এ যেন প্রকৃতির সম্পদ লুঠের প্রতিযোগিতা। এবং রাজ্যে অসংখ্য নদী থাকলেও এক্ষেত্রে এগিয়ে বীরভূম। বালিই এখন চোখের বালি বীরভূম প্রশাসনের। মোটা দানার বালি হওয়ার দরুন অজয় নদের বালির চাহিদা বহুকাল ধরেই। সবাই এও জানেন যে নির্মাণ কাজে বালি লাগে, কিন্তু বালি নিয়ে এমন ব্যবসা অতীতে কেউ দেখেন নি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ নিয়ে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন, এদিকে তাঁরই দলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মন্ডল বলছেন এসব "বিরোধীরা করছে", তাঁর দলের কেউ বালির অবৈধ ব্যবসায় লিপ্ত নন।
কিন্তু বালি হঠাৎ সোনা হয়ে উঠলো কী করে?
প্রশাসনিক মহলের হিসেব, বছর দশেক আগে নদীর বাঁধ মেরামতির কারণে বালি তোলায় নিষেধাজ্ঞা জারি করার পর কৃত্রিমভাবে বালির চাহিদা বাড়তে থাকে। অন্যদিকে প্রোমোটাররা তাঁদের বরাত দিতে মোটা অঙ্কের টাকা দিতে থাকেন বালি ব্যবসায়ীদের। সরকারী হিসেবে দশ বছর আগে নদীর বালি নির্দিষ্ট কিছু ঘাট থেকে উঠতো, যা বাবদ সরকার অল্পস্বল্প রাজস্ব নিত। এখন অবস্থা এমন, যে রাতভর বালি তুলতে আধুনিক মেশিন বসেছে নদের বুকে।
আরও পড়ুন: সান্দাকফু-ফালুট ট্রেকিং রুটে প্রায় দু’হাজার কিলো খালি মদের বোতল
শুধু অজয় নয়, ময়ুরাক্ষী, ব্রাহ্মনী, দ্বারকা, এবং যাবতীয় রোগা লিকলিকে মজা নদী-খাল, সবেতেই নজর বালি ব্যবসায়ীদের। কোথাও নদীর বাঁধ কেটে বালি তোলা ট্র্যাক্টরের রাস্তা বানিয়ে পথ না থাকায় ফসল ভরা ক্ষেতের ওপর দিয়ে সে গাড়ি চলার পথ বানানো, মরিয়া বালি মাফিয়া। প্রতিবাদ করায় সাঁইথিয়া লাগোয়া গ্রামে চাষিদের ওপর বোমা গুলি চালায় বালি মাফিয়ার সদস্যরা। বর্ষায় নদীতে জল জমবে বলে কয়েক'শ গাড়ি বালি তুলে কৃষকের জমির ওপর মজুত করে, চাষ জমির সর্বনাশ হয়।
রাজ্য সরকার বালি উত্তোলনে বিধিনিষেধ কায়েম করলেও তা প্রয়োগ করতে গিয়ে শাসকদলের নেতা কর্মীদের হাতেই আক্রান্ত হচ্ছেন সরকারী কর্মীরা বলে অভিযোগ। নানুরের বিএলআরও (ব্লক ল্যান্ড রেকর্ডস অফিসার) বালি পাচার ধরতে গিয়ে নিজের অফিসে আক্রান্ত হয়ে পুলিশে অভিযোগ জানিয়েছেন। এর আগে সেচ দপ্তর যখন বালি পাচার রোখার দায়িত্বে ছিল, সেই দপ্তরের আধিকারিকরাও আক্রমণের মুখে পড়েছেন।
বীরভূমে এখন বালি তোলার বৈধ ঘাট ১৭১ টি, কিন্তু বাস্তবে হাজারেরও বেশী। চলতি বছরে সরকারের লক্ষ্য, বীরভূমে বালির ঘাট থেকে ১২১ কোটি টাকার রাজস্ব তোলা, কিন্তু ১৭১ টি বালির ঘাট থেকে ১২১ কোটি টাকা রাজস্ব উঠবে না এটা জানা সত্ত্বেও প্রকারান্তরে অবৈধ ঘাটগুলি নামমাত্র রাজস্ব দিয়ে বৈধতার স্বীকৃতি পেয়ে যাচ্ছে।
ভীমগড় থেকে শুরু করে দুবরাজপুর, ইলামবাজার, বোলপুর, নানুর - অজয়ের বুকে লুঠের এক মরিয়া প্রতিযোগিতা চলছে। সমস্ত শহরে এই শীতের রাত্রেও দেখা যাচ্ছে ১১ টার পর থেকে বালি বোঝাই ট্রাক-ট্র্যাক্টর সারি দিয়ে চলেছে। পুলিশ বা প্রশাসন কিছুই জানে না এমনটা নয়। মাঝে মাঝে কয়েকটা গাড়ি আটকে আবার কোনও কারণে ছেড়েও দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন: দুর্নীতির দহে পড়ে বদলে যাচ্ছে কাঁসাই শিলাবতী নদীরা
কিছুদিন আগে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের গবেষকদের একটি দল এই লাগামহীন বালি লুটের পরে বন্যা এলে যে ভয়াবহ রূপ নেবে সে বিষয়ে সতর্কবার্তা জারি করেছেন। তাঁদের মতে, স্রোতের স্বাভাবিক পথ ব্যাহত হচ্ছে। অসংখ্য চোরাবালির মারণফাঁদ নদীর বুকে যেমন সৃষ্টি হচ্ছে, তেমন বিপজ্জনক হয়ে উঠছে নদীর স্বাভাবিক প্রকৃতি। কে শোনে কার কথা?
বর্ধমান বীরভূমের মাঝে অজয় নদের বুকে 'বালি শিল্প' দেখতে গেলেই আসে বাধা, দেখা যাবে না। ছবি তোলাও নিষেধ। রবিবার দেখা গেল, নদীর বুকে শাসকদলের পতাকা গুঁজে বালি তোলা চলছে। পতাকার পাশে দাঁড়িয়ে পোজ দিচ্ছেন নেতারা। বলেই দিচ্ছেন, "ধুত, বৈধ-অবৈধ আবার কী? আমাদের সরকার, আমাদের রাজ্য, আমাদের নদী, আমাদের বালি, কাকে কৈফিয়ত দেব? বেশ করছি আমরা।"
ইতিমধ্যে চোরাবালির ফাঁদটা বড় হয়ে চলেছে সর্বত্র।