ইমরান খান, যাঁর ২১ বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ার তাঁর ২৬ বছরের রাজনৈতিক যাত্রাকে ছাপিয়ে গেল। ক্ষমতায় এসেই প্রায় সমস্ত বিরোধী নেতাদেরসঙ্গেই ঘৃণার ঘৃণ্য আচরণ করেছিলেন 'কাপ্তান'। বিরোধীদের বিঁধতে প্রায়েই অন্যদলের নেতাদের নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য করতেন। যার সুবাদেই বিরোধী শিবিরের সব দল জোটবদ্ধ হয়ে পড়ে। সেষ পর্যন্ত সেই বিরোধী জোটই ইমরান সরকারের পতনের কারণ গল।
সেনেট নির্বাচনে বিব্রতকর পরাজয়ের পরে ২০২১ সালের মার্চে পাক ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে আস্থা ভোট হয়। তাতে স্বাচ্ছন্দ্যেই জিতেছিল তেহেরেক-ই-ইমসাফ সরকার। তখন জোটসঙ্গীরাও ছিল ইমরানখানের সঙ্গে। কিন্তু, তার পর থেকেই ক্রমশ পরিস্থিতি বদল ঘটতে শুরু করে।
১৯৯৬ সালে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ নামক দল গঠন করেন, যার অর্থ ন্যায়বিচারের আন্দোলন। শুরু থেকেই ইমরান খান দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)-এর আধিপত্য ভাঙতে লড়াই চালান। সামরিক বাহিনীর শাসন ছাড়া এই দুই দলই এতদিন পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণ করেছে।
বছরের পর বছর পিএমএল-এন এবং পিপিপি আধিপত্য ভাঙতে অসফল হয়েছে তেহেরেক-ই-ইনসাফ। একবার ইমরান বলেছিলেন, পাকিস্তানের রাজনীতি বংশানুক্রমিক।' পিএমএল-এন এবং পিপিপি দলের নেতৃত্বে রয়েছে যথাক্রমে শরীফ ও ভুট্টো পরিবার।
আরও পড়ুন- ক্ষমতাচ্যুত ‘কাপ্তান’, আস্থাভোটে হেরে কুর্সি খোয়ালেন ইমরান খান, গড়লেন রেকর্ডও
২০০২ সালে সংসদ সদস্য হন ইমরান খান। ২০১৩ সালে নির্বাচিত হন ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে। নির্বাচনের এক বছর পর ২০১৪ সালের মে মাসে, খান অভিযোগ করেন যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন পিএমএল-এন ভোটে জিততে কারচুপি করেছিল। সেবছরই অগাস্টে খান শরীফের পদত্যাগ এবং নির্বাচনী জালিয়াতির তদন্তের দাবিতে লাহোর থেকে ইসলামাবাদে তাঁর সমর্থকদের একটি মিছিলেন নেতৃত্ব দেন।
২০১৮ সালের পাক সাধারণ নির্বাচনে ইমরান খান দলকে জেতাতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সেই সময় তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে দমন, দারিদ্র বিরোধী কর্মসূচি প্রণয়ন, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার উন্নতি এবং তার দেশকে একটি ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ক্ষমতায় থাকাকালীন ইমরান বারবার পাকিস্তানকে একটি ইসলামী কল্যাণকর দেশে রূপান্তরের কথা বলেছেন। তবে তিনি অর্থনীতি ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন।
বৈদেশিক নীতির নিরিখেও, খানের পশ্চিমীদেশগুলোর সঙ্গে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হিমশীতল সম্পর্ক বজায় রাখেন। বদলে রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। তবে, পাকিস্তানের সবসময়ের বন্ধু চিনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও পোক্ত করেছিলেন।
খানের শাসনে, ২০১৯ সালে পাকিস্তান-ভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠী ভারতের পাঠানকোটে আত্মঘাতী হামলা চালায়। তাতে ৪০ জন সিআরপিএফ কর্মী নিহত হন। পাল্টা পাক খাইবার পাখতুনখোয়ার বালাকোটের জঙ্গি শিবিরে এয়ার স্ট্রাইক করে ভারত। যা নিয়ে উভয় দেশের সম্পর্ক আরও তলানীতে পৌঁছায়। দুই প্রিবেশীর মধ্যে আকাশ পথে সংঘর্ষ শুরু হয়। এতেই ভারতীয় বায়ুসেনার উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমানকে বন্দী ককে পাক বাহিনী। পরে তাঁকে মুক্তিও দেয়।
ভারত ২০১৯ সালের অগস্টে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ ক্ষমতা প্রত্যাহার এবং রাজ্যটিকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিভক্ত করার ঘোষণা করার পরেও দিল্লি-ইলামাবাদ সম্পর্কের অবনতি ঘটে। পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরা খান বলেছিলেন যে, কাশ্মীর বিরোধ দুই দেশের মধ্যে একটি বড় সমস্যা। তাঁর মেয়াদে কাশ্মীর সমস্যা রাষ্ট্রসংঘ সহ বিশ্বের একাধিক ফোরামে উত্থাপন করেছিলেন।
আরও পড়ুন- নাটকীয়তায় ভরা ইমরানের অপসারণ, সাজা থেকে বাঁচবেন কি?
পাল্টা ভারত বরাবরই পাকিস্তানকে জানিয়েছে যে, জম্মু ও কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ "ছিল, আছে এবং থাকবে"। পরে ২০১৯ সালে, প্রধানমন্ত্রী খান আনুষ্ঠানিকভাবে কর্তারপুর করিডোর উদ্বোধন করেছিলেন। ভারতীয় শিখ তীর্থযাত্রীদের জন্য ভিসার প্রয়োজন ছাড়াই পাকিস্তানে শিখ ধর্মের এই পবিত্রতম স্থানে যাওয়ার পথ উন্মুক্ত করেছিলেন।
ইমরান খান একসময়ে পাকিস্তানের সবচেয়ে যোগ্য ব্যাচেলর হিসাবে পরিগণিত হতেন। এই পাঠানি সুদর্শন তিনবার বিয়ে করেছেন। তাঁর আগের দুটি বিবাহ বিচ্ছেদে শেষ হয়েছিল। ১৯৯৫ সালে ব্রিটিশ ধনকুবেরের মেয়ে জেমিমা গোল্ডস্মিথের সঙ্গে ইমরান খানের প্রথম বিয়ে হয়েছিল, যা ৯ বছর স্থায়ী হয়েছিল। খানের দুই ছেলে রয়েছে। ২০১৫ সালে টিভি অ্যাঙ্কর রেহাম খানের সঙ্গে তাঁর দ্বিতীয় বিয়ে হয়, যা বিচ্ছেদ হয় ১০ মাস পর।
২০১৮ সালে, খান তৃতীয়বার বিয়ে করেন। নিজের “আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক” বুশরা মানেকাকে এবার জীবনসঙ্গী করেন তিনি।
১০৫২ সালে মিয়ানওয়ালিতে ইকরামুল্লাহ খান নিয়াজী এবং শওকত খানমের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন ইমরান খান। তাঁর পিতা শেরমানখেল পশতুন নিয়াজি বংশধর। খান লাহোরের আইচিসন কলেজ এবং ইংল্যান্ডের রয়্যাল গ্রামার স্কুল ওরচেস্টারে পড়াশোনা করেন।
১৯৭১ থেকে ৯২ পর্যন্ত পাকিস্তানের হয়ে টেস্ট ক্রিকেট খেলেছিলেন ইমরান খান। তাঁর অধিনায়কত্বেই ১০৯২ সালে পাকিস্তান ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পায়।
Read in English