আতঙ্কের অ্যাডেনোভাইরাস! বাংলা জুড়ে জারি মৃত্যুমিছিল। শয্যা-সংকটে নাজেহাল অবস্থা রাজ্যের প্রায় সব হাসপাতাল। জরুরি ভিত্তিতে চলছে রাজ্যসরকারের তরফে অ্যাডিনর সঙ্গে মোকাবিলা। কিন্তু এর মাঝেও একটা রিপোর্ট বাড়িয়েছে উদ্বেগ। অ্যাডিনো ভাইরাস প্রকোপে শীর্ষে বাংলা।
সম্প্রতি আইসিএমআর-নাইসেডের যৌথ সমীক্ষায় উঠে এসেছে এমনই তথ্য। শিশু মৃত্যুর পিছনে কোন ভাইরাস তা জানতে সারা দেশ জুড়ে আইসিএমআর-এর ভাইরাল রিসার্চ ডায়গনেস্টিক ল্যাবরেটরিগুলিতে একটি সমীক্ষা করা হয়। সেখানেই অ্যাডিনো সংক্রমণে শীর্ষে রয়েছে বাংলা। যদিও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সোমবার বলেছিলেন যে অ্যাডেনোভাইরাসের কারণে এখনও পর্যন্ত ১৯ জন প্রাণ হারিয়েছে। যার মধ্যে ছয়টি শিশুও রয়েছে, পাশপাশি তিনি অ্যাডিনো মোকাবিলায় লড়াই করার জন্য আবার মাস্ক পরার আহ্বান জানান।
কিন্তু বাস্তব চিত্র একেবারেই আলাদা। কলকাতার প্রথম সারির শিশু হাসপাতালে রোজই অ্যাডিনোর দাপটে শিশুমৃত্যু অব্যাহত। বিসিরায় শিশু হাসপাতালের মন খারাপ করা ছবি সংবাদ মাধ্যমের দৌলতে আজ সারা দেশের সামনে এসেছে। কিন্তু কেন বাংলা জুড়েই অ্যাডিনো ভাইরাস তাণ্ডব দেখাচ্ছে?
প্রখ্যাত শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ইন্দ্রনীল চৌধুরি বলেন, ‘অ্যাডিনো যেভাবে বাংলায় তাণ্ডব দেখাচ্ছে, তার ধারে-কাছে নেই অন্য রাজ্য। জানুয়ারি থেকে ৯ মার্চ পর্যন্ত নাইসেডের সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে বাংলাতে অ্যাডিনো ভাইরাসের পজিটিভিটি রেট ৩৮ শতাংশ। এরপর রয়েছে তামিলনাড়ু সেখানে এই ভাইরাসের পজিটিভিটি রেট ১৯ শতাংশ। কেরলে ১৩ শতাংশ, দিল্লিতে ১১ শতাংশ এবং মহারাষ্ট্রে এই হার মাত্র ৫ শতাংশ। বাংলায় অ্যাডিনোভাইরাসের এই দাপটের পিছনে মূলত ভাইরাসের চরিত্র বদলকেই দায়ি করেছেন তিনি’।
তাঁর কথায়, 'অ্যাডেনোভাইরাসের মোট ৭৭ টি সেরোটাইপ রয়েছে। এর মধ্যে ৩, ৪এবং ৭ টাইপ খুবই সংক্রামক এবং এর ফলে শিশুদের শ্বাসনালীর সংক্রমণের মত উপসর্গও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পাশাপাশি তিনি বলেন, কোভিড এবং লকডাউনের কারণে বেশিরভাগ শিশু বাইরের জগতের সঙ্গে সংস্পর্শে আসেনি টানা ২ বছর ফলে শিশুদের মধ্যে রোগপ্রতিরোধক্ষমতা বেশ কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে অ্যাডিনো ভাইরাসের আক্রান্ত শিশুদের দেহে বেশি মিলছে ৩, ৭ স্ট্রেন। অনেক সময় এই দুইয়ের সংমিশ্রণও দেখা যাচ্ছে ফলে অনেক শিশুকেই আইসিইউতে ভর্তি করতে হচ্ছে এবং মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে'।
শিশু বিশেষজ্ঞদের কথায়, ‘কখন কোন ভাইরাস মিউটেশনের মাধ্যমে প্রাণঘাতী হয়ে উঠবে তা বলা মুসকিল, কিন্তু আমাদের ভাইরাসের বিরুদ্ধে সব সময় লড়াই চালিয়ে যাওয়ার পরিকাঠামো তৈরি রাখতে হবে। হঠাৎ করে কোন কিছু ম্যানেজ করে পরিস্থিতিকে সামাল দেওয়া কার্যত অসম্ভব। কারণ বর্তমানে শিশুরা অ্যাডিনোর প্রভাবে যেভাবে কাহিল হয়ে পড়ছে তাতে অনেকেই ভেন্টিলেশনে রাখতে হচ্ছে, বিশেষ কয়েকটি হাসপাতালের কথা বাদ দিলে সেখানে দক্ষ চিকিৎসক, নার্সের অভাব রয়েছে বলেও মেনে নিয়েছেন তারা। হাইব্রিড ভেরিয়েন্টর ক্ষেত্রে আরও কী কী বদল আসছে তার জন্য রীতিমত পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাচ্ছে নাইসেড। যদিও তা কিছুটা সময় সাপেক্ষ বলেই মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
অ্যাডিনো সংক্রমণের ক্ষেত্রে কোথাও সনাক্তকরণের ক্ষেত্রে দেরি হয়ে যাচ্ছে না? সেই প্রশ্নের উত্তরে চিকিৎসক সৌম্যজিত গুহ বলেন, বেসরকারি ক্ষেত্রে অ্যাডিনো ভাইরাস টেস্টিংয়ের খরচ অনেকটাই বেশি। "বর্তমানে, এই পরীক্ষার খরচ ৫ থেকে থেকে ১৫ হাজার টাকার মধ্যে। অ্যাডেনোভাইরাসের জন্য কোনও দ্রুত অ্যান্টিজেন পরীক্ষার ব্যবস্থাও নেই। যেহেতু দ্রুত পরীক্ষা করটা অনেক সময় সম্ভব হয়ে উঠছে না , সেক্ষেত্রে আইসোলেশনের ক্ষেত্রেও সমস্যা হচ্ছে, অনেক শিশু হাসপাতালে নিজেই সংক্রামিত হচ্ছে।
এদিকে শিশু মৃত্যুর ক্রমবর্ধমান সংখ্যার মধ্যে, রাজ্যের স্বাস্থ্য বিভাগ তার সমস্ত কর্মীদের ছুটিও বাতিল করেছে। রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের এক সিনিয়ার আধিকারিক সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে এই তথ্য জানিয়েছেন। পাশাপাশি রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জারি করা এক বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলেছে যে, "রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে সকলকে তাদের কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত থাকতে হবে। ফিভার ক্লিনিকগুলি ‘24X7’ ভিত্তিতে চালু রাখতে হবে।"
তবে, সরকারি শিশু মৃত্যুর যে পরিসংখ্যান সরকারের তরফে সামনে আনা হয়েছে তা কার্যত উড়িয়ে দিয়েছেন চিকিৎসকদেরই একাংশ। আইএএনএস-এর রিপোর্ট অনুসারে, মাত্র ১১ দিনে ৪৮টি শিশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। অ্যাসোসিয়েশন অফ হেলথ সার্ভিস ডক্টর্সের সাধারণ সম্পাদক ডাঃ মানস গুমটা মানস অভিযোগ করেছেন সরকার ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে মৃত্যুর সংখ্যা "আন্ডার রিপোর্ট" করেছে। তিনি বলেন, "সব শিশুই হাসপাতালে শয্যা পাচ্ছে না। তাদের জন্য সিসিইউ পাওয়া যাচ্ছে না, সামগ্রিক পরিস্থিতি এখন গুরুতর হয়ে উঠেছে।" তিনি আরও দাবি করেন, আমাদের কাছে এখন (সরকারের তথ্য নয়) মৃত্যুর যে রিপোর্ট এসেছে, ইতিমধ্যে ১০০-এর বেশি শিশু মারা গিয়েছে এই ভাইরাসের আক্রমণে। এর মানে পরিস্থিতি রীতিমত চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে" ।
সরকারের নিন্দা করে, ডাঃ গুমটা আরও বলেন, ‘অ্যাডেনোভাইরাসের বিস্তার মোকাবেলায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার যে প্রস্তুতি নিয়েছে তা অপর্যাপ্ত। কোভিড থেকেও এই সরকার কোন শিক্ষা নেয়নি। রাজ্য জুড়ে হাহাকার পরিস্থিতি। পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশন নেই, দক্ষ চিকিৎসক, নার্সের সংকট পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। পাশাপাশি একই বেডে তিন-চার শিশু ভর্তি থাকাটাকেও উদ্বেগের বলেন বর্ণনা করেছেন তিনি’।
তিনি আরও বলেন, কোভিডের পরে অ্যাডেনোভাইরাস, অ্যাডিনো ভাইরাস আমাদের কাছে নতুন কিছু নয়। তবে এর চরিত্র বদলের জেরেই এটি আরও সংক্রামক হয়ে উঠেছে। করোনার সময় আমরা যে হাহাকারের চিত্র দেখেছি আবারও তারই পুনরাবৃত্তি ঘটছে। কত শিশু সংক্রামিত হচ্ছে, কত শিশুর মৃত্যু হচ্ছে সেই তথ্য সকলের সামনে অবিলম্বে সরকারের তুলে ধরা উচিৎ।
পাশাপাশি তিনি বলেন, এটা সকলেই জানেন, অ্যাডিনো ভাইরাসকে সরকার ডেকে আনেন নি, তাহলে পরিসংখ্যান লুকানোর দরকারটা কী? তাহলে কী ধরেই নিতে হবে রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেআব্রু ছবিটাকে পরিসংখ্যান লুকানোর মাধ্যমে আড়াল করা হচ্ছে?’।
অ্যাডেনোভাইরাস সংক্রমণ
ইউএস ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ মেডিসিনের দেওয়া তথ্য অনুসারে, যেসব শিশু সম্পুর্ণ সুস্থ, তাদের ক্ষেত্রেও অ্যাডেনোভাইরাস একটি "গুরুতর, বিপদ ডেকে" আনতে পারে। অ্যাডেনোভাইরাস মূলত স্পর্শ বা কাশি-সর্দি, হাঁচির মাধ্যমে একজন থেকে অন্যজনের দেশে প্রবেশ করে। এটি একটি অত্যন্ত সংক্রামক ভাইরাস।
কিছু ক্ষেত্রে অ্যাডিনোভাইরাস মলের মাধ্যমেও ছড়াতে পারে। শিশুর ডায়াপার পরিবর্তন করার সময় সাবধান থাকা দরকার। পাশাপাশি অ্যাডেনোভাইরাস জলের মাধ্যমেও ছড়াতে পারে, যেমন সুইমিং পুল।
অ্যাডেনোভাইরাস উপসর্গ
CDC-এর মতে, অ্যাডেনোভাইরাসের সংক্রমণের ফলে হালকা থেকে গুরুতর অসুস্থতা দেখা দিতে পারে। যাদের মধ্যে প্রতিরোধ ক্ষমতা কম বা যে সকল শিশু জন্ম থেকে শ্বাসযন্ত্রের বা কার্ডিয়াক রোগে আক্রান্ত তাদের ক্ষেত্রে অ্যাডেনোভাইরাস গুরুতর বিপদ ডেকে আনতে পারে। অন্যান্য উপসর্গগুলির মধ্যে রয়েছে, সাধারণ সর্দি বা ফ্লুর মতো উপসর্গ, জ্বর, গলা ব্যথা, ব্রঙ্কাইটিস, কনজাংটিভাইটিস, পেটে ব্যাথা,ডায়রিয়া, বমি, বমি বমি ভাব।
অ্যাডেনোভাইরাস প্রতিরোধ
অ্যাডেনোভাইরাস আটকাতে ডাঃ মানস গুমটা পরামর্শ দিয়েছেন যে কোভিড বিধি মেনে চলা অর্থাৎ মাস্ক পরা, ভিড় এড়িয়ে চলা, বাইরে থেকে এসে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার ব্যবহার করা, এগুলি ফের মানা শুরু করতে হবে অবিলম্বেই। তিনি বলেন "কোভিডের সময় আমরা যে সতর্কতা অবলম্বন করেছিলাম, যেমন ফেস মাস্ক পরা, নিয়মিত সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, ভিড়ের এড়িয়ে চলা ইত্যাদি বিষয়গুলি, অ্যাডেনোভাইরাস প্রতিরোধের জন্যও সমান ভাবে কার্যকর”।