প্রায় বছর দুয়েক হতে চলল স্কুলের গেটে তালা ঝুলছে। অনলাইন পড়াশুনার গেরোয় গৃহবন্দি শিশুদের বিপন্ন শৈশব। কবে খুলবে স্কুল সে প্রশ্নই এখন সকলের মনেই ঘুরপাক খাচ্ছে। ইতিমধ্যেই স্কুল খোলার দাবি জোরালো হয়েছে। সরকারের তরফেও বলা হয়েছে, স্কুল খুলতে সরকার সাবধানী পদক্ষেপে এগোতে চাইছে। ঘরবন্দী শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যও অনেকাংশেই ব্যাহত হচ্ছে তা মানছেন শিশুমনোরোগ বিশেষজ্ঞরা।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলবে কবে, পড়ুয়া এবং অভিভাবকদের এখন সেটাই প্রশ্ন। তবে অধিকাংশ অভিভাবকই জানতে চাইছেন, মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকের ক্লাস শুরু হবে কবে? কিন্তু তার বাইরেও শহর জেলাগুলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে একাধিক প্রিস্কুল। কী অবস্থা তাদের? সেগুলির কর্ণধারেরা জানাচ্ছেন, "গত কয়েক মাসে সব চেয়ে খারাপ অবস্থা তাঁদেরই। তাঁদের আশঙ্কা, স্কুল গুলি না খুলতে পারে এবার সেগুলি টিকিয়ে রাখাই দায় হয়ে যাবে"!
শহরের একটি নামী প্রি-স্কুল চেনের প্রিন্সিপ্যাল সুশান্ত পাল জানাচ্ছেন, "তাঁর মারিয়া মন্টেশ্বরী চিলড্রেন’স হোম প্রি স্কুলে প্রায় সব মিলিয়ে পড়ুয়ার সংখ্যা শ’খানেক । গত বছর মার্চের শেষে যখন লকডাউন শুরু হল, সেই সময়টাই আমাদের স্কুলে ভর্তির মরসুম। লকডাউনের কারণে অনেকেই ভর্তি হয়নি। এখন কমতে কমতে যে ৩০-৩৫ জন পড়ুয়া রয়েছে, তারা আগামী শিক্ষাবর্ষে হাইস্কুলে ভর্তি হয়ে গেলে আর কি পড়ুয়া আসবে? তবে আমাদের অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা আছে। তাও করোনাকালে স্কুল চালানোই দায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে"।
এই মুহূর্তে নতুন করে যে পড়ুয়া ভর্তি হবে সেই আশাও করছেন না অপর একটি প্রিস্কুলের প্রিন্সিপ্যাল সত্যেন্দ্র সাহু। তাঁর কথায়, “অবসরের পর প্রিস্কুল খুলেছি। স্কুলের বয়স মাত্র তিন বছর। তার মধ্যে দু' বছর লকডাউন করেই কেটে গেল। অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা থাকলেও অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা সেই সুবিধা নিতে না পেরে তাদের সন্তানদের আপাতত ছাড়িয়ে নিয়ে গেছেন। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে অনেক পরিবারই মাসিক বেতন দিতে পারছেন না। সব মিলিয়ে প্রবল উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে। ব্যাঙ্ক লোন নিয়ে স্কুল করেছি। আমার আরও দুটি ব্রাঞ্চ রয়েছে। স্কুল না খোলা হলে কতদিন আর এভাবে চলবে”। সেই সঙ্গে তিনি বলেন, “ইতিমধ্যেই শহরের বেশ কয়েকটি প্রিস্কুল বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আমাদের এখন বেহাল অবস্থা”।
প্রি-স্কুলে ভর্তি হয় দেড় থেকে দু’বছরের কচিকাঁচারা। তারা সেখানে পড়ে সাড়ে তিন থেকে চার বছর পর্যন্ত। ওই শিশুদের অনলাইন ক্লাস কতটা বাস্তবসম্মত? উত্তরে গড়িয়ার একটি প্রি-স্কুলের প্রিন্সিপাল জানান "কচিকাঁচাদের অনলাইন ক্লাসের সময়ে তাঁদের অভিভাবকেরা থাকছেন"। বড় স্কুলে যারা ভর্তি হচ্ছে তাদের ইন্টারভিউ অনলাইনেই হচ্ছে। ফলে যে বাচ্চারা অভিভাবকদের সাহায্য নিয়ে অনলাইন ক্লাস করছে, বড় স্কুলে ভর্তির ব্যাপারে তারা কিছুটা হলেও সুবিধা পাচ্ছে"।
যদিও অধিকাংশ অভিভাবকই মনে করছেন, “দেড়-দু’বছরের বাচ্চাদের অনলাইন ক্লাসে বসিয়ে রাখা অত্যন্ত কঠিন”। উত্তরপাড়ার বাসিন্দা অভিভাবক কৌশিক কুণ্ডু এ প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, ‘স্কুলে গেলে আমার বাচ্চা আর পাঁচ জনের সঙ্গে খেলতে খেলতে তবু কিছু শেখে। বাড়িতে তো ওকে ল্যাপটপের সামনে বসিয়েই রাখা যায় না"।
শহরের একটি নামী প্রিস্কুলের শিক্ষিকা সৃজিতা বসু জানিয়েছেন, “আমাদের অনলাইন ক্লাস হয় ঠিকই। কিন্তু তা অফলাইন ক্লাসের বিকল্প কখনওই নয়। কলকাতায় আমাদের স্কুলের সাতটি শাখার মধ্যে দু’টি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। যেগুলি চলছে, সেখানেও পড়ুয়া সংখ্যা তলানিতে”।
এদিকে অধিকাংশ প্রিস্কুল গুলি চলে বাড়ি ভাড়া নিয়ে, ছাত্রছাত্রী না থাকলে শুধু ভাড়া গুনে কত দিন চালানো সম্ভব? এই প্রশ্ন তুলেছেন প্রিস্কুলের প্রিন্সিপালরা। এত প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে কোন মনে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা চলছে, তবে সেটা আর কতদিন তাই ভেবেই রাতের ঘুম উড়েছে শহরের একাধিক প্রিস্কুলের প্রিন্সিপালদের।
এপ্রসঙ্গে শহরের অপর একটি প্রিস্কুলের প্রিন্সিপাল নন্দিতা জানা জানিয়েছেন, “নতুন জাতীয় শিক্ষানীতিতে তিন বছর প্রি-স্কুলে পড়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ফলে এখন প্রি-স্কুলের গুরুত্ব বেড়েছে। তাঁর মত, করোনা কালে প্রি-স্কুল ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সবাইকে ফের ঘুরে দাঁড়াতেই হবে। যদিও অনেক প্লে স্কুল করোনা আবহে বন্ধ হয়ে গেছে। তাও আমাদের লড়াই জারি রাখতেই হবে”।
এদিকে চন্দননগরের একটি প্লে স্কুলে পড়াতেন এম.এ বি.এড পাশ শিক্ষিকা তনিমা মুখার্জী। বেশ কয়েক মাস হল হাফ বেতন পাচ্ছেন, ফলে সংসার চালানো দায় হয়ে পড়েছে তার পক্ষে। তার কথায়, “সামান্য বেতনে শহরের একটি প্লে স্কুলে পড়ানোর চাকরি পাই, পারিবারিক কারণে বেতন কম হওয়া সত্ত্বেও চাকরিটা আমাকে করতেই হয়, করোনাকালে স্কুলে সেভাবে ছাত্র ছাত্র না থাকার কারণে আমাদের বেতনও অর্ধেক করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সংসার চালানো দায় হয়ে পড়েছে”।