বছর তিনেক আগের কথা, ২০১৬ সালের নভেম্বর মাস। আচমকাই পাঁচশো এবং হাজার টাকার নোটবাতিলের ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এবং দেশময় হুড়োহুড়ি পড়ে যায় বাতিল হয়ে যাওয়া নোট নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে কাজে লাগানোর। অনেকেই সেসময় নগদ টাকা দিয়ে সোনা কেনেন। আজ, তিন বছর পর, সেসময় যাঁরা সোনা বিক্রি করেছিলেন, তাঁদের কাছে অকস্মাৎ এসে পৌঁছেছে আয়কর দপ্তরের নোটিশ। কী? না সেসময় অর্জিত সমস্ত লাভের টাকা সরকারের ঘরে দিয়ে দিতে হবে! এমনটাই বলছেন কিছু গহনা ব্যবসায়ী এবং আয়কর আধিকারিক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মুম্বইয়ের এক গহনা ব্যবসায়ী (যিনি শুধুমাত্র জানিয়েছেন যে তাঁর পদবী 'জৈন') বলেন, ৮ নভেম্বর, ২০১৬, যেদিন নোটবাতিলের ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী, সেই রাত থেকেই ওই গহনার দোকানে গ্রাহকদের ভিড় জমতে থাকে, যে করে হোক কিছু সোনা কেনার। মওকা বুঝে দু-সপ্তাহের বিক্রি একদিনে সেরে ফেলেন 'জৈন', চড়া দামে বেচে দেন তাঁর দোকানের সব মাল।
আরও পড়ুন: আগামী ৪৫ দিনে আদায় করতে হবে ২ লক্ষ কোটি টাকা আয়কর, নির্দেশ কেন্দ্রের
মাস তিনেক আগে একটি ট্যাক্স নোটিশ পান তিনি, যাতে তাঁর সেসময়ের উপার্জনের উৎস জানতে চাওয়া হয়, এবং বলা হয় যে সে রাত্রে যত টাকা তিনি লাভ করেছিলেন, তার পুরোটাই যেন জমা করে দেন, যেহেতু সে রাত্রে কালো টাকা দিয়ে সোনা কেনা হয়েছিল বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এই নোটিশের বিরুদ্ধে আবেদন করেন 'জৈন', কিন্তু ভারতীয় আইন মেনে বিতর্কিত টাকার পরিমাণের ২০ শতাংশ জমা করতেই হয় তাঁকে। তাঁর কথায়, "যদি মামলা হেরে যাই, তবে বাকি টাকা দিতে হলে ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হবে।"
ইন্ডিয়া বুলিয়ন অ্যান্ড জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি সুরেন্দ্র মেহতা জানিয়েছেন, প্রায় ১৫ হাজার ভারতীয় গহনা ব্যবসায়ীর কাছে এই ধরনের নোটিশ এসেছে। তাঁর হিসেবমত, গহনা এবং রত্ন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আন্দাজ ৫০০ বিলিয়ন (৫০ হাজার কোটি) টাকা আদায় করতে চাইছে আয়কর বিভাগ। মেহতার বক্তব্য, "এর ফলে এই ইন্ডাস্ট্রিতে পরবর্তীকালে সমস্যা হতে পারে, কারণ যাঁরা আবেদন করার সময় ২০ শতাংশ কর জমা করছেন, তাঁদের ধারে গয়না বা সোনা কিনতে হতে পারে। মামলায় হেরে গেলে তাঁরা সেই ধার শোধ নাও করতে পারেন, যার ফলে ক্ষতি হবে সাপ্লায়ারদের, এবং ব্যাঙ্কের।"
আরও পড়ুন: করোনা আতঙ্কে শেয়ার বাজারে ধস
নিয়ম অনুযায়ী অতীত আয়ের ওপর কর বসাতেই পারে আয়কর বিভাগ, যেহেতু হিসেব সম্পূর্ণ করতে সময় লাগতে পারে অনেকটাই, কিন্তু আয়ের সবটাই জমা করে দিতে হবে, এমন দাবি নজিরবিহীন বললেই চলে। কলকাতার এক ট্যাক্স আধিকারিকের মন্তব্য, "এ যেন তিন বছর পর কবর খুঁড়ে দেহ বের করে দেখা কীভাবে মৃত্যু হয়েছিল, তারপর খুনিকে ধরা।"
আয়কর বিভাগের দুই উচ্চপদস্থ কর্তা সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছেন যে চলতি আর্থিক বর্ষে গহনা ব্যবসায়ী সমেত হাজার হাজার নাগরিককে নোটিশ জারি করেছে আয়কর বিভাগ, এবং মোট কর দাবি করা হয়েছে আনুমানিক ১.৫ থেকে ২ লক্ষ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাওয়া সত্ত্বেও এখনও কোনও প্রতিক্রিয়া আসে নি সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ডিরেক্ট ট্যাক্সেশন অথবা অর্থমন্ত্রকের কাছ থেকে। গহনা ব্যবসায়ীদের কাছে পাঠানো নোটিশ সম্পর্কে কোনও বিবৃতি আসে নি সরকারি তরফেও। তবে এই পদক্ষেপের নেপথ্যে রয়েছে দেশের রাজস্ব বৃদ্ধি করতে মোদীর দাওয়াই, কারণ গত ১১ বছরের মধ্যে মন্থরতম গতিতে এগোচ্ছে ভারতের একদা গতিশীল অর্থনীতি। চলতি আর্থিক বর্ষে ভারতের কর্পোরেট কর এবং আয়কর আদায়ের হার সম্ভবত গত দুই দশকে এই প্রথমবার নিম্নগামী হতে চলেছে, রয়টার্সকে জানিয়েছেন আয়কর আধিকারিকরা।
খাজনা আদায়ের হুড়োহুড়ি
সরকারের বার্ষিক করের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের ওপরেই নির্ভর করছে আধিকারিকদের পদন্নোতি এবং বদলি, যার ফলে ৩১ মার্চ, ২০২০-র মধ্যে অন্তত আংশিকভাবে সেই ঘাটতি মেটাতে হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছে আয়কর আধিকারিকদের মধ্যে।
রাজস্ব বাড়াতে মার্চ মাসের শেষ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে আয়কর সংক্রান্ত বহু মামলার নিষ্পত্তির সময়সীমা। এছাড়াও অনেক বাড়ির সহায়িকা, ড্রাইভার, ইত্যাদির ওপর নজর রাখছেন আধিকারিকরা, কারণ নোট বাতিলের পর এঁদের বিত্তশালী মনিবরা অনেক ক্ষেত্রেই এঁদের অ্যাকাউন্টে টাকা লুকিয়ে রাখেন।
এই কড়া পদক্ষেপের ফলে ফের একবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে সরকারের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত উগ্রভাবে কর আদায়ের অভিযোগের সম্ভাবনা। এই অভিযোগ গত বছর করেন প্রয়াত এক প্রখ্যাত ক্যাফে ব্যবসায়ী, যিনি তাঁর সুইসাইড নোটে লিখে যান আয়কর আধিকারিকদের হাতে তাঁর হেনস্থার কথা।
রয়টার্স যে আটজন গহনা ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে, তাঁদের মধ্যে তিনজন বলেন যে ৮ নভেম্বর, ২০১৬ সালে অর্জিত মোট লাভের পরিমাণই ফেরত চাওয়া হয়েছে, তবে বাকিরা বিশদে কিছু বলতে চান নি।
এক ট্যাক্স আধিকারিকের কথায়, আয়কর বিভাগ কেবলমাত্র এযাবৎকাল অঘোষিত স্টকের বিক্রির ওপরেই কর বসাচ্ছে। তিনি আরও বলেন যে কিছু গহনা ব্যবসায়ী ৮ নভেম্বরের পরেও বাতিল হয়ে যাওয়া নোট গ্রহণ করেন, এবং রসিদে পুরোনো তারিখ লিখে দেন, যাতে প্রমাণ হয় যে ওইসব নোট তখনও বৈধ ছিল।
কলকাতার আরেক আয়কর আধিকারিকের মতে, গহনা ব্যবসায়ীদের কাছে মামলায় হারতে চলেছে আয়কর বিভাগ। "জানি অযৌক্তিক... তবু ২০ শতাংশও যদি পাওয়া যায়, তাহলেও এবছরের কালেকশন বাড়বে," বলেন তিনি।