আজ থেকে প্রায় ১৭ বছর আগে, ২০০২ সালের শেষের দিকে, তৎকালীন অর্থমন্ত্রী যশবন্ত সিংয়ের উদ্যোগে ভারতের কর আদায় প্রক্রিয়ার আমূল পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। কর জমা দেওয়ার প্রক্রিয়াটিকে আরও সরল ও যুক্তিসঙ্গত করাই ছিল লক্ষ্য, এবং ট্যাক্স রিটার্ন জমা দেওয়ার সেসময়ের ফরম্যাট পুনর্বিবেচনার কাজে হাত দিয়েছিল অর্থ মন্ত্রক। তখনকার ট্যাক্স রিটার্ন ফর্মের দৈর্ঘ্য অনায়াসে দশ পাতা ছাড়িয়ে যেত। শোনা যায়, অর্থমন্ত্রীকে যখন তাঁর বিভাগীয় আধিকারিকরা প্রস্তাবিত নতুন 'সরল' ফর্মের নমুনা দেখাতে যান, যা কিনা ব্যক্তি করদাতার জন্য তৈরি, মন্ত্রীমশাই রেগেমেগে জানতে চান, নতুন ফর্মটি ঠিক কোন দিক থেকে 'সরল', যার ফলে তড়িঘড়ি ফর্মটিকে আরও সরল করার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন আধিকারিকরা।
কয়েকমাস পরে, ২০০৩-০৪ সালের বাজেট পেশ করতে গিয়ে তাঁর কথায় একটি "আধুনিক, দূরদর্শী, রাজস্বের পক্ষে লাভজনক" কর আদায় প্রক্রিয়া দেশের সামনে তুলে ধরেন সিং। নতুন অনেক কিছু ছিল তার মধ্যে। ব্যক্তি করদাতার জন্য এক পাতার রিটার্ন ফর্ম, ট্যাক্স রিটার্ন তদন্তের ক্ষেত্রে বিবেচনামূলক বাছাইয়ের পরিবর্তে কম্পিউটার দ্বারা স্রেফ দুই শতাংশ রিটার্নের যদৃচ্ছ বাছাই, এবং করদাতার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সরাসরি ট্যাক্স রিফান্ডের টাকা জমা করিয়ে দেওয়া।
আরও পড়ুন: রেলমন্ত্রী পীযুষ গয়ালের হাতে অর্থমন্ত্রকের অতিরিক্ত দায়িত্ব
বদলের শুরু
মোটামুটি একই সময়ে অর্থমন্ত্রীর উপদেষ্টা বিজয় কেলকরের নেতৃত্বে একটি দলের উপদেশ মেনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্র। ঠিক করা হয় যে, নিরপেক্ষ কর আদায় প্রক্রিয়া গঠনের স্বার্থে প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি ট্যাক্স ইনফরমেশন নেটওয়ার্ক (টিআইএন) তৈরি করা হবে। আজ পনেরো বছরের বেশি সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর সেই সিদ্ধান্তের সুফল সুস্পষ্ট।
বর্তমান সরকারের ঘোষিত নীতি অনুযায়ী, এখন থেকে যেসব সংস্থা কর্মীদের ট্যাক্স গোড়াতেই কেটে নেয়, ব্যাঙ্ক, এবং অন্যান্য এজেন্সির আয়কর বিভাগের কাছে জমা দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন আগাম ভরে জমা দেওয়া হবে। এই পরামর্শ ইউপিএ সরকারের অধীনে গঠিত কর প্রশাসন সংস্কার কমিশনের, যার প্রধান ছিলেন ব্রিটেনের রাজস্ব বিভাগে কাজ করে আসা ডাঃ পার্থসারথি সোম। কমিশনের পরামর্শ ছিল, আগাম পূরণ করা ফর্ম সমস্ত করদাতাকে দেখিয়ে নেওয়া হবে, যাতে তাঁরা রিটার্নের অঙ্ক প্রয়োজনে সংশোধন করে নিতে পারেন।
পক্ষে, বিপক্ষে
কর অনুবর্তিতা, অর্থাৎ স্বেচ্ছায় কর জমা করা নাগরিকের সংখ্যা, গত দশ বছরে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৭-১৮ সালে আয়কর রিটার্নের সংখ্যা ছিল ৬.৮৪ কোটি, যার মধ্যে ৬.৭৫ কোটি ই-ফাইলিং এর মাধ্যমে জমা পড়েছে। ভারতে ট্যাক্স রিটার্নের ৯৮ শতাংশই বর্তমানে ই-ফাইলিং এর মাধ্যমে জমা পড়ে, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশেও এই হার ৯০ শতাংশের কম। এবং নয়া সরল উদ্যোগের কল্যাণে ট্যাক্স রিটার্নের ক্ষেত্রে তদন্তের হার সমস্ত ট্যাক্স রিটার্নের ০.৫ শতাংশেরও কম।
সারা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা ছাড়াও আগাম ভরা ফর্মের আরো একটি সম্ভাব্য ভূমিকা রয়েছে, বিশ্বাস এবং আস্থার ভিত্তিতে একটি ট্যাক্স পরিকাঠামো গড়ে তোলা। কিন্তু আয়কর বিভাগের অনেকেই মনে করছেন যে এদেশে এখনও একথা বলার সময় আসে নি। তার প্রধান কারণ তথ্যের অসামঞ্জস্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা গ্রেট ব্রিটেনের মত আমাদের দেশের আয়কর বিভাগ একজন করদাতার আয়ের সমস্ত উৎস সম্পর্কে নাও জানতে পারে। এবং করদাতা যদি তা জেনে যান, তাহলে আয় গোপন করা অথবা কর না দেওয়ার প্রবণতা বাড়তে পারে।
সোজা কথায়, আগাম পূরণ করা ট্যাক্স ফর্ম জারি করে অনুবর্তিতা না বাড়াতে পারলে আয়কর বিভাগের ক্ষতির সম্ভাবনা, এমনই সংশয় প্রকাশ করেছেন কিছু আধিকারিক। টিআইএন-এর দৌলতে তথ্যের অনেক ফাঁক ভরাট করা হয়েছে, কিন্তু সংশয়বাদীদের মতে, এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত আগাম পূরণ করা ফর্ম চালু করা উচিত হবে না।
আরও পড়ুন: চিকিৎসার জন্য মার্কিন মুলুকে জেটলি, বাজেট পেশ অনিশ্চিত?
সঠিক পথে চলার উপায়
গ্রেট ব্রিটেনে রাজস্ব এবং শুল্ক বিভাগের তরফ থেকে করদাতাদের একটি স্বয়ংক্রিয় সহায়ক প্রদান করা হয়। কর বিভাগের পরিষেবা সংক্রান্ত নিয়মাবলী তাদের অধিকার ও কর্তব্য বিষয়ক চার্টারে লিপিবদ্ধ করা আছে। এই চার্টারের মূলে রয়েছে করদাতার প্রতি বিভাগের আস্থা ও বিশ্বাস যে তিনি কর বিভাগ ও তার কর্মীদের যথাযোগ্য সম্মান দেবেন, এবং বিনিময়ে আয়কর বিভাগ তাঁকে নিষ্ঠা সহকারে পরিষেবা প্রদান করার অঙ্গীকার করে।
ভারতে এই ব্যবস্থা চালু করার প্রথম ধাপ হিসেবে ধরা যেতে পারে ২,২৪২ কোটি টাকার সংহত ই-ফাইলিং ও সেন্ট্রালাইজড প্রসেসিং সেন্টার ২.০ প্রকল্প, যা সম্প্রতি ক্যাবিনেটের অনুমোদন পেয়েছে। দেড় দশক আগের আয়কর বিভাগের প্রকল্পের মতোই, এই নতুন প্রকল্পের দায়িত্বেও থাকবে ইনফোসিস। সরকারের অনুমান, এই প্রকল্প রূপায়িত হলে ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন প্রক্রিয়াকরণের সময়সীমা ৬৩ দিন থেকে কমে হয়ে যাবে মাত্র এক দিন। এর ফলে ট্যাক্স প্রত্যর্পণ বা রিফান্ড হবে আরও দ্রুত, যার ফলে বাড়বে স্বেচ্ছায় কর জমা দেওয়ার হার।
কর অনুবর্তিতা বিষয়ে সোম কমিটির বক্তব্যের সারমর্ম ছিল: "কোনো অবস্থাতেই একজন করদাতা যেন সারাজীবন এই ভেবে না কাটিয়ে দিতে পারেন, যে অনুকূল কর আদায় পরিকাঠামোর কল্যাণে তাঁর আর কর দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কর আদায়ের মাত্রা বাড়াতে হবে স্রেফ শিক্ষার মাধ্যমে নয়, কিছু ক্ষেত্রে আয় গোপন করার শাস্তি সম্বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি করেও।"
২০০৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারিতে তাঁর বাজেট ভাষণে যশবন্ত সিং বলেন, "অধ্যক্ষ মহোদয়, এই উদ্যোগের ফলে বর্তমানের সন্দেহ আক্রান্ত, শাস্তি ভিত্তিক, যন্ত্রণাদায়ক ট্যাক্স পরিকাঠামো থেকে সরে এসে আস্থা ভিত্তিক 'গ্রিন চ্যানেল' চালু করতে পারব। আমার দেশের মানুষের ওপর পূর্ণ আস্থা থেকেই এই উদ্যোগ নিতে চাই।"
আজ পর্যন্ত সিংয়ের মতো জোর দিয়ে খুব কম মন্ত্রীই প্রক্রিয়া পরিবর্তনের পক্ষে সওয়াল করেছেন।পরবর্তীকালে এ বিষয়ে অনেকটা অগ্রগতি সত্ত্বেও সিংয়ের বর্ণিত আস্থা ও বিশ্বাসের গভীরতা বিচার করা যায় নি এখনও।