শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, সারা দেশের নজর এখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজরিত বিশ্বভারতীর দিকে। সেদিকে দৃষ্টি রয়েছে যুযুধান দুই রাজনৈতিক দলের। বোলপুরে বিজেপির কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ রোড শো করেছেন, পাল্টা মিছিল করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়। তার উপর বিশ্বভারতীর জমি কব্জা করা নিয়েও চলছে আর এক দফা বিতর্ক। এক্ষেত্রে নাম জড়িয়েছে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অর্মত্য সেনের। এ বিষয়ে মুখ খুলেছেন মুখ্যমন্ত্রীও। এছাড়া বিশ্বভারতীর আনাচে-কানাচে দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে। বিশ্বভারতীর উপাচার্য ড. বিদ্যুৎ চক্রবর্তী বিশ্বের নানা দেশে পড়িয়েছেন। তিনি মহাত্মা গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আদর্শে অনুপ্রাণিত। বিশ্বভারতীর সামগ্রিক হালচাল নিয়ে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা'র প্রতিনিধির সঙ্গে শান্তিনিকেতনের পূর্বপল্লীর বাসভবনে বসে একান্তে খোলামেলা কথা বললেন উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। আজ প্রকাশিত হল সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্যায়।
বিশ্বভারতীর জমি হরফ নিয়ে নানা বিতর্ক চলছে। প্রকৃত বিষয়টা কী?
বিশ্বভারতীর মোট জমি আছে ১১৩৮ একর। হিসেব করে আমরা দেখতে পেলাম ৭৭ একর জমি কব্জা হয়ে গিয়েছে। সমাজের গণ্যমান্য বক্তি তথা বিখ্যাত লোকেদের দখলেই রয়েছে এই জমি। তাঁদের নাম জনসমক্ষে নিয়ে এলে বড় বিতর্কের সৃষ্টি হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে আমাদের একটা নির্দেশ আসে বিশ্বভারতীর যে জমি কব্জা হয়ে গিয়েছে সেই জমি উদ্ধার করতে হবে। শুধু বিশ্বভারতী নয়, সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়কে এই ধরনের নির্দেশিকা দেয় কেন্দ্রীয় সরকার। তখন আমাদের মূল আলোচনা শুরু হয়। আমাদের কী কী জমি কব্জা হয়েছে? অডিটে দেখা যায় একটা অবজেকশন আসে। আমরা দেখতে পাই ৭৭ একর জমি কারা কারা দখল নিয়েছে।
অর্মত্য সেনের জমি নিয়ে বিতর্ক ক্রমশ বাড়ছে। তাঁর সম্পর্কে আপনার ব্যক্তিগত ধারণা.....
প্রথমেই শ্রদ্ধাজ্ঞাপণ করছি নোবেলজয়ী অর্মত্য সেনকে। উনি একজন জগদ্বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ। ওঁর লেখা থেকে আমরা সমৃদ্ধ হয়েছি। আমিও ওঁর লেখা থেকে বিশেষ ভাবে উপকৃত হয়েছি। অর্মত্য সেন অর্থনীতিবিদ হিসাবে, চিন্তাশীল হিসাবে উচ্চস্থানে আছেন। আমি লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সের ছাত্র। আমার সঙ্গে ওঁর অনেকবার দেখা হয়েছে। ওনার হয়তো মনে থাকবে না। অক্সফোর্ডে গিয়ে তাঁর বক্তব্য শুনেছি।
এত মিডিয়ায় হইচই শুরু হয়ে গেল!
বিশ্বভারতীর উপাচার্য হিসাবে আমার যে ধর্ম সেই ধর্মটা পালন করতে গিয়ে আমাকে অনেক অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। যে সিদ্ধান্তগুলো অনেক সময় জনসমক্ষে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। জমির ব্যাপার আসছে। অধ্যাপক সেনের জমি নিয়ে বিশ্বভারতী নিজে কিছু বলেনি। বিশ্বভারতীর তরফে কোনও মতামত যায়নি। অধ্যাপক সেনই সংবাদমাধ্যমে গিয়েছেন। যখন আমাদের মিডিয়ায় আক্রমণ করা হল তখন আমরা মিডিয়ায় গিয়েছি।
নোবেলজয়ীর বিশ্বভারতীর জমি নিয়ে আপনার কী বক্তব্য?
অর্মত্য সেনের বাবা জমির 'লিজ' হোল্ডার ছিলেন। ওঁর নামে হস্তান্তরিত হয়। ১২৫ ডেসিমেল জমি ওঁর প্রাপ্য। পরবর্তীকালে মাপজোক করে দেখা যায় ওঁর কাছে ১৩৮ ডেসিমেল জমি চলে গিয়েছে। ১৩ ডেসিমেল জমি বেশি অর্থাৎ প্রায় ৯ কাঠা। এই জমি কিন্তু ওঁর আয়ত্বে আছে। আমি যে প্রশ্নটা বার বার বলছি উপাচার্য হিসাবে দায়িত্ব নিয়ে বলছি। এটা তো প্রমাণ করা খুব সহজ। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অধীনে ভূমি রাজস্ব দফতর। ওই দফতরের সার্ভেয়ার দিয়ে মাপিয়ে নিক না। তাহলে সত্যিটা প্রকাশ পাবে। কে ঠিক বলছে, বিশ্বভারতী না অর্মত্য সেন। সেটাই আমি রাজ্য সরকারকে অনুরোধ করছি। আমার ওঁকে কালিমালিপ্ত করার উদ্দেশ্য নয়। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসাবে ধর্মটা পালন করছি। জমি বিশ্বভারতীকে ফিরিয়ে দেওয়া কাজের মধ্যে পড়ে। যদি মেপে দেখা যায় আমি ভুল বলছি তাহলে যে শাস্তি দেবে তা মাথা পেতে নেব। আর যদি বলি ঠিক বলছি, তাহলে? আমাদের দেশে আইনে সবাই সমান। উনি নোবেল প্রাইজ পেতে পারেন জমি বেশি নিলে বলবই।
কী ধরনের কারবার চলে 'লিজ' জমি নিয়ে?
হরফ হওয়া ৭৭ একর জমির মধ্যে ১২ জনের বিরুদ্ধে আদালেত মামলা চলছে। বিচারাধীন বলে এই নামগুলো বলতে পারব না। এঁরাও সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি। বিশ্বভারতীতে জমি কেনা যায় না। জমি ৯৯ বছরের 'লিজ' দেওয়া হয়। উত্তরাধিকারীকে 'লিজ' জমি হস্থান্তরিত করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রেও বিশ্বভারতীর অনুমতির প্রয়োজন রয়েছে। এরকম বহু 'লিজ' হোল্ডারকে পেয়েছি যেখানে প্রকৃত উত্তরাধিকারীরা কিন্তু জমি পায়নি। তাছাড়া বিশ্বভারতীকে অন্ধকারে রেখে অর্থের বিনিময়ে এই জমিগুলো হস্তান্তর হয়েছে। ওই নামগুলো পেয়েছি। প্রয়োজনে জনসমক্ষে আনব।
৭৭ একর জমি কত জনের দখলে আছে?
কিছু লোকের নাম বলতে পারব না। অন্তত ৫০ জন গণ্যমান্য বক্তি। আমি নামগুলো বললে লোকে ছি ছি করবে। পশ্চিমবঙ্গের তাঁরা কেউ সাধারণ মানুষ নয়। এমনও পেয়েছি 'লিজ' হোল্ডার এক মহিলা জমি বিক্রি করে দিয়েছে। বিশ্বভারতী বিষয়টা ধরে ফেলেছে। এঁরাই বড় বড় কথা বলছেন। যাঁরা রবীন্দ্র আবেগের কথা বলেন তাঁরা কিন্তু জমি হাঙড়ের অংশ বিশেষ।
এখানকার অধ্যাপকদের একটা অংশের বিরুদ্ধে ফাঁকিবাজির অভিযোগ ছিলই। তাঁদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন?
আগে সবাই গণদেবতায় আসতেন, ২ ঘণ্টা থাকতেন। একটা দোকান থেকে মাছ কিনতেন, ফিরতেন শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে। কিন্তু এভাবে তো চলতে পারে না। ক্যাম্পাসে থাকার প্রমাণ দিতে হবে। বোলপুর স্টেশনের তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে আমি হানা দিয়েছি। ওনারা ট্রেনে একই কামরায় ওঠেন। আমি স্টেশনে গিয়ে কয়েকজন অধ্যাপককে হাতে-নাতে ধরেছি। আমাকে দেখে কেউ কেউ লুকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে পালাতে চেষ্টা করেছে। আমার হাত থেকে পালাতে পারেনি। আমি গিয়ে ধরেছি। আমাকে তখন বলেছে সি-অফ করতে এসেছি। বুঝতে পেরেছি যে মিথ্যা কথা বলছে। এভাবে হানা দেওয়ায় অনেকটা কাজ হয়েছে। আমি হঠাৎ হঠাৎ ডিপার্টমেন্টে গিয়ে হাজির হয়ে যেতাম।
কর্মীরা আপনাকে ঘেরাও করেছিল?
কর্মীদের একটা দল ছিল। অক্টোবরে আমাকে তালাবন্ধ করে দিয়েছিল। আমার বাড়িতে ২০০ লোক ঘেরাও করে অপমান করেছিল। গালিগালাজও করেছে। আমি তো ভেবেছিলাম বিশ্বভারতী ছেড়ে চলে যাব। আমার তখন গান্ধীজির কথা মনে পড়ে গেল। আফ্রিকায় ডারবান থেকে জোহানেসবার্গ যাওয়ার সময় মাঝপথে ট্রেনের গার্ড ট্রেন থেকে তাঁকে ফেলে দিয়েছিল। গান্ধাজি কিন্তু দেশে ফিরে আসেননি। তখন সেখানে লড়াই করে টিকে গিয়েছিলেন। সেদিন আমার সেই অনুভব এসেছিল। একজনকে বদলি করায় আমাকে তালাবন্ধ করেছিল। পরের দিন সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ৮৭ জনকে শোকজ করেছি। তাঁদের মধ্যে ৮৪ জন বিনাশর্তে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন। তিনজন দাদাগিরি করল, ওই তিনজন আজও সাসপেন্ডেড। প্রয়োজনে চাকরি চলে যাবে। সেই স্টেপও আমি নেব।
এখানে আরও দুর্নীতির ঘটনা আছে?
এখানে প্রাক্তন উপাচার্য, প্রাক্তন রেজিষ্ট্রার, প্রাক্তন ফিনান্স অফিসারের চাকরি চলে গিয়েছে। এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সিদ্ধান্তকে তাঁরা 'ফোর্জ' করেছিল। এছাড়াও আমাদের তিন জন অধ্যাপক ও পাঁচজন কর্মচারীকে সাসপেন্ড করে রেখেছি। কারণ, ভাষাভবনে প্রতি মাসে মাইনে (৫০০০টাকা) গত ১৪ বছর ধরে ভুয়ো নামে বেরিয়ে যাচ্ছে। এবিষয়ে তদন্ত কমিটি গড়া হবে। সরকারি পয়সা একটা হলেও চুরি, পাঁচ হাজার টাকা হলেও চুরি। ফিনান্স অফিসার গাড়ি নিচ্ছে, টাকাও নিচ্ছে। এসবও বন্ধ করে দিয়েছি। ১২ ক্লাস পাশ ব্যক্তিকে বেআইনিভাবে চাকরি দেওয়া হয়েছে। তাতে কেউ জেলে গিয়েছেন। এখানে কেউ পেনশন নিতেন একইসঙ্গে মাইনেও নিতেন। এসবেরও তদন্ত চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি ক্ষণে ক্ষণে ঘুন ধরে গিয়েছে।
বিশ্বভারতী নিয়ে এত বিতর্ক, এত সমালোচনা কেন?
বিশ্বভারতী একসময় শোষনের জায়গা ছিল। কামাইয়ের জায়গা ছিল। সেটা হচ্ছে না বলে এত রাগ। শেষ রক্তবিন্দু হিসাবে বিশ্বভারতীকে রক্ষা করে যাব।
আপনার উদ্দেশ্য কী?
আমার ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য কিছু নেই। উপাচার্যের পর আর কিছু হওয়ার নেই। আমার কিছু পাওয়ার নেই। প্রধানমন্ত্রী আমাকে এখানে আমাকে পাঠিয়েছেন। আমার একটা মিশন বিশ্বভারতীকে বিশ্বভারতী করতে হবে। এই মিশনে আমি একা নই। আমার সঙ্গে বিশ্বভারতীর প্রত্যেকটা মানুষ আছে। বিশ্বভারতীর উপর দাঁড়িয়ে আছে বোলপুর। এছাড়া সামগ্রিক অর্থনীতি দাঁড়িয়েছে বিশ্বভারতীর উপর। সোনার হাঁসটাকে মেরে না ফেলে লালন-পালন করুন। সেক্ষেত্রে আমি কাউকে ছাড়ব না।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন