পশ্চিম মেদিনীপুরের বিভিন্ন গ্রামে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে দলমার দামালরা। হাতির তান্ডবের হাত থেকে ফসল রক্ষা করতে গিয়ে দিনরাত এক করেও পেরে উঠছেন না এলাকার কৃষকরা। প্রায় এক মাস আগে দলমা পাহাড়ের হাতির একটি দল ঝাড়গ্রাম থেকে ঝাড়খন্ডে চলে গিয়েছিল, কয়েকদিন আগে ফের তারা পশ্চিম মেদিনীপুরে ঢুকে বিভিন্ন গ্রামে কার্যত তাণ্ডব চালাচ্ছে। দ্বিতীয় দফায় হাতির দৌরাত্ম্যে মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে এক গ্রামবাসীর। এছাড়াও হাতির তাড়া খেয়ে ছুটতে গিয়ে আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন।
মঙ্গলবার হাতি তাড়াতে গিয়ে হাতির আক্রমণেই মারা যান উত্তম সিং (২২) নামে এক যুবক। বাড়ি শালবনির জাড়া গ্রামে। মৌপালের জঙ্গলে একদল গ্রামবাসীর সঙ্গে হাতি তাড়াতে গিয়েছিলেন তিনি। এছাড়াও আহত হয়েছেন কয়েকজন। অবশ্যই প্রাণহানি শুধু নয়, নষ্ট হচ্ছে ঘরবাড়ি, ধানের গাদা, আলু চাষের জমি প্রভৃতি। এই হলো জমিতে আলু লাগানোর সময়। কিন্তু বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে কয়েকশো বিঘা আলু জমি তছনছ করেছে দাঁতালরা।
শালবনি ব্লকের মেটালা, পিরাকাটা, মৌপাল, জলহরি, সোনাকড়া, করেদানা, বাগমারি প্রভৃতি গ্রামে বিঘার পর বিঘা আলু জমি বিনষ্ট হয়েছে। মৌপাল গ্রামের আলু চাষী জীবন মাহাতোর বক্তব্য, "মহাজনের কাছ থেকে ধার নিয়ে আলু চাষ করেছি, হাতিতে সব শেষ করে দিয়েছে। এবার কিভাবে ধার শোধ করব সেটাই ভাবছি।" ওই গ্রামেরই আরেক ক্ষতিগ্রস্ত আলু চাষী শম্ভু মাহাতো বললেন, "বনদপ্তরের কর্মীরা নির্দিষ্ট সময়ে গ্রামে আসছে না হাতি তাড়াতে, যার জন্য হাতির দল অবাধে ঘরবাড়িতে ঢুকে যাচ্ছে।"
মেদিনীপুর সদর ব্লকের মনিদহ, রেরাপাল, এনায়েতপুর প্রভৃতি গ্রামের অবস্থাও একই রকম। হাতির বিশাল দলটি বেশ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন জঙ্গলে রয়েছে। সন্ধ্যে নামলেই লোকালয়ে ঢুকে যাচ্ছে এবং রাতভর জমি কিংবা ঘরবাড়িতে তাণ্ডব চালাচ্ছে। বনদপ্তরের তরফ থেকে বারংবার সতর্কবার্তা জানানো হচ্ছে গ্রামবাসীদের। বুধবার মেদিনীপুর বন বিভাগের কোন অঞ্চলে কতগুলো হাতি রয়েছে তার একটা হিসাব দেওয়া হয়। সেই হিসাব অনুযায়ী ২ জানুয়ারি তারিখে হাতির সংখ্যা: লালগড় রেঞ্জ, জঙ্গলখাস (৭৭৯) - ১, বীরভানপুর - ২, অজনাশুলী - ১, চাঁদড়া রেঞ্জ, শুকনাখালি - ৪০-৪৫, আমগোবরা - ২, গোদাপিয়াশাল রেঞ্জ, গোবরাশোল - ২৫-৩০, আড়াবাড়ি রেঞ্জ, মহিষডুবি - ১, চন্দ্রকোনা রেঞ্জ, পানসুলি - ২, নয়াবসত রেঞ্জ, উখলা - ১।
জঙ্গল লাগোয়া বিভিন্ন গ্রামের যুবকদের নিয়ে বনদপ্তরের 'বন সুরক্ষা কমিটি' গড়ে তোলা হয়েছে। এই কমিটির যুবকরাই হাতি তাড়ানোর কাজে যুক্ত থাকেন। মাত্র কিছুদিন আগেই সুপ্রিম কোর্টের এক নির্দেশে বলা হয়, হাতি তাড়ানোর জন্য হুলা, অর্থাৎ আগুন এবং ক্যানেস্তারা সম্বলিত স্থানীয় বাসিন্দাদের দলবল, ব্যবহার করা যাবে না, যার ফলে সমস্যায় পড়েছেন বন সুরক্ষা কমিটির যুবকরা। হাতি লোকালয়ে আসছে, কিন্তু হুলা পার্টি বের করা যাচ্ছে না বলে স্বাভাবিকভাবেই শুধু টর্চ জ্বালিয়ে এবং ড্রাম বাজিয়েই হাতি তাড়ানোর কাজ করছেন তাঁরা।
মেদিনীপুর বন বিভাগের আধিকারিক রবীন্দ্রনাথ সাহা বললেন, "হাতিগুলি বিভিন্ন জঙ্গলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, যার জন্য একসঙ্গে তাদের তাড়িয়ে অন্য জঙ্গলে নিয়ে যেতে সমস্যা হচ্ছে। তাছাড়া, যেসব গ্রাম লাগোয়া জঙ্গলে হাতিগুলি রয়েছে, সেই সব এলাকায় হাতির পর্যাপ্ত খাবার রয়েছে ,তাই হাতি গুলি সহজে যেতে চাইছে না। গ্রামবাসীদের সতর্ক করা হয়েছে, তাঁরা যেন হাতির থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকেন।"
স্থানীয় বাসিন্দা অরূপ নন্দীর কথায়, "একেই প্রচন্ড ঠান্ডা পড়েছে, তার ওপর হাতি তাড়ানোর জন্য এলাকার যুবকদের রাত জাগতে হচ্ছে গ্রামের মাঠে, এরকম তো রোজ রোজ চলতে পারে না। হাতিগুলোকে দূরে পাঠিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিক বনদপ্তর।" অথচ তারপরেও জঙ্গল থেকে হাতিরা বেরোলেই তাদের দেখার জন্য গ্রামবাসীদের মধ্যে একপ্রকার হুড়োহুড়ি লেগে যায়। মোবাইল ফোনে ছবি তোলা, সেলফি তোলার হিড়িক পড়ে যায়। এসব বিষয়েই বারংবার সাবধান করছে বনদপ্তর।