কারও কারও কাছে তিনি আরশোলা রাজ, চিনের বিশ্বাসঘাতক, হংকংয়ের গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনের গেপন মদতদাতা। অন্যদের কাছে- ট্রাম্প প্রশাসন ও তাঁর সহযোগীদের কাছে তিনি চিনা কমিউনিস্ট পার্টির অনুগামী এবং গুরুতর পরিকাঠামোর ব্যাপারে যাঁর উপর ভরসা করা যায় না।
লি কা-শিং হংকংয়ের বৃহত্তম সম্পদের মালিক, যে সম্পদ তিনি নির্মাণ করেছেন চিন ও পশ্চিম থেকে। এখন তাঁর কাছে দু তরফকে খুশি রাখা দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেজিংয়ের সঙ্গে পশ্চিমের সরকারগুলির এখন হংকং থেক বাণিজ্য থেকে করোনাভাইরাস সব নিয়েই উত্তেজনা। এই পরিস্থিতিতে, যাকে নয়া ঠান্ডা যুদ্ধবলে অভিহিত করছেন অনেকেই, তখন ৯১ বছরের কোটিপতির ব্যবসা সাম্রাজ্য চলবে কিনা তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্টক মার্কেটকে যদি নির্দেশক বলা যায়, তাহলে সাফল্যের সম্ভাবনা দিন দিন ক্ষীণ হয়ে আসছে। লি-র সাম্রাজ্যের বৃহত্তম হল সিকে হাচিসন হোল্ডিংস লিমিটেড। তাদের সম্পত্তির মূল্য অর্ধেক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৫ সালের পর থেকে এত খারাপ পরিস্থিতিতে তারা আর পৌঁছয়নি।
হংকং ও মেনল্যান্ড চায়নার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে চলা লিয়ের সিকে হাচিসন ৮০ শতাংশের বেশি আয় করে বিদেশ থেকে, যার অনেকটাই আসে বিদ্যুৎ, পরিকাঠামো, টেলিকমিউনিকেশন ও বন্দরের মত সংবেদনশীল ক্ষেত্র থেকে। চিন ও পশ্চিম, উভয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলার কারণে অন্য বহুজাতিকের তুলনায় এই সংস্থার উপর রাজনৈতিক নজরদারি ফলে তীব্র।
হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্ট্র্যাটেজি শিক্ষক জ্যাকি ইয়ানের কথায় এটা খুব সূক্ষ্ম ভারসাম্যের ব্যাপার। উনি চান না পশ্চিমের দেশগুলির নিয়ন্ত্রক সংস্থা ওঁকে চিনা সরকারের ঘনিষ্ঠ বলে মনে করুক।
কিন্তু তা সত্ত্বেও তেমনটা ঘটেছে, যখন মে মাসে ইজরায়েলে জল পরিশোধন প্ল্যান্ট বসানোর অনুমতি পাওয়ার লড়াইয়ে পরাজিত হয়, যার জেরে বছরে ৮৫ মিলিয়ন ডলার বা সারা জীবনে ২.১ বিলিয়ন ডলার আয় হাতছাড়া হয় সি কে হাচিনসনের।
এই টেন্ডার নিয়ে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে সতর্ক করে দেন মার্কিন সচিব মাইক পম্পিও। জানানো হয় আমেরিকা এ ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। এই চুক্তি এক ইজরায়েলি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার দু সপ্তাহ আগে পম্পিও এক সাক্ষাৎকারে বলেন, আমরা চাই না ইজরায়েলের পরিকাঠামোয় চিনা কমিউনিস্ট পার্টির অ্যাকসেস থাকুক।
এ ব্যাপারে হাচিনসন কোনও মন্তব্য করেনি।
এই প্রথম নয়। ২০১৮ সালে একই রকম নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় এক গ্যাস পাইপলাইন অধিগ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি তাদের। যারা বরাত পেয়েছিল সেই এপিএ সংস্থা ৪৬৩ মিলিয়ন ডলার লাভ করেছে।
লি-এর জন্ম মূল চিন ভূখণ্ডে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তিনি হংকংয়ে পালিয়ে যান। চিনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক জটিল। প্রথম দিকে চিনের নেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকলেও ২০১৩ সালে শি জিনপিং ক্ষমতায় আসার পর থেকে তা খারাপ হতে শুরু করে। এর আগের নেতাদের সঙ্গে তিনি ব্যক্তিগত ভাবে সাক্ষাৎ করলেও জিনপিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন না তা নিশ্চিত নয়।
সিকে হাচিনসন ও সিকে অ্যাসেট - দুই নতুন সংস্থাকে হংকংয়ের বদলে কেম্যান আইল্যান্ডে নথিভুক্ত করানোর পর ২০১৫ সাল থেকে চিনের সংবাদমাধ্যমে সমালোচিত হন তিনি। চিনের প্রতি তাঁর বিশ্বস্ততা নিয়ে প্রশ্ন তোলে পিপলস ডেলি এবং শিনহুয়া নিউজ এজেন্সির অধীন থিংক ট্যাঙ্ক।
এর প্রতিক্রিয়ায় লি-এর দফতর থেকে তিন পাতার এক বিবৃতিতে এই অভিযোগ অস্বীকার করা হয় এবং সি জিনপিংয়ের নেতৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। জানানো হয়, গত দু বছরে লি-এর গোষ্ঠী মেনল্যান্ডে ১০০০ খুচরো দোকান খুলেছে এবং চিন ও হংকংয়ের স্বার্থে ২.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান দেওয়া হয়েছে।
লি চিনের কিছু এলাকায় বাণিজ্যবিস্তার করলেও সব মিলিয়ে তিনি সেখান থেকে ব্যবসা গুটিয়ে আনছেন। ২০১৫ সাল থেকে সিকে গ্রুপ সারা বিশ্বে লগ্নি ও অধিগ্রহণ করেছে ৬০ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে চিন ও হংকংয়ে করা হয়েছে ১.৬ শতাংশ।
গত বছর চিনের ক্ষোভ ফের চরমে ওঠে। হংকংয়ের উপর চিনা আগ্রাসন বিরোধী বিক্ষোভ যখন তুঙ্গে, সে সময়ে অন্য বড় ব্যবসায়ীরা সরকারের প্রতিধ্বনি করেন বিক্ষোভকারীদের বিরোধিতা ও পুলিশি হস্তক্ষেপের সাফাই গাইছিলেন। লি সে সময়ে স্থানীয় সংবাদপত্রে এক অস্পষ্ট বার্তায় চিনা কবিতা উদ্ধৃত করেন। হংকংয়ের রাস্তায় হিংসার অবসানের সঙ্গে স্বাধীনতা, ধৈর্য্য ও আইনের শাসনে জোর দেওয়ার কথাও সে বিবৃতিতে ছিল বলে সব মহল থেকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কয়েক সপ্তাহ পর তিনি সরকারের কাছে আবেদন জানান বিশৃ্ঙ্খলা মোকাবিলার সময়ে তরুণদের ব্যাপারে ধৈর্য প্রদর্শন করার জন্য।
এর পরেই ফের সমালোচনা শুরু হয়। লি-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে হিংসায় সমর্থন দেওয়ার।
চিনের ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসে হংকংয়ের প্রতনিধি তাঁর ফেসবুক পেজে একটি মিম পোস্ট করেন যেখানে লিকে ককরোচ কিং নাম দেওয়া হয়। হংকংয়ের পুলিশ ও তাদের সমর্থকরা বিক্ষোভকারীদের মনুষ্যেতর দেখানোর জন্য এই নাম দিয়ে থাকে।
এসব ব্যাপারে সিকে গ্রুপ মুখ খোলেনি। সিকে হাচিসনের বার্ষিক শেয়ারহোল্ডারদের সভায় লি-এর বড় ছেলে ভিক্টর লি বলেন, আমেরিকা ও চিনের বৈরী সম্পর্কের প্রভাব গোষ্ঠীর টেলিকমিউনিকেশন, পরিকাঠানো ও খুচরো ব্যবসায়ে প্রভাব ফেলেনি, বন্দরের উপর প্রভাব এখনও দেখতে হবে।
গণতন্ত্রপন্থীরা হংকংয়ের বিখ্যাত ধনীকে সঙ্গে পাওয়া গিয়েছে ভেবে উল্লসিত হন।
হংকংয়ের উপর চিনের থাবা ক্রমশ কঠিন হচ্ছে, এদিকে লি-এর সংস্থা চিনা সরকারের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত এ কথা বোঝাতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে পশ্চিমা নিয়ন্ত্রকদের।
লি ও তার ছেলে ভিক্টর গোষ্ঠীর ভবিষ্যতের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসের ইঙ্গিত দিয়েছেন। মার্চ মাস থেকে হাচিসন ও অ্যাসেট, দুই সংস্থারই শেয়ার সংগ্রহ করেছেন চাঁরা। তবে লগ্নিকারীরা যে সংশয়ী, তা বোঝা যাচ্ছে দুটি সংস্থার শেয়ারমূল্য কমেছে।
পরিকাঠামোর মত ব্যাপক নিয়ন্ত্রিত ক্ষেত্রের বদলে গোষ্ঠী এবার কম সংবেদনশীল এ খুচরো ব্যবসায় মনোনিবেশ করতে পারে বলে জানিয়েছেন ইয়ান। তিনি বলেন, ভৌগোলিক বৈচিত্র্য এঁদের ভালভাবে তৈরি করে দিয়েছে। কিন্তু ভূরাজনীতির এই ব্যাপক উত্তেজনার মুহূর্তে, রাজনৈতিক ক্রসফায়ারের মাঝে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে ওঁদের।