হালকা শীতের আমেজে উৎসবের মেজাজে আপামোর বাঙালি। ডিসেম্বর মানেই উৎসবের আমেজ। শীতের মরশুমে ২৩ জেলার ৭ হাজার শিল্পীকে নিয়ে জমে উঠেছে হস্তশিল্প মেলা। মেলার সবচেয়ে আকর্ষণীয় দ্রব্যাদির মধ্যে রয়েছে মাদুর, মসলিন, বেত, দড়ি, কাঠ, পোড়ামাটি, কাঁচের হরেক সামগ্রী। এমনিতেই বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। আর এই তিলোত্তমা শহর উত্সব মুখোর বাঙালিকে উৎসাহ দেওয়ার চিরকাল এক ধাপ এগিয়ে রয়েছে। বইমেলা থেকে খাদ্য মেলা। পর্যটন মেলা থেকে হস্তশিল্প মেলা প্রতিবছরই এই সবধরনের মেলা হয় কলকাতার বুকে। ২৫ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই হস্তশিল্প মেলা চলবে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
করোনা আর লকডাউনের জন্যে মাঝে কিছুটা ছন্দপতন হয়েছিল এই মেলার। এই বছর আবার পুরনো মেজাজে শুরু গিয়েছে মেলার। রাজ্যের প্রায় সবক’টি জেলার হস্তশিল্পীরা এই মেলায় অংশগ্রহণ করেছেন। বিভিন্ন হস্তশিল্পের পশরা নিয়ে সাজানো হয়েছে দোকান। রং-বেরংয়ের জিনিস নজর কাড়ছে দর্শকদের। ছোটবড় মিলিয়ে প্রায় সাত হাজার স্টল নিয়ে শুরু হয়েছে এই মেলা। ২৩টি জেলার বিভিন্ন শিল্পীরা এই মেলায় অংশগ্রহণ করেছেন। নিজেদের হাতে তৈরি পণ্য এখানে তাঁরা বিক্রি করবেন। দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ৫০টি প্যাভিলিয়ন তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটিতে রয়েছে প্রায় ৪০টি করে স্টল। এছাড়াও ইকো পার্কের গেট নম্বর ১-এ খোলা মাঠে আরও ৩০০০ হাজার স্টল রয়েছে। কোথাও বেতের বোনা ধামা-কুলো আবার কোথাও ঘর সাজানোর বাহারি জিনিস ক্রেতার চোখের সামনে নিমেষেই তৈরি করে দেন শিল্পীরা।
ইদানিং শহুরে শৌখিন ক্রেতার পছন্দ অনুযায়ী ভোলবদলও ঘটেছে শিল্প সামগ্রীতে। হস্তশিল্প মেলায় যাঁরা অংশ নেন, তাঁরা সবাই জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা শিল্পীরা। কেউ শোলার তৈরি বাহারি ফুল বানাচ্ছে কিংবা কেউ জঙ্গলমহলের টেরাকোটার কাজ করছে এই সব সামগ্রী শোভা বাড়াচ্ছে মেলার। রাজ্য সরকার পরিচালিত ইকোপার্কের এই হস্তশিল্প মেলা থেকে অংশগ্রহণকারী শিল্পীদের মধ্যে চলে বাছাইপর্ব। এরপর দিল্লির জাতীয় মেলায় শিল্পীরা বাংলার গৌরব শিল্পকলা তুলে ধরেন এবং জাতীয় স্তরের স্বীকৃতি অর্জন করেন বাংলার বহু শিল্পী। এই লক্ষ্যে নিয়ে এই মেলার সূচনা করে রাজ্য স্তরের হস্তশিল্প মেলা। রাজ্য স্তরের এই মেলা শেষে বাছাই করা শিল্পীদের পরবর্তী গন্তব্য হবে দিল্লির জাতীয় হস্তশিল্প মেলা।

মুর্শিদাবাদের সিল্ক, বর্ধমানের ডোকরা, নদিয়ার মাটির পুতুল, মেদিনীপুরের পটচিত্র, পুরুলিয়ার ছৌ শিল্প হস্তশিল্প মেলায় পসরা একবার চাক্ষুষ করতে মেলায় ভিড় করছেন ক্রেতারা। দুপুর গড়াতেই ভিড় উপচে পড়েছে মেলায়। তবে শিল্পীরা জানাচ্ছেন,’শনি এবং রবিবার যা বিক্রিবাট্টা হয়। সপ্তাহের বাকী দিনগুলিতে তেমন বিক্রিবাট্টা হয়না। অধিকাংশ মানুষ আসেন ঘুরে দেখেন দাম করেন চলে যান’। পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে মেলায় এসেছেন ফিরোজা বিবি। স্বামীর মৃত্যুর পর ছোট মেয়েকে নিয়ে সংসারের হাল ধরতে হাতের কাজ শেখা। তিনি বলেন, ‘গ্রামের প্রায় ২২ টি পরিবার এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। এই নিয়ে গত ২ বছর হল তিনি এই মেলায় স্টল দিচ্ছেন’।
বিক্রিবাট্টা প্রশ্নে তার উত্তর, ‘সেভাবে বিক্রিবাট্টা হচ্ছে না। তবে এখনও যে বেশ কয়েকটা দিন বাকী তাই এখনই আশা ছাড়ছেন না তিনি। রাজ্য সরকারের তরফে এক হাজার টাকা ভাতাও মেলেই। তবে সরকারের কাছে তাঁর অনুরোধ সরকার যদি বাংলার এই প্রাচীন হস্তশিল্প এবং শিল্পীদের নিয়ে আরও কিছু চিন্তাভাবনা করেন তবে অচিরেই বিশ্বদরবারে উঠে আসবে বাংলার হস্তশিল্প’। এবারেই মেলায় ডিজিটাল লেনদেনকে বাড়াতে অনলাইন পেমেন্ট, ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে কেনার সুযোগ পাচ্ছেন ক্রেতারা। তবে অনেক শিল্পীই ডিজিটাল লেনদেনের সঙ্গে সেভাবে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পা পারার কারণে ক্রেতাদের ফিরিয়েও দিচ্ছেন এমন অভিযোগও সামনে এসেছে। মেলার এককোণে কিছু একটা কিনে নিয়ে যাওয়ার আর্জি জানাচ্ছেন শিল্পী রুকসানা। বিগত দু-বছরে কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে অর্থনীতি। আর এমন টালমাটাল পরিস্থিতিতে ঘুরে দাঁড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প। সরকারের তরফে এভাবে মেলার আয়োজনে খুশি রুকসানা।
তবে তিনি বলেন, ‘বাংলার হস্তশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখাটাই এখন সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ। অধিকাংশ শিল্পীরা ভাল কাজের সন্ধানে বাইরের রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছেন। এই শিল্পে সময় আর ধৈর্য দুটোই লাগে। এখনকার ছেলেমেয়েরা আর এই শিল্পের সঙ্গে নিজেদের সেভাবে যুক্ত করতে চান না’। এক্ষেত্রে সরকারকে আরও বেশি করে তাদের উৎসাহিত করার কথা উঠে এল তার গলাতে। মেলায় হাজির অনেক শিল্পী আবার এই অভিযোগ এনেছেন কার্ড না থাকায় তারা মেলার ভিতরে বসার সুযোগ পাননি। ফলে তারা বাইরে বসতে বাধ্য হচ্ছেন। বাইরে বসায় সেভাবে কেনা বেচা হচ্ছে না বলেও দাবি তাদের।
পাশাপাশি মেলায় আসা অনেক শিল্পী দাবি করেছেন মেলায় যদি সেভাবে বিক্রি বাট্টা না হয় তবে মালপত্র আনা ফেরত নিয়ে যাওয়ার খরচটাও অনেকসময় তুলতে কালঘাম ছুটে যায়। তবে কলকাতার এই হস্তশিল্প মেলার মঞ্চ থেকেই শিল্পীরা তাদের গৌরব শিল্পকলা তুলে ধরেন এবং জাতীয় স্তরের স্বীকৃতি অর্জন করেন অনেক শিল্পী সেই টানেই দূরদূরান্তের জেলা থেকে ছুটে আসেন হস্তশিল্পীরা। বেশিরভাগেরই সেভাবে বিক্রি নেই। যতটুকু বিক্রি হচ্ছে তাতেই খুশি তাঁরা। দিন তো কেটে যাচ্ছে। তাতেই খুশি শিল্পীরা।