প্রতিবেদক- নিরুপমা সুব্রমনিয়ান
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট যে কোনও মানদন্ডে নজিরবিহীন। প্রথমত, আফগানিস্তান বাদে, দক্ষিণ এশিয়ার কোনও দেশই গত ৭৫ বছরে এত বড় সংকটের সম্মুখীন হয়নি। দ্বিতীয়ত, শ্রীলঙ্কা১৯৮২ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত একটি বড় গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। দ্বীররাষ্ট্রে দেশটির অর্থনীতি একদা সিঙ্গাপুরর মডেল হিসাবে লি কুয়ান ইউ-এর দ্বারা প্রশংসিত হয়েছিল। সেই দেশের অর্থনীতির এতটা খারাপ অবস্থা অবাক করে। তৃতীয়ত, বামপন্থী-জাতীয়তাবাদী 'জনতা বিমুক্তি পেরামুনা'র বিদ্রোহ বার বার আছড়ে পড়েছে শ্রীলঙ্কায়। কিন্তু সরকারের বিরুদ্ধে এতটা জনরোষ দেখেনি। কেউ কেউ এবারের সংকটকে শ্রীলঙ্কার আরব বসন্ত বলেছেন।
প্রতিবেশী রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কায় চরম আর্থিক সংকট। এই প্রেক্ষাপটে নয়াদিল্লির ভূমিকা আলোচনায় আসা অনিবার্য-
সম্প্রতি কলম্বোতে রাজাপক্ষের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ আছড়ে পড়েছে। উঠছে স্লোগানও। যার একটি আলোচিত হচ্ছে। আন্দোলনের মধ্যে থেকে অনেকেই বলছেন যে, ভারত রাজাপক্ষ সরকাকে নয়, শ্রীলঙ্কার জনগণের পাশে দাণড়িয়ে সহায়তা করুক। তবে সকলেই ভারতীয় সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন। দিল্লি এই বছরের জানুয়ারি থেকে প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কাকে ২.৪ বিলিয়ান মার্কিন ডলার সহায়তা দিয়েছে। তবে এই সহায়তা রাজাপক্ষে সরকার কীভাবে কাজে লাগাবেন তা তাঁদের উপরইউ ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
তবে ভারচতের সহায়তার মধ্যে রয়েছে অন্তর্নিহিত উদ্বেগ রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এখনও পর্যন্ত ভারতের কাছ থেকে দুইভাবে সহায়তা পেয়েছে কলম্বো। একদিকে জ্বালানীর দিয়ে, অপরদিকে নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য এবং পণ্য, চাল সরবরাহ করে। বহু শ্রীলঙ্কাবাসী মনে করছেন যে, ভারতীয় সাহায্য নিয়ে গোটাবায়া রাজাপক্ষে ত্রাণবিলি করবেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করবেন। এতে আন্দোলন দমে যেতে পারে। ফলে প্রেসিডেন্ট পদে থেকে যেতে পারেন গোটাবায়া রাজাপক্ষে। এতে গভীর সমস্যার সমাধান হবে না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক কুশল পেরেরার বিশ্লেষণ, সংকটে কোনও দেশ বা কোনও সংস্থার সহায়তা জনগণের জীবনকে সামান্য রেহাই দিতে পারে। যা বেশ কয়েক মাস চললেই সংকট মনে হবে কমল, ফলে মানুষের অসন্তোষ কমবে। ফলে কুর্সিতে থেকে যাবেন রাজাপক্ষে। তিনি বলেছেন, 'সহায়তা পেতে মানুষেক কষ্ট লাঘব অবশ্যম্ভাবী। জনগণের দুর্দশার অবসান, খাদ্য ও ওষুধের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ঘাটতি মেটানোই এখন অগ্রাধিকার। এটি গোটাবায়াকে অন্তত অস্থায়ীভাবে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু তিনি চিরকাল থাকার আশা করতে পারেন না। রাজাপাক্ষদের শাসন ক্ষমতা হারানোর অনেক কারণ রয়েছে, কেন লোকেরা তাদের ঘৃণা করে এবং শেষ পর্যন্ত তাদের ভোট দেবে না তা এই অবস্থার বিচার করলেই পরিস্কার হয়ে যাবে।' তাঁর সংযোজন, 'এই মুহূর্তে, একদিকে ভারতের কাছ থেকে সাহায্য গ্রহণ করা সুবিধাবাদী আচরণ, অন্যদিকে সবার বলা প্রয়োজন যে রাজাপক্ষদের সাহায্য করবেন না।'
শ্রীলঙ্কায় ভারতীয় হাইকমিশনার গোপাল বাগলে, যিনি শুক্রবার কলম্বোতে ভারতীয় মিডিয়াকে ব্রিফ করেছিলেন, তিনি জোর দিয়েছিলেন যে ভারতের সহায়তা 'একটি মানবিক' প্রয়াস।
কিন্তু স্থানীয় মিডিয়াতে দিল্লির সময়মত সহায়তার বিনিময়ে ত্রিনকোমালি তেল ট্যাঙ্ক সংস্থা, পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি প্রকল্প এবং এই জাতীয় অন্যান্য চুক্তির মতো দীর্ঘ-অমীমাংসিত কৌশলগত উন্নয়ন প্রকল্পগুলিকে বাস্তবায়ণে জোর দেওয়া হয়েছে। যার সমালোচনা করা হয়েছে। উদ্বেগের বিষয় হল ৮০-র দশকে ভারত, শ্রীলঙ্কার জাতিগত সংঘাতে হস্তক্ষেপের সময় যে আধিপত্যের প্রয়োগ করেছিল সেটাই এবারের সংকটের সময়ও পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে। একসময় কলম্বোতে ভারতীয় হাইকমিশনার জে এন দীক্ষিতকে 'ভাইসরয়' বলে সম্বোধন করা হত। তাঁর প্রভাব বোঝাতেই এই শব্দবন্ধ ব্যবহার হত। এবারেও সংকটেও সময় ভারতের সহায়তা ও আড়ালে ক্রমশ প্রভাব বিস্তারকারী মানসিকতার ইঙ্গিত ইতিমধ্যেই পেতে শুরু করেছে শ্রীলঙ্কার একাংশের মানুষ।
দাতা এবং গ্রহণকারীর কাছে 'সহায়তা' দু'দিক ধার দেওয়া তলোয়ারের মতো। এবারের সংকটের সময় শ্রীলঙ্কা এ সম্পর্কে খুব সচেতন।
Read in English