ে দেওয়া হয় হিন্দুত্বের পাঠ। পাশাপাশি, তাদের অভিভাবকদের গেরুয়া শিবিরের ছত্রছায়ায় আনতে নেওয়া হয় বিবিধ ‘সামাজিক’ কর্মসূচি। বিজেপি বিরোধী শিবিরের আশঙ্কা, কাশ্মীর, ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ডের মতো এই রাজ্যের ভোটেও প্রভাব বিস্তার করতে পারে গেরুয়া শিবিরের একল বিদ্যালয়।
সূত্রের খবর, গত কয়েক বছরে নিঃশব্দে বঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে অসংখ্য একল বিদ্যালয়! উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের যে আসনগুলি বিজেপি সম্ভাবনাময় বলে মনে করছে, সেগুলিতে ফলাফল নির্ধারণে এই স্কুলগুলি ভূমিকা নিতে পারে বলে আশঙ্কায় তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশ। সংঘ সূত্রের খবর, রাজ্যের নির্দিষ্ট কয়েকটি জেলাকে টার্গেট করে বিপুল সংখ্যায় এমন স্কুল গড়ে তোলা হয়েছে। কেবলমাত্র ভোট নয়, গেরুয়া শিবিরের জন্য কয়েক হাজার যুব ক্যাডার তৈরি করাও লক্ষ্য।
একল বিদ্যালয় কী?
দেশজুড়ে ৬ থেকে ১৪ বছরের শিশুদের জন্য ‘একল বিদ্যালয়’ চালায় ভিএইচপি। মূলত হতদরিদ্র পরিবারের স্কুলছুট ছেলেমেয়েরাই ওই ‘নন ফর্মাল’ পাঠশালার শিক্ষার্থী। অন্য রাজ্যে একল বিদ্যালয়ের মূল লক্ষ্য থাকে প্রত্যন্ত আদিবাসী এলাকার ছেলেমেয়েদের নিজেদের আওতায় নিয়ে আসা। বাংলায় অবশ্য যে কোনও গরীব পরিবারের সন্তানকেই ভর্তি নেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি একল বিদ্যালয়ে ২০ থেকে ২৫ জন শিক্ষার্থীকে পড়ানো হয়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে সংখ্যাটি ৩০-৩৫ ছোঁয়। কিন্তু তার বেশি কখনই নয়। পড়ান একজন শিক্ষক বা শিক্ষিকা। সপ্তাহে ছ’দিন দু’ঘণ্টা করে ক্লাস নেওয়া হয়। শেখানো হয় অঙ্ক, বিজ্ঞান, ইংরেজি, স্থানীয় ভাষা। সঙ্গে ভারতীয় সংস্কৃতি, পরম্পরা ও দেশপ্রেমের পাঠ, ব্যবহারিক ও চারিত্রিক উন্নতির পথনির্দেশ। গল্পচ্ছলে ব্যাখ্যা করা হয় হিন্দু ধর্মের নানা বিষয়। স্কুল শুরু হয় সূর্য প্রণাম ও সরস্বতী বন্দনার মাধ্যমে। গল্পচ্ছলে বৈদিক দর্শন, রামায়ণ, মহাভারতের পাঠ দেওয়া হয়। হিন্দুত্বের ‘মহান’ দিকগুলি সম্পর্কে অবগত হয় খুদে পড়ুয়ারা।
আরও পড়ুন, রাম মন্দির কি ভোট টানতে পারবে?
রাজ্যে একল বিদ্যালয়
পশ্চিমবঙ্গে বর্তমানে একল বিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন হাজার। গেরুয়া নেতৃত্ব জানাচ্ছেন, সঠিক সংখ্যাটি ৩৫৪৩। লোকসভা নির্বাচনের আগে রাজ্যে এমন স্কুলের সংখ্যা ৪০০০ ছুঁতে পারে বলে আশঙ্কা দক্ষিণবঙ্গের একাধিক তৃণমূল নেতার। দেশেজুড়ে এখন একল বিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার। ২০২০ সালের আগে তা এক লাখ করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। সূত্রের খবর, গত ২ বছরে রাজ্যে হাজারখানেক নতুন একল বিদ্যালয় তৈরি হয়েছে। মূলত বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) পরিচালনা করলেও সংঘের অন্য সংগঠনগুলিও এই স্কুলের কাজে সক্রিয়।
সঙ্ঘ পরিবার সূত্রের খবর, রাজ্যে সবচেয়ে বেশি একল বিদ্যালয় রয়েছে রামপুরহাট ব্লকে। প্রায় ৩৩০টি। এছাড়া আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, দুই চব্বিশ পরগনার সীমান্তবর্তী এলাকা, জঙ্গলমহলের জেলাগুলিতে বড় সংখ্যায় তৈরি হয়েছে এই নন ফর্মাল স্কুল। গেরুয়া শিবিরের দাবি, একটি একল বিদ্যালয় চালাতে বছরে খরচ হয় ২০ হাজার টাকা। সেই টাকা আসে একল বিদ্যালয়ের সর্বভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। বিশ্বজুড়ে একল বিদ্যালয়ের ডোনার রয়েছে। প্রথম বিশ্বের দেশগুলি থেকে আসে বিপুল অঙ্কের অনুদান। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে কার্যত সমান্তরাল শিক্ষাব্যবস্থা চালায় একল বিদ্যালয়।
আরও পড়ুন, বিজেপির “সাম্প্রদায়িক মানবতাবাদ”
শিক্ষক-শিক্ষিকারা নামমাত্র বেতনে কাজ করেন। বিভিন্ন এলাকায় গরিব ঘর থেকে আসা পড়ুয়াদের খাবার, শিক্ষাসামগ্রী, পোশাক দেওয়া হয়। স্কুলে নিয়মিতভাবে যোগব্যায়াম, আত্মরক্ষার বিবিধ পদ্ধতি শেখে পড়ুয়ারা। ছাত্রীদের আত্মরক্ষার বিশেষ তালিম দেওয়া হয়। এ রাজ্যে একল বিদ্যালয়ের সদর দফতর হরিশ মুখার্জি রোডে। দক্ষিণবঙ্গের এক অভিভাবকের কথায়, “সরকারি স্কুলে যে মিড ডে মিল দেওয়া হয়, একল স্কুলে তার চেয়ে অনেক ভাল খাবার দেয়। আমাদের নিয়ে বছরভর নানা ধরনের অনুষ্ঠান করে। আমরা গরিব, ছেলেমেয়েদের পড়ানোর সামর্থ্য নেই। সরকারি স্কুলে গেলেও খাতাপত্র কিনতে হয়। এখানে সবই ফ্রি।”
একল বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ থেকেই। নব্বইয়ের দশকে। কিন্তু এই রাজ্যের গেরুয়া শিবিরের হতশ্রী দশার জন্য দীর্ঘদিন প্রত্যাশিত সাফল্য মেলেনি৷ অন্য রাজ্যের একল বিদ্যালয়গুলি মূলত বনাঞ্চলে অবস্থিত। ছত্তিশগড়ে বছরের পর বছর বিজেপির সরকার গড়ার নেপথ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হিসাবে কাজ করেছে আদিবাসী এলাকার একল বিদ্যালয়গুলি। দণ্ডকারণ্যের মাওবাদী প্রভাবিত এলাকায় পাল্টা জনমত গড়তে গেরুয়া শিবিরের বড় ভরসা এই স্কুলগুলি। সূত্রের খবর, বাণিজ্যিক ভাবেও একল বিদ্যালয় লাভজনক। পর্যটকদের জন্য জঙ্গলের ভিতরে থাকা একল বিদ্যালয়গুলি ঘুরে দেখানোর ব্যবস্থাও রয়েছে। সেজন্য জনপ্রতি প্রায় আড়াই হাজার টাকা খরচ করতে হয়।
একল নিয়ে শাসক ও বিরোধীরা
রাজ্যে একল বিদ্যালয়ের বাড়বাড়ন্তে রীতিমতো অস্বস্তিতে তৃণমূল। এক তৃণমূলনেতার কথায়, ‘‘এই স্কুলগুলিতে হিন্দুত্বের পাঠই দেওয়া হয়। ত্রিপুরা, ঝাড়খণ্ড, ছত্তিসগড়ের মতো রাজ্যের ভোটে ওদের কার্যকলাপ বিজেপি’র বিপুল সুবিধা করে দিয়েছে।’’ শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘নন-ফর্মাল স্কুল চালালে সরকারের কিছু করার নেই। ওরা পর্ষদের সিলেবাস পড়ায় না। তবে কড়া নজর রাখছি। ছোট ছেলেমেয়েদের মাথায় বিদ্বেষের বীজ রোপণ করতে দেওয়া হবে না।’’ সিপিএম নেতা মহম্মদ সেলিমের কথায়, “তৃণমূলের মদতেই সর্বত্র বিভাজনের পাঠশালা খুলছে আরএসএস। ভয়ানক প্রবণতা।” প্রসঙ্গত, সম্প্রতি দক্ষিণ দিনাজপুরের ১০টি একল বিদ্যালয় বন্ধ করতে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল রাজ্য। আদালত তা বাতিল করে দিয়েছে।একল কর্তৃপক্ষ দাবি করছেন, সরকার শত চেষ্টাতেও স্কুল বন্ধ করতে পারবেন না। কারণ, প্রথমত তাঁরা এলাকাবাসীকে সঙ্গে নিয়ে স্কুল চালান। সব দলের লোকই সেখানে আছেন। দ্বিতীয়ত, শিক্ষা অধিকার আইন অনুযায়ী এভাবে স্কুল বন্ধ করা যায় না।
গেরুয়া শিবিরের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক অবশ্য মানতে নারাজ একল কর্তৃপক্ষ। এই রাজ্যে তাঁদের সদর দফতর হরিশ মুখার্জি রোডে। পশ্চিমবঙ্গের একল বিদ্যালয়ের কর্তা নির্মাল্য ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আমাদের যোগ নেই। সরকারের স্কুলগুলিতে যে বই পড়ানো হয়, আমরা সেগুলিই পড়াই। আসলে আমরা সরকারের উপর নির্ভর করি না বলে মন্ত্রী এমন কথা বলছেন।”