সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের গৃহশিক্ষকতা বন্ধ না হলে স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন জানাবেন রাজ্যের গৃহশিক্ষকেরা। তাঁদের এমন কথা শুনে স্কুলশিক্ষকদের পাল্টা কটাক্ষ, গৃহশিক্ষকদের কাউন্সেলিং-এর ব্যবস্থা করুক রাজ্য সরকার।
শিক্ষার অধিকার আইনের সেকশন ২৮ অনুসারে, সরকারি বা সরকার অনুমোদিত স্কুলে কর্মরত কোনও শিক্ষক গৃহশিক্ষকতা করতে পারেন না। এই মর্মে ২০১৮ সালে নির্দেশিকা জারি করেছিল রাজ্য সরকার। এখন রাজ্যের প্রতিটি সরকারি বা সরকার অনুমোদিত স্কুলের শিক্ষককে মুচলেকা দিয়ে জানাতে হয়, তাঁরা প্রাইভেট টিউশন দেবেন না। কিন্তু শিক্ষামহলের একাংশের দাবি, এসব নিছকই বজ্র আঁটুনি, বাস্তবে ফস্কা গেরোর ফাঁক দিয়ে প্রতিটি জেলায় রমরমিয়ে চলছে সরকারি স্কুলশিক্ষকদের গৃহশিক্ষকতার ব্যবসা।
আরও পড়ুন, ‘জয় শ্রীরাম’ না বলায় বেদম মার, অভিযোগ এবার ক্যানিং লোকালে!
এতে সবচেয়ে আতান্তরে পড়েছেন রাজ্যের কয়েক লক্ষ প্রাইভেট টিউটর। তাঁদের সংগঠন পশ্চিমবঙ্গ গৃহশিক্ষক কল্যাণ সমিতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, অবিলম্বে রাজ্যের প্রতিটি জেলায় স্কুলশিক্ষকদের প্রাইভেটে পড়ানো বন্ধ করার দাবিতে মুখ্যমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর দ্বারস্থ হবেন তাঁরা। পাশাপাশি জেলায় জেলায় স্কুলশিক্ষকদের প্রাইভেট টিউশনের ব্যাচে গিয়ে 'গান্ধীগিরির' মাধ্যমে প্রতিবাদ জানানো হবে। সংগঠনের নেতারা জানিয়েছেন, যদি এসবেও কাজ না হয়, তাহলে সরকারের কাছে স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন জানানো ছাড়া উপায় থাকবে না।
প্রাইভেট টিউটরদের সংগঠনের রাজ্যের যুগ্ম-সম্পাদক অমিতাভ কর বলেন, "আইন আইনের মতোই রয়েছে। তার কোনও বাস্তব প্রয়োগ নেই। প্রতিটি জেলায় অসংখ্য স্কুলশিক্ষক প্রশাসনের চোখের সামনে টোল খুলে প্রাইভেট টিউশন দিচ্ছেন। আমাদের পেশায় অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করছেন ওই শিক্ষকেরা। আমরা আগেও দোষী স্কুলশিক্ষকদের তালিকা রাজ্য সরকারের হাতে তুলে দিয়েছি। আবারও জেলাভিত্তিক তালিকা করে সরকারকে পাঠানো হবে। শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে আমাদের সমস্যার কথা জানাব। মুখ্যমন্ত্রী গ্রিভান্স সেলে নির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ-সহ অভিযোগ জানাব। কিন্তু এরপরও যদি কাজ না হয় তাহলে সরকারের কাছে স্বেচ্ছামৃত্যুর অনুমতি চাইব।"
আরও পড়ুন, ছত্রে ছত্রে মিল! কৃত্তিকার আত্মহত্যায় কাঠগড়ায় এই ওয়েব সিরিজ
গৃহশিক্ষক সংগঠনের অভিযোগ, প্রতি মাসে রাজ্যে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা হাতবদল হয় প্রাইভেট টিউশনের মাধ্যমে। অমিতাভবাবুর কথায়, "এই অর্থের সিংহভাগই সরকারি স্কুলশিক্ষকদের পকেটে যায়। এর কোনও হিসাব তাঁরা সরকারকে দেন না। কোনও আয়করও দেন না। এই বিপুল অর্থের পুরোটাই কালো টাকা। সবচেয়ে বড় কথা, তাঁরা সরকারের আইনের বিরুদ্ধে যাচ্ছেন। সরকারের উচিত দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা চাই সরকার অবিলম্বে গৃহশিক্ষক পর্ষদ গঠন করুক। সেই পর্ষদ প্রয়োজনবোধে আমাদের ট্রেনিং এবং তার ভিত্তিতে সার্টিফিকেট দিক। নিয়ম করা হোক, পর্ষদের অনুমোদন ছাড়া গৃহশিক্ষকতা করা যাবে না। আমাদের উপার্জন ট্যাক্সের আওতায় আনা হোক। আমরাও নিয়মিতভাবে সরকারের কোষাগারে কর দিতে চাই। কিন্তু নিশ্চিত করা হোক যে, কোনও স্কুলশিক্ষক যেন প্রাইভেটে না পড়ান।"
গৃহশিক্ষকদের এমন দাবিকে অবশ্য কটাক্ষ করছেন স্কুলশিক্ষকদের একাংশ। মাধ্যমিক শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী সমিতির নেতা বিশ্বজিৎ মিত্র বলেন, "এমন কথা যাঁরা বলছেন, সরকার তাঁদের কাউন্সেলিং-এর ব্যবস্থা করুক।" তাঁর যুক্তি, রাজ্যের স্কুলশিক্ষকদের ৪৭-৫৪ শতাংশই মহিলা। "পারিবারিক কারণেই" তাঁদের অধিকাংশ স্কুলের পর টিউশন পড়াতে পারেন না। বাকিদের অতি সামান্য অংশ প্রাইভেট পড়ান।
আরও পড়ুন, কেমন আছে পড়ুয়ার মন? জানতে চায় শিশু সুরক্ষা কমিশন
ওই শিক্ষক নেতার কথায়, "যাঁরা পয়সার বিনিময়ে প্রাইভেট পড়াচ্ছেন, সরকার তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিক। কিন্তু অনেক স্কুলশিক্ষক বিনামূল্যে ছুটির পর ছাত্রছাত্রীদের পড়ান। সেই সুযোগ যেন কেড়ে নেওয়া না হয়। তাছাড়া, রাজ্যের উচ্চমাধ্যমিক স্কুলগুলির অধিকাংশেই শিক্ষক সংকট। পার্ট-টাইম শিক্ষক দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে। ওই শিক্ষকেরা ২,৫০০-৩,০০০ টাকা মাইনে পান। তাঁদের পড়ানোর অধিকার কেন কেড়ে নেওয়া হবে?"
তৃণমূলের শিক্ষক সংগঠনের নেতা অশোক রুদ্র অবশ্য জানান, তাঁরা কখনই স্কুলশিক্ষকদের প্রাইভেট টিউশনের পক্ষে নন। সরকার কখনই এই ধরনের "টিউশন-বাণিজ্য" অনুমোদন করে না।
বিজেপি নেতা সায়ন্তন বসুর কটাক্ষ, "কয়েকদিন আগে ডাক্তারদের আন্দোলনে রাজ্য কেঁপে উঠল। স্কুলশিক্ষকেরাও দফায় দফায় আন্দোলন করছেন। এখন গৃহশিক্ষকেরাও স্বেচ্ছামৃত্যুর হুমকি দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে বোঝা যাচ্ছে, রাজ্যে কোনও সরকার নেই। তৃণমূল যতদিন ক্ষমতায় থাকবে, শিক্ষা সহ প্রতিটি পরিসরে সঙ্কট আরও তীব্র হবে।"